মোহমিলন
এ আই জাজাকী
তখন আমি নিউ ইয়র্কে থাকতাম। পড়তাম স্ট্যান্ডার্ড ফাইভে। বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। অভিনয়ের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল খুব বেশি। ছোট ছেলেমেয়েরা নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে কাজ করত দেখে আমারও শখ ছিল টিভিতে কাজ করার। উন্নত স্কুল হওয়ায় সম্পূর্ণ পাঠদান কার্যক্রমই ছিল মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমের। একদিন কালচারাল টিচার এসে ডিসপ্লেতে একটি বিজ্ঞাপন দেখাল। যেখানে একটি টিভিসির জন্য শিশু চাওয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল শিশুটির চেহারা ও বাচনভঙ্গি হতে হবে আকর্ষণীয় ও সাবলীল। যেহেতু এ সবগুলো গুণই আমার মধ্যে ছিল তাই আমি দাঁড়িয়ে বললাম, টিচার আমি কাজ করতে চাই। টিচার একটু হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। ক্লাস শেষে আমার ডেস্কে এসে দেখা করে যেও। এমনিতেই এ টিচার ক্লাসের ছেলেদের খুব কেয়ার করতেন। এবং সবচেয়ে বেশি কেয়ার করতেন আমিসহ আরও দু-চার জনকে, যাদের চেহারা একটু বেশি কিউট। তবে টিচার আমাকে সবার চাইতে আরেকটু বেশিই কেয়ার বা আদর করতেন সেটা বুঝতে পারতাম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই আমার নাম নিয়ে এটা সেটা বলতেন। আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতেন। হাঁটাচ্ছলে আমার গালে চিমটি কেটে দিতেন। আমার রাহুল কাটিং রেশমি চুলে বিলি কেটে দিতেন। এবং তা তিনি খুব কৌশলেই করতেন। যাতে অন্যদের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায়। সেটা আবার আমার চোখে ধরা পড়ত। তবে অন্য কেউ যে তা খেয়াল করত না তা নয়। আমার দু-একজন বন্ধু কয়েকবার বলেছেও যে এ টিচার আমাকে বেশি আদর করে। উত্তরে আমি কিছু বলতাম না। কারণ আমিও এটা জানতাম। তবে এ আদর বা কেয়ারিংটাকে আমি নেহায়েৎ টিচারের আদরই মনে করতাম। এ আদরের পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে তা আমার মাথায় কখনোই আসত না। তাছাড়া সেই বয়সে অন্য কিছু মাথায় আসার কথাও না।
যথারীতি সেদিন ক্লাস শেষে কালচারাল টিচারের ডেস্কে গেলাম। টিচার তার সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে বসতে বললেন। টিচার একটা ফাইলে কী যেন লিখছিলেন। তবে তিনি খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন তা বুঝতে পারছিলাম। টিচার বললেন, তুমি একটু বসো, আমি হাতের কাজটা সেরে নিই। তোমার কিছু স্ন্যাপ নিতে হবে। আমিও চেয়ারে বসে দুই পা দোলাতে লাগলাম। আমি সবসময়েই একটু চটপটে স্বভাবের। তবে কারও সামনে পা দোলানো যে বেয়াদবি তা আরও বড় হয়ে বুঝেছিলাম। টিচার লেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। আমিও টিচারের দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম। এরই মাঝে ছুটির ঘণ্টা পড়ে যায়। টিচারের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেমেয়েগুলো লাইন ধরে বের হচ্ছে আর দু’জন সিকিউরিটি একে একে তাদেরকে স্কুলবাসে অথবা ড্রাইভারের হাতে তুলে দিচ্ছে। এদিকে রুমের সবগুলো ডেস্ক খালি হয়ে গেছে। সব টিচারেরা বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। রুমে শুধু আমি আর কালচারাল টিচার। জানালা দিয়ে আবার নিচে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের লাল গাড়িটা দাঁড়ানো। বাবা প্রতিদিন আমাকে স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠায়। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই স্কুলবাসে চড়ে যাওয়া-আসা করে। শুধু আমার বাবার মতো অতি কেয়ারিং বাবারা কয়েকজন তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য গাড়ি পাঠায়। আমি বললাম, টিচার নিচে আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টিচার এবার ফাইলটা রেখে উনার দামি আইফোনটা বের করলেন। আমাকে পজিশনে বসিয়ে একটি ছবি নিলেন। তারপর তিনি আমার দিকে এসে বললেন, বাঁকা হয়ে বসেছো ডিয়ার সান। তারপর আমার বাহুতে ধরে একটু সোজা করার ভঙ্গি করলেন। আমার মনে হলো টিচার আমার দুই বাহুতে তার হাতে চাপ দিলেন। তিনি আবারও একটা ছবি নিয়ে বললেন, তুমি আবারও