পেত্মী




পেত্মী
শফিক নহোর

বউরে আমি কালটি বলে ডাকতাম , এ ডাকটি ছিল তার কাছে বিষের মত। নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে মুখটা এমন কালো হয়ে যেত, মনে হত অমাবস্যার অন্ধকার রাত নেমে আসছে আকাশ থেকে তার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে যেত সহজে। ‘সাত সকালে ভূতের মুখ দেখে ঘুম ভাঙলে কি সেদিন ভাল যায় ?’ কপাল পোড়া হলে যা হয়, ঠিক আমার ও তাই। তবে ও হাসলে দাঁতগুলো খুব চকচক করত। ওরে কখনো আদর করতে ইচ্ছে হয়নি, ভালবাসতে ইচ্ছে হয়নি , কখনো আপন করে কাছে পেতে ইচ্ছে করেনি। ওকে ভাত খাবার কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি, ওকে ভালো কাপড় কিনে দিতে কখনো ইচ্ছে হয়নি কেন তা আমি নিজেই জানিনা । ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। পৃথিবীর সমস্ত ইচ্ছে মরে গিয়েছিল। কপালে এমন পেত্মী মার্কা একটা বউ পেলে কারো ইচ্ছা কি বেঁচে থাকে ?’ ফোন করলে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগত প্রচন্ড রাগ হত ; আমি খুব রাগ করে মাঝেমাঝে লাইন কেটে দিতাম। আনকালচার একটা মেয়ে অসহ্য ! অফিস থেকে ফিরে
বাসায় এসে খুব রাগ করতাম ; ‘অসভ্য কতবার ফোন দিতে হয় অফিসে থাকলে।’ বেয়াদব, অনেক বকাবকি করতাম।’ প্রতিদিন পেত্মী দেখতে দেখতে পৃথিবীটা পেত্মী মনে হত আমার কাছে ; চারিদিকে সুডৌল বক্ষ সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়াত, শালা আমার কপালে জুটেছে পেত্মী ।
‘কেমন বমি বমি লাগত বউ রে দেখলে ওয়াক থু।’
আমি ওকে বলেছিলাম ;
খবরদার আমার জন্য কখনো না খেয়ে থাকবি না। ফালতু কোথাকার ?’ যখন রান্না হবে ঠিক তখনই খেয়ে নিবি। আমার দিকে বেহায়ার মত তাকিয়ে থাকত, আমার সঙ্গে যদি খাবার চেষ্টা করিস তাহলে কিন্তু তোকে গলাটিপে মেরে ফেলবো। বলদটা সুন্দর করে হাসতে ও পারত না, সুন্দর করে কথা বলতে পারত না। এমন কী কোন সাহিত্য আড্ড, কবিতা পড়তেও তার অপছন্দ!’ কিছু লিখতে জানে না আজকাল মেয়েরা কত সুন্দর স্ট্যাটাস দেয় ফেসবুকে। সুন্দর করে কথাও বলতে পারে না। ‘গেঁয়ো ভূত কোথাকার।’ জামাকাপড় সুন্দর করে পড়তে পারে না। এমন কী অতিথি আসলে কিভাবে কথা বলতে হবে তাও জানেনা। কচু জানে ? কচু ! কার সামনে কি কথা বলতে হবে, পানির গ্লাস কিভাবে দিতে হবে জানেনা। বিরিয়ানি রান্না করতে পারেনা, পরোটা বানাতে পারেনা। জীবনটা তেজপাতা বানাইয়া ফেলছে ফালতু কোথাকার ?
পেত্মী জুটছে আমার কপালে। ‘আমার ইচ্ছে করে ওরে ফ্যানের সঙ্গে এমন ভাবে বান্দা ফাঁসি দেই। প্রতিদিন একবার করে ফাঁসি দিলেও আমার দুঃখ মিটবেনা। ওর তিনবার ফাঁসি দেয়া উচিত না ছয়বার ফাঁসি দেওয়া উচিত না, নয় বার ফাঁসি দেওয়া উচিত ?’ ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে যেত, অফিসের সময় হয়ে যাবার আগেই বাসা থেকে বের হতাম।



কখন কার সঙ্গে কথা বলতে হবে কী কথা বলতে হবে কিভাবে কথা বলতে হবে কিছুই বুঝতে পারেনা। বিভিন্ন সময় দেখতাম উদাসী হয়ে থাকত। রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকত একাকী, অপলক দৃষ্টিতে এক দিকে তাকায় থাকত, মনে হত প্রতিবন্ধী। দেখলে এত রাগ হত কখনো আমার কাছে আসতে দিতাম না। আমার জামাকাপড় পরিষ্কার করে দিয়েছিল ; সে সব আমি একদিন ফেলে দিয়েছি। জামাকাপড় গুলো আর কখনোই পড়া হয়নি। বাসায় গেস্ট আসলে কী খেতে দিবে, কিভাবে বসতে বলবে কিছুই জানেনা একেবারে গেঁয়োভূত প্রচন্ড রাগ হত। মা, মাঝেমধ্যে রাগ করে বলত,
মেয়েটির উপরের এমন করিস কেন ?’
কিছুদিন যেতে দে আমাদের বাড়ির পরিবেশ বুঝে উঠবে তখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আমার জীবনটা একেবারে বিষিয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে মনে হত ; আমি এখনই আত্মহত্যা করি। আমার কপালে তাই এরকম একটি পেত্মী বউ কোথাও নিয়ে যেতে পারতাম না আনস্মার্ট। বাবার বন্ধুর মেয়ে বলে জোর করে কিছু বলতে ও পারছিনা। মা বাবাকে বিশ্বাস করা আমার ঠিক হয়নি। তাঁরা এমন একটা মেয়ে আমার ঘায়ে চাপিয়ে দিল। এমন
মেয়ে কী এখন চলে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক হাই কোয়ালিটি দেশের বাহির থেকে পিএইচডি করছে; দেশের বাইরে নামি-দামি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে অনেক বড় পোস্টে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে?’
হঠাৎ একদিন আমার শরীর খারাপ করছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমার হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনে এমন চিৎকার করে ছুটে এসেছিল ; ‘চিৎকারের শব্দটা আমার বুকের ভিতর টুংটাং টুংটাং এখনো বাজে।’ আমি একা বাথরুমে যেতে পারতাম না আমাকে হেল্প করত, সারারাত আমার পাশে জেগে থাকত। আমি খুব বিরক্ত হতাম, দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁয়িয়ে থাকত, যাতে আমি কখনো যাতে বুঝতে না পারি। একদিন অনেক রাতে হঠাৎ দেখি ও আমার পাশে নেই। বুকের ভিতরে ধড়ফড় করতে লাগল। আমি ওর নাম ধরে ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়াল থেকে ছুটে আসলো। ওকে জড়িয়ে ধরে আমি সেদিন কেঁদে ছিলাম। আহারে! কালো মানুষটা, আনস্মার্ট মেয়েটা আমাকে এতো ভালবাসে, আমাকে এত টেককেয়ার করে আর আমি তাকে অবহেলা করি।

