ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন
[গত সংখ্যার পর]
বহুদিন ধরে ট্রেনে চড়া হয় না। সেই যে কবে ট্রেনে সিলেট গিয়েছিলাম, তা ভুলেই গিয়েছি। মুক্ত জীবন পেয়েও যদি অবহেলা করি, তা বড় অন্যায় হয়ে যাবে। শালবনে আসার সুযোগ যখন হাতে এল, তখন ঠিক করলাম, এবার ট্রেনে চড়ার ইচ্ছে পূরণ করব। শেষ রাতের ট্রেনে চড়ে সকালে এই স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। সবুজের সমারোহে সাজানো গোছানো ভাওয়াল শাল-গজারি বন। ট্রেন চলে যাবার পর স্টেশনটি আগের মতো শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আশেপাশে মানুষজনের তেমন দেখা নেই। বনের পথ দিয়ে হাঁটছি। এ বনের ভেতর আমার দাদাজানের বাংলো বাড়ি।
স্টেশনে একজনের আসার কথা ছিল, তিনি বাংলোবাড়ির কেয়ারটেকার। আব্বুর কাছ থেকে লোকটার চেহারার বর্ণনা শুনেছি। স্টেশনের আশপাশে তাকিয়ে আমি তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। অপেক্ষা না করে আব্বুর দেয়া ঠিকানা ও কিছু ল্যা- মার্ক অনুসরণ করে দাদাজানের বাড়িটি খুঁজতে লাগলাম।
দাদাজানকে আমি স্বচক্ষে কখনো দেখিনি। তাঁর মৃত্যুর পর আজই প্রথম এ বাড়িতে যাচ্ছি। দীর্ঘ সতের বছর ধরে নির্জন পড়ে আছে বাড়িটি। একজন কেয়ারটেকার যিনি আছে, তার দায়িত্ব শুধু রাতে পাহারা দেয়া। আব্বুর কাছে শুনেছি, দোতলা বাড়িটির নিচ তলার একটি ঘওে রাতে এসে লোকটা থাকে। তার বাড়ি পাশের গ্রামেই।
অবশেষে বাড়িটি খুঁজে পেলাম। বাড়ির সামনের বুনো বাগান পেরিয়ে টিনের বেড়ার গেট টেনে ভেতরে ঢুকলাম। উঠোন ভর্তি ঘাস, শরতের শিশির বিন্দু প্রতিটি ঘাসের ডগায় স্থির। সূর্যালোক এখনও ওদের গায়ে আঁচড় কাটেনি। সামনে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল দূরে ছোট্ট একটি নাম না জানা লিকলিকে সাপ, সামনের দিকে ছুটছে। হয়তো টিনের শব্দে ভয় পেয়েছে তাই পালিয়ে যাচ্ছে। সাপের আতঙ্ক আমার মধ্যে নেই। তাছাড়া ব্যাগে তো কার্বলিক এসিড আছেই, এখানে থাকার প্রস্তুতি হিসেবে নিয়ে এসেছি।
সুনসান নিরবতা। ঘড়িতে দেখলাম ভোর ছয়টা বাজে। কেয়ারটেকারকে কল দিলাম। ঘরের ভেতর কল বাজছে শুনতে পেলাম। লোকটা এখনো ঘুমাচ্ছে। অথচ গতরাতে কথা হয়েছিল, আমাকে ভোরে স্টেশন থেকে এগিয়ে নিতে আসবে। কল বেজেই চলেছে, লোকটার ঘুম এত গভীর? দু’তিন বার কল দেবার পর রিসিভ করল।
আমিই প্রথম কথা বললাম, হ্যালো, এখনো ঘুমাচ্ছো? আমি তোমার ঘরের সামনে।
কী বলেন, স্যার। আমি উঠতাছি।
লোকটা হন্তদন্ত হয়ে দরোজা খুলে বাইরে এল। স্টেশনে যেতে পারেনি বলে, তার আফসোসের শেষ নেই। আমি তাকে থামিয়ে বললাম, দোতলার ঘরগুলো ঠিক আছে?
লোকটা আমতা আমতা শুরু করল। ইয়ে, মানে, পরিষ্কার করা হয়নি।
কেন? আমি খানিকটা অবাক হয়ে সামান্য উত্তেজনা প্রকাশ করলাম।
লোকটা বলল, বড় তালাটা খুলতে পারিনি স্যার। অনেক চেষ্টা করেছি, সম্ভব হয়নি। জং ধরে এমনভাবে আটকায়া আছে, চাবি পর্যন্ত বাঁকা হইয়া গেছে। অনেক বছর ধইরা খোলা হয় না, তো।
আচ্ছা, তোমার নাম কী?