বাঁকা হয়ে বসেছো ডিয়ার। তিনি আবার এসে আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, এভাবে বসো ডিয়ার সান, এভাবে। আমার মনে হচ্ছিল আমি সোজা হয়েই বসেছিলাম। তারপরও আমি সোজা হয়ে বসার ভঙ্গি করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম টিচার আবারও আমাকে চুমো খাওয়ার জন্য দু’হাতে আমার গালে চেপে তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রুমের দরজায় এসে বাইন্ডার আঙ্কেল দাঁড়ালেন। টিচার চুমো না খেয়ে আমার ঘাড় সোজা করার ভঙ্গিতে বললেন, এভাবে থাকো ডিয়ার সান। বাইন্ডার আঙ্কেল বললেন, স্যার বের হবে না? দরজা লক করব। ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। টিচার বললেন, হ্যাঁ এখনই বের হব। তুমি একটু নিচে গিয়ে আদির ড্রাইভারকে বলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। বাইন্ডার আঙ্কেল চলে গেলে টিচার যেন পাগল হয়ে ওঠলেন। আমাকে জোরে তার বুকে চেপে ধরলেন। উনার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে আমি কিছু আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমি গুড টাচ্ এবং ব্যাড টাচ্ সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলাম। আমার আম্মু অনেক আগেই আমাকে টাচ্ সম্পর্কে শিখিয়েছিল। আমি নিজেকে টিচারের বুক ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। টিচার যেন আরও উন্মত্ত হয়ে গেলেন। আমাকে তো ছাড়ছেনই না বরং আরও জোরে বুকে চেপে পিঠ চাপড়াতে থাকলেন। জোর করে আমার গালে আর কপালে অনেকগুলো চুমো খেলেন। হঠাৎ টিচারের হাত আমার নিতম্বে চলে গেল। সেখানেও তিনি চাপ দিতে লাগলেন। আমি এবার আর সহ্য করতে না পেরে সিকিউরিটি আঙ্কেল বলে চিৎকার করলাম। টিচার আমাকে ছেড়ে দিয়ে গালে একটা চড় মারলেন। আমি কোনো কথা না বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। চোখ ফেটে পানি বের হতে চাচ্ছিল। অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি। গেইট দিয়ে বের হয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ড্রাইভার তার আসনেই বসেছিল। আমি সবসময় ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি কিন্তু আজ পেছনের সিটে বসলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী ছোট সাহেব আজ পেছনে বসলেন যে? আমি বললাম, এমনি। ড্রাইভার বলল, বাইন্ডার জানাল আপনার নাকি কিছুক্ষণ দেরি হবে, তাহলে এত দ্রুত চলে আসলেন কীভাবে? আমি তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, যান। গাড়িতে বসে আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। শ্রাবণের ধারার মতো অঝোরে চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। ড্রাইভারকে বললাম, আঙ্কেল সামনে থেকে টিস্যু বক্সটা দিন তো। ড্রাইভার গাড়িটা রাস্তার পাশে থামিয়ে টিস্যু বক্সটা আমাকে দিয়ে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো আঙ্কেল? আমি কিছুই বললাম না। সে আবারও জানতে চাইলে আমি একটু রেগেই বললাম, আপনি গাড়ি চালান তো।
বাসায় ফিরে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলাম। আম্মু কারণ জানতে চাইলে বললাম, কালচারাল টিচার মেরেছে। অ্যামেরিকার আইনে শিশুদের গায়ে হাত তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। আম্মু এটা শুনে তো রেগে আগুন। আম্মু বলল, তোমাকে টিচার কেন মেরেছে? আমি সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললাম। রাগে আম্মুর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। আম্মু আর কিছুই জানতে চাইল না। আমাকে খাইয়ে সাথে সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় কী কী করল আমি কিছুই জানি না। পরদিন থেকে নতুন আরেকজন কালচারাল টিচার আমাদের ক্লাস নিত। কিন্তু টিচার ওইদিন কেন এমন করেছিল সেটা আমি এখন খুব পরিষ্কারভাবে বুঝি। সত্যিকার অর্থে, সেই টিচার ছিলেন ‘পেডোফিলিয়া’ নামক এক ভয়ানক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। যদিও এটিকে অনেক মনোবিদরা ‘ন্যাচারাল ইনফ্রাকশন’ বলে থাকেন। সেই হিসেবে কালচারাল টিচার দোষী ছিল না। তবে অতিসভ্য এ সমাজের কাছে কোনো পুরুষের এ ব্যবহার চরম ঘৃণার, নিন্দার এবং লজ্জার।