‘মিনু এত খুশি হয়ে ছিল আমার কপালে চুমু খাওয়ার অনুমতি নিয়ে ছিল, স্বামীর কপালে চুমু খেতে অনুমতি লাগে শিশুর মতন আমার বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়ল।’
তারপর একে একে অনেক কিছুই স্বাভাবিক হতে লাগলো আমরা রাতে দু’জন আলাদা বিছানায় থাকতাম তারপর থেকে আর কখনো আলাদা বিছানায় থাকনি একই সঙ্গে থাকা শুরু করি। মিনুকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম, ফেসবুক ব্যবহার করত, আমি কখনোই জানতে চাইতাম না। মানুষের এত সহজ সরল হওয়া ঠিক না যেমনটি মিনু, আমার পেত্মী বউটি। খুব ভালো মানুষ আমাকে এত ভালবাসে নিজেই বুঝতে পারতাম না। আমার পছন্দ অপছন্দ আমি কী খাই , না খাই আমার ভালো বন্ধু বান্ধবী সব লিস্ট করে রাখতো। তাদের জন্ম দিনে উইশ করতে, আমি জানতাম-ই না বন্ধু বান্ধবীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল আমার চেয়ে বেশি।
একদিন আমার বান্ধবী আমাকে ফোন দিয়ে বলছে,
তুই একটা আনস্মার্ট ছেলে তোর সঙ্গে কথা বলায় যায় না। তোর বউ এত স্মার্ট, কত সুন্দর করে কথা বলে। তুই এতো একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছিস। সত্যিই ভাবায় যায় না তোর বউ এত গোছালো এত রোমান্টিক এত ধর্মভীরু মানুষ এতো সুন্দর হয় তোর বউয়ের সঙ্গে না মিশলে বুঝতে পারতাম না।
মাঝেমধ্যে ও আমার পছন্দের খাবার রান্না করত, আমার জন্য শপিং করত, আমার বাবা মাকে খুব কেয়ার করত, বাবা মায়ের কাছে ও এতো জনপ্রিয় ছিল। আমার আপুরা ওকে সহ্য করতে পারতো না। মিনুকে নিয়ে এখন খুব গর্ব করতে ইচ্ছে করে। আমার একটা পেত্মী বউ আছে। এই পেত্মী—
বউটা আমার অহংকার।‘পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের একটা পেত্মী বউ থাকা দরকার।’



কোম্পানি থেকে আমাদের দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য দুইটা এয়ার টিকেট দিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরেই অফিসের কর্মকর্তা চাইছেন, আমি কোথাও থেকে ঘুরে আসি। স্যার আমার কাজে খুশি হয়ে সুইজারল্যান্ডের দুটি আপ-ডাউন টিকিট সহ ভিসা রেড়ি করে দিয়েছেন। বউকে রাতে খুশির সংবাদটা দিলাম। কিছুদিন অনেক আনন্দময় দিন কাটলো। যেদিন ফিরে আসবো এয়ারপোর্টে আসার সময় আমাদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হল তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই !
ক’য়েক বছর পর!

লীনা আমার কন্যা গায়ের রং ঠিক ওর মায়ের মত কালো। সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করে, আড়ালে আবডালে। লীনা সব কিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করে, আমাকে খুব যত্ম নেয়। মেয়েরা ঠিক মায়ের মত হয়।

আমার মেয়ে লীনা আমাকে খুব যত্ম করে। আমি কখন অফিস থেকে ফিরি, কী খাই, কখন ঘুমাতে যাই। লীনার মা বেঁচে থাকলে আমাকে হয়তো এত কিছু ভাবতে হত না। ক্ষণে-ক্ষণে মিনুকে খুব মনে পড়ে। বিয়ের প্রথম বছরে বিচ্ছিরি খারাপ ব্যবহার করেছিলাম ।
লীনা বড় হচ্ছে লেখাপড়া, চাকরি সংসার সব কিছুই একদিন ও করতে পারবে একা কিন্তু ?’ ওর মা বেঁচে থাকলে এ ভাবনা গুলো আমাকে ভাবতে হত না। এ সমাজে একটা কালো মেয়ের কোন মূল্য নেই। আমাদের মত পুরুষ শাসিত সমাজে। মানুষের শিক্ষা বাড়ছে, আধুনিকতা বাড়ছে, মনের বিশুদ্ধতা বাড়ছে, না একদম। কালো মেয়ে মানুষ গুলো কি মানুষ না। কালো হলো জগতের আলো। কিছু তরণ অবুঝ ছেলেরা বর্ণ ভেদাভেদ সমাজে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাদের মানসিক সমস্যা আছে। গায়ের রঙ দিয়ে কিছুই হয় না। মনের সাদা রঙ দিয়ে পৃথিবী পরিবর্তন করে দেওয়া যায়।
আমি আজ কালো মেয়ের বাবা ! আমার মানসিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল আমার স্ত্রী মিনু।
পর জন্ম বলে যদি কিছু থাকে সৃষ্টিকর্তাকে বলবো হে সৃষ্টিকর্তা আমাকে পেত্মী বউটা দিও!’





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট