সিরাজউদ্দৌলা
জাকি হোসেন কামাল
মুজিব বাইয়া যাওরে
নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগনের নাওরে
মুজিব বাইয়া যাওরে।
উর্মি গাইছে নিবিষ্ট মনে। মেয়ের কন্ঠটা চমৎকার। মেয়ের গান শুনে কাছে এসে বসলো মিতা। মায়ের মতই হয়েছে উর্মি। চঞ্চল, একরোখা। ক ‘দিন ধরেই উর্মি অস্থির। তাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আসবেন। কিভাবে তাঁকে বরণ করা হবে তার প্রস্তুতি চলছে স্কুলে। এই একটুকু মেয়েকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা দেয়া হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উর্মি গাইবে এই গান। এইটুকু মেয়ের কন্ঠে এই গান এই সুর। নিশ্চিত সবাই তন্ময় হয়ে শুনবেন। বঙ্গবন্ধুও নিশ্চয়ই খুশি হবেন। ভাবতে থাকে মিতা।
ভাবতে ভাবতে মিতা চলে যায় আরো ন ‘বছর আগের দিনগুলোতে। মিতা তখন ছবিঘরের সদস্য। পাকিস্তান কালচারাল একাডেমী ছেড়ে হাসনা আপা, টিপু ভাই, ফজল-এ- খুদা ভাই ও কামাল ভাইদের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ছবিঘর। ছবিঘরের পরিচালনায় দূর্বার চলছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এর মধ্যে হয়ে গেল একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সষ্টিটিউশান মিলনায়তেেন। অনুষ্ঠানটি সকল দর্শক শ্রোতার ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে কামাল ভাইয়ের নামও ছাপা হয়। তা দেখে কামাল ভাইয়ের বাবা অর্থাৎ মুজিব ভাই ছবিঘরের সদস্যদের দেখতে চান। তখন সবার মুখে মুখে মুজিব ভাই, আমাদের মুজিব ভাই। কামাল ভাইয়ের কাছে দেখা করার কথা শুনে সকলের মধ্যেই অস্থিরতা শুরু হয়। মিতারতো আর তর সইছেনা। কখন দেখা হবে মুজিব ভাইয়ের সাথে। তার দু ‘তিন দিনের মধ্যেই দেখা হয়েছিল মুজিব ভাইয়ের সাথে।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাসাতে, বসার ঘরে হৈ চৈ করে ঢুকতেই মুজিব ভাই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আয় আয় তোরা সব এসে গেছিস? তখন তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি যাও, আমি এখন ছবি সংঘের বন্ধুদের সাথে কথা বলবো। কামাল, তোর মাকে বল, নাস্তা দিতে। আগে খাওয়া দাওয়া, তারপরে কথা। মুজিব ভাইয়ের উষ্ণ অভিনন্দনে সকলেই অভিভুত।
ফজল ভাই বললেন আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি।
আরে দেখবি দেখবি, যখন তোদের জন্য কিছু করতে পারবো। এখনো কিছুই করতে পারিনি। কেবল ছয় দফা দিছি। দেখি কী হয়। মুজিব ভাইয়ের ঝটপট জবাব।
সেদিন কত কথা হয় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি সকলকে পেয়ে খুবই খুশি। মানুষকে এভাবে আপন করে নিতে পারে কেউ, কাছে থেকে না দেখলে বোঝার কোন উপায়ই নেই। সবাই যেন তার কতদিনের চেনা।
সেদিন একথা সেকথার পর মুজিব ভাই বললেন, তোরা নাচ করলি গান করলি, কিন্তু নাটক করলি না কেন? একটা অন্তত নাটক করা উচিৎ ছিল তোদের। নাটক করলে কথা বলার সাহস হয়। কথা প্রসঙ্গে মুজিব ভাই জানালেন, তিনি যখন ক্লাস সিক্সে পড়েন, সেসময় একবার ইন্সপেক্টরের তাঁদের স্কুল ভিজিটের কথা হয়। এ উপলক্ষে স্কুলে একটি অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা কে হবে? শেষ পর্যন্ত মাষ্টার মশাইরা কয়েকজনকে পরীক্ষা করে তাঁকে দিয়েই সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্সপেক্টর আসেনি। আর নাটকটিও মঞ্চস্থ হয়নি। মুজিব ভাই দুঃখ করে বললেন, আর আমারও সিরাজউদ্দৌলা হওয়া হলোনা। একথা শুনেই মিতা বলে ওঠে, মুজিব ভাই, তবুও আপনিই আমাদের সিরাজউদ্দৌলা। কথা শুনে মুজিব ভাই যেন কিছুটা থতমত খেলেন। পরক্ষণেই হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, তোরা দোয়া কর, সিরাজউদ্দৌলা নয়, আমি যেন তোদের মুজিব ভাই হয়েই থাকতে পারি। আমি সবার মুজিব ভাইই থাকতে চাই, বাংলার দুঃখি মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গী হতে চাই।
সেই মুজিব ভাই এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। সেদিনের সেই ঘটনার পর কতদিন চলে গেছে। মুজিব ভাইয়ের সাথে আর দেখা নেই। মিতারও ঘর সংসার হলো। মুজিব ভাইও ব্যাস্ত হয়ে গেলেন রাজনীতিতে। দেশ স্বাধীন হলো। মিতাও ব্যাস্ত থাকলো নিজেকে নিয়ে। এই ক ‘দিন মুজিব ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে মিতার। মুজিব ভাই, সকলের মুজিব ভাই, বাংলার সিরাজউদ্দৌলা।
মিতার আজ খুব করে মনে পড়ছে মুজিব ভাইয়ের কথা। খুব শীঘ্রই মুজিব ভাই উর্মিদের স্কুলে আসবেন। মিতা সিদ্ধান্ত নেয়, স্কুলের অনুষ্ঠানে সে নিজেও থাকবে। ঠিক সোজা গিয়ে দাঁড়াবে মুজিব ভাইয়ের সামনে, তার সিরাজউদ্দৌলার সামনে। নিশ্চয়ই মুজিব ভাই তাকে দেখেই চিনতে পারবেন। মিতা জেনেছে, মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি অনেক প্রখর। আচ্ছা, মুজিব ভাইয়ের সামনে যাওয়া যাবে তো? এখনতো মুজিব ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট। প্রটোকলের লোকজন তাকে কাছে যেতে দেবে তো? মিতা ভাবছে, নিশ্চয়ই দেবে। মিতা জেনেছে যে, মুজিব ভাই প্রটোকল মানেন না। সবার সাথে কথা বলেন তিনি। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মিতা। হঠাৎ গুলির শব্দে না কি লোকজনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় মিতার। মিতাকে বলছে নবাব, তুমি চলে যাও মিতা। ক্লাইভের সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। বিপদ এখন চারিদিকে। হুগলী, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদীপ ও পলাশীতে আমাদের সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের পথরোধ করেনি। সেনাপতিরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মিতা দেখছে হাজার হাজার সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসছে। এখানে ওখানে গোলার আঘাতে চিহ্নভিন্ন হচ্ছে চারিদিক। মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দূর্লভ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ সৈন্যদের প্রতিরোধ না করেই দাঁড়িয়ে আছে তাদের অধীনস্থ সৈন্যরা। ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমণ করছেন নবাবের দূর্গে, রাজধানীতে। একটি গোলা অগ্নিপিন্ডের মতো ধেয়ে আসছে মিতার দিকে। মিতা ওঠো- মামুনের চিৎকারে ঘুম ভাঙে মিতার। বুকটা ধড়পড় করছে মিতার।
মিতা ওঠো, বিপদ, দুঃসংবাদ ..। বলে যায় মামুন।
কী দুঃসংবাদ, বলো। স্বপ্নের রেশ কাটিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, রেডিওতে বলে যাচ্ছে এক মেজর।
কী বলো তুমি? চিৎকার করে ওঠে মিতা। তারপর চুপ হয়ে যায় মিতা। কোন কথা নেই। শুধু তার দু ‘চোখ বেয়ে নামে শ্রাবনের ধারা। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে মিতা। কেন মুজিব ভাইয়ের নাম দিলাম সিরাজউদ্দৌলা। মিতা নিজেকে খুনি ভাবে, ভাবে অপরাধী।