মিজানুর আলী। সবাই মিজান মিয়া কইয়া ডাকে।
মিজান মিয়ার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে বলে মনে হয়। তার চোখে-মুখে এখনো রাতের ঘুম লেগে আছে। বোধ করি সে আরো কয়েক ঘণ্টা পর ঘুম থেকে জাগত। আমি চলে আসাতেই সেই রুটিনে ব্যাঘাত ঘটেছে।
আমি বললাম, মিজান মিয়া, তালাটা খোলা সম্ভব না হলে ভেঙে ফেলো।
স্যার, গতকালকেই, ভাঙতে চাইছিলাম। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা কইরা ভাঙ্গি নাই।
মিজান মিয়ার কথার প্রতি আমার ততটা আগ্রহ ছিল না। অন্যকিছু জিজ্ঞেস না করেই বললাম, যতদ্রুত সম্ভব তালাটা ভেঙে ফেলো, আমার থাকার পরিবেশ তৈরি করো। ততক্ষণে আমি বাইরে থেকে এক কাপ চা, খেয়ে আসি।
বাইরে যাবার আগে অল্পসময়ের জন্য উপরে গেলাম। দু’তলায় তিনটে ঘর। আব্বুর মুখে শুনেছি, একেবারে দক্ষিণপাশের ঘরটিতে দাদাজান থাকতেন। পাশের ঘরদুটিতে কিছু ভাঙা চেয়ার-টেবিল ও কাঠ ধূলি অন্ধকারে ভরে আছে। পুরো উপরতলায় একটিবার দৃষ্টি ফেলে বাড়ি থেকে বের হলাম।
বনের পথ পেরিয়ে কিছুটা দূরে চায়ের দোকান, সেখানে বসে চা খেলাম। মক্তবে আরবি পড়তে আসা এলাকার ছেলে-ছোকরারা খানিকটা দূরে জটলা বেঁধে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামে একটি অপরিচিত মুখ দেখে ওদের মধ্যে কৌতূহলের উদ্রেক হচ্ছে। কিংবা আমার পরিহিত প্যান্ট-শার্ট, কোট অথবা দামি জুতোজোড়া আগ্রহ নিয়ে দেখছে। হয়তো ভাবছে লোকটা কোথাকার কে? তবে সাহস সঞ্চয় করে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে আসেনি। বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার দাদাজানের বাড়ি, যে বাড়িটির বর্তমান মালিক আমি। বাড়িটি তিনি আমাকে কেন লিখে দিলেন, তা আমি জানি না। সঙ্গত কারণেই, এ লেখায় দাদাজানের নাম উহ্য রাখছি। বলে রাখা ভাল, তিনি এ দেশের একজন স্বনামধন্য গণিতবিদ। সারাজীবন কাটিয়েছেন গণিতের সাধনা-সমাধান করে। বীজগাণিতিক রাশি নিয়ে তিনি নতুন কিছু ধারণাও দিয়েছেন। দিনরাত দিস্তার পর দিস্তা খাতা জুড়ে কেবল অঙ্ক কষেছেন। দাদাজানের লেখা গাণিতিক গ্রন্থ দেশে-বিদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ঢাকা শহরে তাঁর নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেছিল এক প্রকাশনা কোম্পানি। তিনি তা গ্রহণ করলেও, সেখানে কখনো বসবাস করেননি। নিরিবিলি পরিবেশ তাঁর পছন্দ, একা থাকার উদ্দেশ্যে শালবনের ভেতর এই বাড়িটি কিনেছিলেন। দাদাজান সারাজীবন খাপছাড়া জীবন যাপন করেছেন, চিরকুমার থেকেছেন। কেউ কেউ বলে কিশোর বয়সে তিনি একটি প্রেম করেছিলেন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়, তারপর দাদাজান পরিবার ছেড়ে দেশান্তরী হন। বছর দুয়েক পর ফিরে এসে জানতে পারেন, মেয়েটি বসন্ত রোগে মারা গেছে। এ কথা শুনে হাউ মাউ করে কেঁদেছিলেন। তারপর আবার নিরুদ্দেশ। দাদাজান তাঁর বাবা-মার মৃত্যুর সময়ও উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর বয়স যখন ত্রিশ বছর, তখন তিনি আমার আব্বুকে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন। তখন তিনি থাকতেন পদ্মার পাড়ে একটি ভাড়া বাড়িতে। আব্বু কিছুটা বড় হবার পর, দাদাজান তাকে শহরে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য। প্রকাশনা কোম্পানির দেয়া ফ্ল্যাটটিই তখন থেকে আব্বুর ঠিকানা। এদিকে তিনি পদ্মার পাড়ে একাগ্র চিত্তে গণিত সাধনায় মনোনিবেশ করেন।
