আমাদের গৌরবময় বিজয়
তাজওয়ার মুনির
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। আর স্বাধীন থাকতেই পছন্দ করে। কেউ ইচ্ছে করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চায়না। খাঁচায় বন্দি থাকা পাখিটাই বুঝে স্বাধীনতার মর্ম। আমৃত্যু হাপিত্যেশ করে জিঞ্জির ভেঙে বের হওয়ার জন্য। নিঃসীম নীল আকাশে তার ডানা দুটি মেলে ধরার জন্য। নিজের ইচ্ছেমত জীবন ধারনের জন্য।
স্বাভাবিকভাবে পখির মত মানুষকে খাঁচায় আবদ্ধ করা হয়না। মানুষের পরাধীনতার ধরনটা একটু আলাদা। স্বাধীনভাবে অধিকার ভোগ করায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই মানুষের পরাধীনতা। স্বাধীনভাবে মনের ভাব ব্যক্ত করার অধিকার খর্ব হওয়াই পরাধীনতা। মোদ্দাকথা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও নিজের কাজ কর্ম করতে না পারাই পরাধীনতা।
বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশির আ¤্কাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় এদেশের শেষ স্বাধীন নবাব, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজ বেনিয়াদের হাতে পরাজয় বরণ করেন বাংলার এই বীর সন্তান। তারপর কেটে যায় প্রায় দু’শো বছর। এ দু’শো বছর ইংরেজ বেনিয়ারা এদেশের মানুষদেরকে গোলামে পরিনত করে। সবিশেষ ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। জন্মলাভ করে দুটি স্বাধীন দেশ। ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান, আর ১৫ আগস্ট ভারত। আজকের বাংলাদেশ সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান। অর্থাৎ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলেও ভাগ্যের চাকা বদলায় না বাঙালির। ইংরেজদের হাত থেকে ক্ষমতা বদল হয়ে হাতে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানের জিন্নাহ সরকারের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের জনগন আশা করেছিল পাকিস্তানে তাদের আশা আকাঙ্খা পূর্ণ হবে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসবে সার্থকতার উজ্জল আলোক। কিন্তু পাকিস্তানের কূট রাজনীতি এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার কারনে সব ধুলিমলিন হয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববাংলা প্রদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিনত করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। একের পর এক চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালিদের বঞ্চিত করা হয়। আমাদের জাতীয় জীবনের সমুদয় মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি আমদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চায়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মেহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঘোষণা দিল ’উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% বাঙালি জনগনের মুখের ভাষার পরিবর্তে জোর করে ৮% জনগনের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়।
আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদাঞ্চলের নেতৃস্থানীয় সাহসী ব্যক্তিরা জনসাধারণকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ইতিহাসে, ইশা খাঁ থেকে শুরু করে হাজী শরিয়তুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বাঘা যতীন, সূর্যসেন তার জ্বলন্ত প্রতিক। তাঁদের উত্তরসূরি বাঙালিরা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে। মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাংলার দামাল ছেলেরা। আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হকচকিয়ে যায় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই মূলত বাঙালির বিজয় শুরু...
এরপর, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালের স্বাধীকার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সবগুলোতেই সফল ভুমিকা পালন করে বাঙালি জনগন। ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্লজ্জভাবে শাসন ক্ষমতা অর্পনে অস্বীকৃতি জানান। ইতোমধ্যেই বাঙালিরা ছয় দফা মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং বাংলার আনাচে কানাচে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তখন ছয় দফা দাবি রূপ নিল এক দফা দাবিতে। সেই এক দফা হলো, দেশকে স্বাধীন করার দাবী। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন। ঐদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে আতাত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার উপর ২৫ শে মার্চ কালো রাতে হত্যা নির্যাতন শুরু করে দেয়। কিন্তু ঐদিনের পূর্বে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তাঁর অমর ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পথ সুগম করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগনের উপর ঝাপিয়ে পড়লে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। কয়েকজন নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সমস্ত জাতি ঝাপিয়ে পড়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি সৈনিক এবং মুক্তিসেনা যোদ্ধারা। শেষে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নব্বই হাজার সৈন্য বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথবাহিনীর কাছে আতœসমর্পণ করে। এই দিনটিতে বাঙালি প্রায় শোয়া দু’শো বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে। ইতিহাসে এই দিনটিই বিজয় দিবস হিসেবে পরিচিত।
পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, কর্ণফুলিবাহিত আমাদের বাংলা ব-দ্বীপ তথা বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস যদি হয় হাজার বছরের, তবে সেই ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় দিন ১৬ ই ডিসেম্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটেছিল এ দিনটিতে। এ দিনটি পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন সার্বভৌম দেশের নাম চিরকালের জন্য এঁকে দিয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম ও ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্ত ও অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দিনে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছি। বিজয়ের এ সুখস্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে যুগ যুগ ধরে এ দিনটি আমাদের প্রেরণা যোগাবে। বহু ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ১৬ ডিসেম্বরকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়। বিজয় দিবস যে কোন জাতির জন্য অতি মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ দিবস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। কিন্তু বিজয় দিবসের গুরুত্ব কমেনি এতটুকু। এই দিনটির মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে ও বিশ্ব কে বার বার মনে করিয়ে দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, শহীদদের কথা। দিনটি মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশ নামে একটি দেশের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কথা, যা প্রতিটি বাঙালি তার হৃদয়ে ধারণ করে আছে।
পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জাতীয় দিবস রয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষ, কারণ ও তাৎপর্য অনুযায়ী। সেই উপলক্ষ ও তাৎপর্য জাতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু ভিক্টরি ডে বা বিজয় দিবস এর তাৎপর্য সব দেশে একই। এই দিনে দল-মত নির্বিশেষে সমগ্র জাতি এক হয়ে জাতির কোন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়লাভের স্মৃতিচারণ করেন। একদিকে যেমন গৌরবে তাদের বুক ফুলে উঠে, উল্লাসে ফেটে পড়ে, অপরদিকে দেশের এই গৌরব এনে দিতে যারা প্রাণদান করেছেন, তাঁদের স্মৃতিচারণ করেন, এবং অংশগ্রহণকারী যারা সেই গৌরবের যুদ্ধের পর এখনো বেচে আছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
মুক্তিযোদ্ধারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাজার বছরের সংগ্রামের পরিণতি। তাঁদের বীরত্বের কাহিনী বাঙালি হৃদয়ে সর্বদা জাগ্রত থাকবে। তাঁদের আতœত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধীকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব বীর শহীদদের বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। দুখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃত চেতনাকে আজ আমরা হারাতে বসেছি, ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস বিস্মৃত হতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরউন্নত রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক চিত্র তুলে ধরা একান্ত অপরিহার্য। এই চেতনা ও বিজয়ের আনন্দ পৌছে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে...
স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ৪৮ বছরের এ পথপরিক্রমায় সে স্বপ্ন পূরনের হিসাব মেলাতে চাইবে সবাই। এর মধ্যে আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনায়।
ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান বিজয় দিবস। পেয়েছি স্বাধীনতা। এ দিন উদিত হয় আমাদের আকাশে নতুন সূর্য। এ স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। আমাদের কাজ সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। বিজয় দিবস শুধুই আমাদের বিজয়ের দিন নয়, এটি আমাদের চেতনা জাগরনের দিন। তাই এদিনে প্রতিটি বাঙালি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দেশকে গড়তে, বিশ্ব সভ্যতায় আমরাও যেন সবার সামনে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারি। যেন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি। অথনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারি। অশিক্ষা ও দারিদ্র থেকে দেশকে মুক্ত করে একুশ শতকের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে পারি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যেমন স্বাধীনতা পেয়েছি, তেমনি রক্ষা করতেও প্রয়োজনে আরও এক সাগর রক্ত দেবো। প্রতিবছর আমরা বিজয় দিবস পালন করি শুধু বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়। এ বিজয়কে সত্যিকার অর্থে কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।
ধন্যবাদ ধানশালিক পরিবারকে
Reply