আব্বু কখনো কখনো পিতৃস্নেহ পাবার আশায় দাদাজানের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দাদাজান তা স্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করতেন। কারণ হিসেবে বলতেন, বিরক্তিবোধ করেন। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কাজ করলে, বরাবরই রাগারাগি করতেন। শালবনের ভেতর এ বাড়িটি তিনি কিনে রেখেছিলেন অনেক আগে, একদিন হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে স্থানান্তরিত হলেন। অনেকদিন ধরে এখানে তিনি নির্জন বাস করে যাচ্ছিলেন। আব্বু দেখা করতে এলে, সামান্য সময় কাটিয়ে ভেতরে চলে যেতেন। বুড়ো বয়সে একটা সময় তাঁর মধ্যে খিটখিটে মেজাজও তৈরি হয়। যাক সে কথা, পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে চলে এলাম।
মিজান মিয়া দোতলার দক্ষিণপাশের ঘরের তালা ভাঙছে, শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি অবাক হলাম, একটা তালা ভাঙতে এত সময় লাগে? তড়িধড়ি দোতলায় ওঠলাম। আমাকে দেখেই মিজান মিয়া হলদেটে দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, প্রায় শেষ স্যার।
সত্যিই হাতুড়ি দিয়ে কয়েকটা আঘাত করতেই তালাটা ভেঙে গেল। মিজান মিয়াই প্রথম ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। দাদাজানের মৃত্যুর পর এই প্রথম তাঁর ঘরে এলাম। হাতব্যাগটা টেবিলে রেখে, মোবাইল ফোনে টর্চের আলো জ্বেলে ঘরটাতে চোখ বুলালাম। পুরো ঘর অন্ধকার, মাকড়সার জাল, কালি-ঝুলিতে ভরপুর, মরিচা ধরা দরোজা-জানালা বন্ধ, চেয়ার-টেবিলে দু’ইঞ্চি পরিমাণ ধূলির স্তর জমে আছে। সেই সাথে ঘর জুড়ে একটা ভোঁটকা পুরনো ধাঁচের গন্ধ! আলমারিগুলোর দরোজা বন্ধ, সেখানে নিশ্চয়ই বই-খাতাগুলো ঠাসাঠাসি করে রাখা। আমার পক্ষে বেশিক্ষণ ঘরটিতে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। দ্রুত হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। টেবিলের সামান্য ধূলির আস্তরণ হাতব্যাগের নিচের দিকটা দখল করে নিয়েছে। মিজান মিয়া সেটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিলো।
মিজান মিয়াকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, বাজার থেকে একটি তালা কিনে আনো, তারপর ঘরটি আগের মতো বন্ধ করে রাখো। আমি আপাতত নিচতলায় তোমার ঘরটিতে থাকব। আর এ কয়েকদিন তোমাকে রাতের বেলা পাহারা দেবার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে গিয়ে থাকবে, দিনের বেলা এখানে ডিউটি করবে।
এ বাড়িটিতে আসার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। দাদাজানের উইল করা দলিল কিছুদিন আগে আমাদের হাতে পৌঁছে, তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে। দাদাজানের মৃত্যু সংবাদ আমরা প্রথম জানতে পারি মিডিয়ার নিউজ দেখে। কারণ দাদাজানের সাথে আমাদের কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল না। তিনি মোবাইল ব্যবহার করেননি, চিঠি পাঠালে খুলেও দেখতেন না। কারো সাথে সাক্ষাত করার আগ্রহ তাঁর ছিল না, আব্বুকে অনেকবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। উইলটি দেখে আব্বু কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, তোর দাদাজান তোকে কোনোদিন দেখেনি, অথচ শেষ সম্বলটুকু তোকেই দিয়ে গেল। একটিবারের জন্য বাড়িটির অবস্থা দেখে আয়। স্মৃতি বলতে শুধু এ বাড়িটিই রয়েছে, তাঁর একটি ফটোগ্রাফ পর্যন্ত নেই। যা, বাবা। একটু ঘুরে ফিরে দেখে আয়।
দাদাজানের মৃত্যুর পর আব্বু মাত্র একবার এ বাড়িতে আসে। কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে যায়। পরবর্তীতে আসতে চাইলেও, আম্মুর বারণ ছিল। আম্মু বলত, বাড়িটা ভুতুড়ে ধরনের, ওখানে না যাওয়াই ভাল। যদিও আম্মু কখনো এ বাড়িটি দেখেনি। আব্বু ভুতুড়ে বিষয় একদম বিশ্বাস করত না। কিন্তু আম্মুর নিষেধাজ্ঞাকেও আগ্রাহ্য করতে পারেনি। কারণ আম্মু বহু বছর ধরে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায়। উইলটা হাতে পাবার পর আব্বু আমাকে অনেকটা জোর করে এখানে পাঠিয়েছে। আমিও আব্বুর কথা ফেলতে পারিনি।
দুপুরে রেলস্টেশনের একটি হোটেলে লাঞ্চ করলাম। তারপর শেষ বিকেল অবধি বন্যপথে ঘুরে বেড়ালাম। রাতে মিজান মিয়া রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করল। আমি রাতের খাবার দেরিতে খাই বলে, তাকে সন্ধ্যা রাতেই বিদায় দিলাম। রাত এগারোটায় খাবার খেয়ে নিলাম। ভাবলাম জামা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমুতে যাব। গতরাতে ট্রেনে অবশ্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। ঘুমিয়েছি দু’ঘণ্টা। সাধারণত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার দু’আড়াই, সর্বোচ্চ চার ঘণ্টার বেশি ঘুম হয় না। তবে আজ সারাদিনের একটা ক্লান্তি জড়িয়ে রেখেছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম। কখন লোডশেডিং হলো জানি না। মাঝ রাতে উপর তলার ঘরে কিছু একটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে আমার প্রচ- যন্ত্রণা হয়। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। দোতলার ঘরটায় ক্রমাগত চেয়ার-টেবিল নড়াচড়ার মতো শব্দ হচ্ছে। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমায়। বিরক্ত হয়ে মোবাইল ফোনের টর্চটা জ্বেলে উপরে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙে করিডোরে পা দিতেই স্পষ্ট দেখলাম, দেয়ালের দিকে কারোর ছায়া দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমাকে দেখে কেউ সাবধান হয়ে গেল। আমি নির্বিঘেœ সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, শব্দটার উৎস খোঁজার জন্য কান খাড়া রেখেছি। না, চারপাশ এখন স্তব্ধ! রাতের স্বাভাবিক নিরবতা।
ছায়াটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। হাতেনাতে চোর ধরার ইচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার মনে উঁকি দিচ্ছিল। নিঃশব্দে পা ফেলে করিডোর ক্রস করে সোজা দাদাজানের ঘরের কাছে গেলাম। মিজান মিয়া ঘরের দরোজায় নতুন একটি তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হলো, এ ঘরটাই ঐ বিশ্রী শব্দের উৎস। চোরের কথা মনে করে ভাবলাম, ঘরটাতে প্রবেশের একটাই উপায় তালা ভেঙে ভেতরে যাওয়া। দরোজায় তালা ঝুলতে দেখে চোর সংক্রান্ত সন্দেহ দূর হলেও, একবার ইচ্ছে হলো জানালা দিয়ে চোখ বুলাই। আমি টর্চের আলো ফেলে ভেতরে তাকালাম। কেউ নেই। দেখলাম, দিনের বেলার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা আর আগের মতো নেই, এখন পুরো ঘরটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বুঝতে বাকি রইল না, এটা কেয়ারটেকার মিজান মিয়ারই কাজ। বিকেলে সে চুপি চুপি ঘরটা ধুয়ে-মুছে গুছিয়ে রেখেছে। হয়তো বাইরে থাকতে তার অসুবিধা, তাই এ ঘরটা প্রস্তুত করে আমাকে এখানে পাঠাতে চায়। এছাড়া উপায় কি! হুট করে তার ঘরটা দখল করে বসেছি, বেচারা সইতেও পারছে না কিছু বলতেও পারছে না। ছায়া ভাবনা ও চোর ধরার অ্যাডভেঞ্চার ইচ্ছা আমার মনে বেশিক্ষণ টিকল না। যাক, এবার ঘুমুতে যাওয়া দরকার। হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো বাজে।
অবাক করা ব্যাপার, হঠাৎ অত্যধিক গরম অনুভূত হচ্ছে। সারা গা বেয়ে দর দর ঘাম ঝরছে। দ্রুত নিচে নেমে এলাম। ঘুমানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। মনে হচ্ছিল পুরো বাড়িটা গরমে ফেঁপে ওঠেছে। তড়িধড়ি কলতলায় গিয়ে ইচ্ছে মতো গায়ে পানি ঢাললাম। অনেকটা প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। গোসল শেষে মনে পড়ল, এখনো ব্রিফকেস খোলা হয়নি, জামা-কাপড় ওটার ভেতরেই। ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢুকে ব্রিফকেস খুলতে গেলাম। তখনই আবিষ্কার করলাম চাবিটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছি।
নিজের প্রতি প্রচ- বিরক্তি তৈরি হলেও শান্ত হয়ে বসে আছি। শুধু একবার ভাবলাম, আলসেমির কারণে বিকেলে জামা চেঞ্জ করা হয়নি, হয়তো আরো আগেই জানতে পারতাম, চাবিটা হারিয়ে গেছে। তখন মিজান মিয়াই একটা উপায় করে ফেলত। কাল সকালে মিজান মিয়া এলে বলব ব্রিফকেসটা ভাঙতে হবে, এছাড়া জামা-কাপড় বের করার কোনো উপায় নেই।
বিদ্যুৎ চলে এল। ঘরের বাতি জ্বেলে দিলাম, ফ্যানের সুইচটা আগেই অন করা ছিল। ভগ্নমনে ভেজা কাপড়েই শুয়ে পড়লাম। ঠা-া মাথায় ভাবতে লাগলাম চাবিটা কোথায় হারিয়েছি। ট্রেনে একবার ব্রিফকেস খুলে আপেল খেয়েছিলাম, তারপর চাবিটা ঠিকঠাক মতো পকেটেই রেখেছি। এখানে পৌঁছার পর চায়ের দোকানে যাওয়া হয়েছে, টাকা বের করার সময় দেখেছি তখনও চাবিটা পকেটেই। বাড়িতে আসার পর মিজান মিয়াকে দিয়ে তালা ভাঙানোর কথা মনে পড়ল। যতদূর মনে পড়ে দাদাজানের ঘরে গিয়ে হাতব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেছি, মানিব্যাগ বের করে মিজানকে টাকা দিয়েছি নতুন তালা কেনার জন্য। তখন চাবিটা কি টেবিলের উপর হাতব্যাগের পাশে রেখেছি? হয়তো।
আচ্ছা, একবার উপরতলাটা দেখে এলে কেমন হয়?
বিছানা ছেড়ে উপরে দাদাজানের ঘরের কাছে গেলাম। টর্চ জ্বেলে জানালাটা খুলতেই দেখলাম, চাবিটা টেবিলের উপরে। চাবির পাশেই চোখে পড়ল, লাল বর্ডারের একটি ডায়েরি, যার মাঝখান থেকে পাতা খোলা। কেউ যেন চেয়ারের বসে ডায়েরিটা পড়ছে বা কিছু লিখছে। খানিকটা খটকা লাগল, এক ঘণ্টা আগেও এ ঘরটা দেখে গেলাম। তখন টেবিলের উপর তেমন কিছু চোখে পড়েনি, চাবির রিং ক্ষুদ্র বলে অগোচরে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ডায়েরিটা এলো কোত্থেকে? এটা আপনা আপনি হতে পারে না, নিশ্চয়ই ঘরে কেউ আছে। চিৎকার করে ওঠলাম, কে আছিস ঘরে? কী চাস এখানে?
আমার চিৎকারের কোনো সাড়া নেই। বরং দূর থেকে আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিই ফিরে এল। ভাবলাম, যেহেতু মিজান মিয়ার কাছে এ ঘরের চাবি, সে না এলে তালা খোলা সম্ভব না। সুতরাং ফিরে যাওয়াই ভাল। ফিরে এসে ঘুমালাম।
ঘুম থেকে জাগলাম বেলা নয়টায়। ওঠে বসলাম, কিন্তু ঘুম ভাঙা ক্লান্তি আমাকে জাপটে ধরে আছে। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন এখনো চোখ থেকে সরাতে পারছি না। আমি দাদাজানকে সরাসরি কোনোদিন দেখিনি বটে, তবে আব্বুর বর্ণনা ও পত্রিকায় ছাপা রিপোর্ট থেকে মনের ভেতর কল্পনার রঙ তুলিতে একটি ছবি এঁকে রেখেছি। লম্বা চুল, সাদা দাড়িতে ভরা মুখ, চোখে চশমা, কপালে চিন্তাশীল ভাঁজ, দার্শনিক প্রজ্ঞাবান ভাব। ভাবনার সে মানুষটাই স্বপ্নে দেখা দিলো। সমকোনী ত্রিভূজের মতো চেয়ারে বসে একটানা অঙ্ক কষে চলেছেন। সংখ্যাগুলো পরিচিত হলেও অঙ্কের কোনো ফর্মূলা আমার মাথায় ঢুকছে না। দাদাজান দিস্তার পর দিস্তা খাতায় লিখে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যাখ্যাহীন লেখার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। দাদাজান হেসে কাছে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। বললেন, তোর চোখ দেখেই বুঝেছি জটিল গাণিতিক লেখাগুলো তোকে কৌতূহলের দরিয়ায় ফেলে দিয়েছে। তাই না?
আমি কিছুই বললাম না, দাদাজানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
সোম, এটা হলো ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক জগতের গোপন সূত্র। এ জগতগুলোর রয়েছে নিজস্ব কিছু সমীকরণ, যা সমাধান করার জন্য প্রয়োজন এই ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। এ ফর্মূলা ভেদ করতে পারলে একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক জগতের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। এমনকি সময় ভ্রমণকারীরা এক জগত থেকে অন্য জগতে সফলভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
আমাকে চুপচাপ দেখে দাদাজান বললেন, একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবি। কিন্তু সে মনোযোগ দেয়া আর সম্ভব হয়নি। ঘুম ভেঙে গেল। যতদূর জানি স্বপ্ন মানুষের অবচেতন মস্তিষ্কের কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। তদ্রুপ আজকের এ স্বপ্নটাও আমার দীর্ঘক্ষণ গাণিতিক বিষয় ও দাদাজানকে নিয়ে ভাবনার ফসল।
ততক্ষণে মিজান মিয়া চলে এসেছে। তাকে দেখেই আমি ভেজা বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম।
দ্রুত, চলো উপর তলায়।
আমার কথা শুনে মিজান মিয়া হকচকিয়ে গেল।
কেন? কী হয়েছে?
আরে, গতকাল ওখানে চাবি ফেলে এসেছি।
মিজান মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে উপর তলায় এল। দাদাজানের ঘরের দরোজা খুলতেই ভেতরে ঢুকলাম। টেবিলের উপর থেকে চাবিটা তুলে নিলাম বটে, কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে আমি চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘরটি সেই আগের মতো অন্ধকার, ধূলি-কালিতে ভরপুরই আছে। তাহলে গতরাতে যা দেখলাম তা কি মিথ্যে?
না, আমার সেন্স তো ঠিক আছে। যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। টেবিলের উপর একটা ডায়েরি দেখেছিলাম, কোথায় সে ডায়েরি? না, নেই। কিছুই তো নেই। লাল বর্ডারের ডায়েরিটা কি কেউ সরিয়ে ফেলেছে। চুরি হয়ে যায়নি তো?
পুরো ঘরটা ভালভাবে ঘুরে দেখলাম। একটি মাত্র দরোজা, দুটি জানালা। এখানে দরোজা ভাঙা ব্যতীত কারোর প্রবেশ বা প্রস্থান কোনোটাই সম্ভব নয়। যুক্তি দিয়ে কিছুই মেলাতে পারছি না। ঘর পরিচ্ছন্ন হবার ঘটনাটি যদি চোখের ভ্রম হিসেবে ধরে নিতে পারি, তবে ডায়েরির আবির্ভাব ও উধাও হওয়ার ঘটনাটি রহস্যজনক। ডায়েরিটি এখানে আগে থেকে ছিল না, এখনও নেই। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মিজান মিয়ার উপর আমার সন্দেহ হলো। সন্দেহটা প্রকাশ না করে বললাম, দ্রুত দাদাজানের ঘরটা পরিষ্কার করো। মিজান মিয়া আরো দু’জন লোক নিয়ে এসে কাজ শুরু করল। দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারকি করলাম। তারপর ঘরে তালা আটকিয়ে চাবিটা আমার পকেটে রাখলাম।
[চলবে...]