খোলাচুল
আনোয়ার রশীদ সাগর
-এই ওট্, তোর বাপের বাড়ি যা।
-ক্যান বাপের বাড়ি যাবো? হাড় খাবো-মাংস খাবো, তারপর যাবো।
-দেকিরে শালির মাগী, আবার মুকি মুকি কতা?
-কতা না কইয়ি কইয়ি, তো ঘাড়ে উইটিছো, একুন আর ছাইড়বু নানে।
-বউয়ের কথা শুনে হালিমের মেজাজ আরো গরম হয়ে যায়। সে নিজ জায়গা থেকে উঠে গিয়ে বলে, কী করবি-কী করবি তুই।
-মামলা কইরবু, মামলা। তারপর মূন্সী দাদারে দিয়া পিটাইবু।
মূন্সীর কথা শুনা মাত্র হালিমের মাথায় খুন চড়ে যায়।
সে ফস-ফস করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, ছইরনের চুল চেপে ধরে, ঝ্যাটকা দিয়ে টেনে বলে, মামলা করার আগিই তোকে এই মাটিতে পুঁইতি রাইকবুনি মাগী, পুঁইতি রাইকবুনি। হাপাতে থাকে হালিম। এর পর ছইরনের চুল ছেড়ে দিয়ে, তারই ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে, চোখ পড়ে, পাশে রাখা ভাতের থালার উপর। চোখ পড়ার সাথে সাথে, ফুটবলে জোরে লাথি মারার মত, পা দিয়ে লাথি মারে ভাতের থালায়। থালাটি উড়ে গিয়ে উঠানে পড়লে, ভাত গুলো, আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা নদীর মত লাইন দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর থালাটি ঘুরতে ঘুরতে কুমড়া মাচার নিচে খুঁটিতে গিয়ে মৃদু ধাক্কা লেগে থেমে যায়। হালিমের তিন চার বছর বয়সের মেয়েটা আধো-আধো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে, থালার পাশে বসে এবং থালাটা হাতে নিয়ে, ছোট-পায়ে হেঁটে হেঁটে এসে, মেয়েটি ঠোঁট নড়িয়ে,আলতো করে বলার চেষ্টা করে, আবা-আব্বা...।
তার বাবার দিকে থালাটি এগিয়ে দিয়ে ধরে রাখে ও হালিমের মুখের দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকে। হালিমের চোখ মদিনার চোখে পড়ায়, সে গুজ-গুজ শব্দ করতে করতে বেরিয়ে যায় পূর্বদিকে। মদিনা আবারও বসে পড়ে এবং তার ছোট কচি দু’খান হাত বিছিয়ে, ছিটিয়ে থাকা ভাত গুলো কুড়াতে থাকে। এবার খুব আবেগের সাথে, দু’হাতে পরণের কাপড় গুছিয়ে, ছইরননেছা উঠে এসে, তার মেয়ে মদিনাকে কোলের ভিতর নিয়ে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকে।
হালিম হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে খোলা মাঠে পা রাখে। তার চোখে পড়ে, একটি মা-শালিক পাখির পিছনে পিছনে একটা বাচ্চা শালিক, পাখা উঁচু করে খুব কষ্টে ঘুরছে। কখনো পিছনে-কখনো সামনে থাকছে বাচ্চাটি। বাচ্চাটা দু’ঠোঁট ফাঁকা করে, চ্যাঁচ্যাঁ শব্দ করে ডাকছে। মা-শালিকটা মুখের ভিতর মুখ দিয়ে, খাবার খাওয়ায়ে দিয়ে, দু’ঠ্যাঙ তুলে, নাচতে নাচতে একটু দূরে গিয়ে, খাবার সংগ্রহ করছে। ঠিক তখনই বাচ্চা শালিকটা দু’পাখা খানিক উঁচু করে, কর্কশ গলায় চ্যাঁচ্যাঁ করছে। মা শালিকটা চেষ্টা করছে, দূরে যাবার, কিন্তু যাচ্ছে না। হালিম বুঝলো, বাচ্চা শালিকটাকে তার মা, মাটি থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া শিখাচ্ছে। হালিম ক্লান্ত মনে একটি ধানক্ষেতের পাশে বসে পড়ে। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
হালিম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ধান ক্ষেতের দিকে। বার বার মনে পড়ছে মায়ের কথা। তার মা, দু’চালা ঘরের আড়াতে, গলায় জড়ানো শাড়িতে ঝুলেছিল। ঘাড়টা নিচের দিকে হেলেছিল। মাথার খোঁপা-খোলা বড় বড় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়েছিল পিঠের উপর। হালিমের বাপজান ঘরে ঢুকে, ঝুলন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, কী করলিরে মোমেনা, তুই কি করলি?- আমার ছেলিডাকে এতিম কইরি থুইগেলি। বলে, হুঁ-হুঁ করে কাঁদতে কাঁদতে, হালিমের ঝুলন্ত মায়ের লাশের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বুক থাপড়াচ্ছিল। সে দৃশ্য হালিম তার চোখে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ধানের আলে বসে হালিম আবেগে তার চোখ মুছতে থাকে এবং মনে মনে বলতে থাকে, মাগো মা, খুব দুঃখে আছি-মন চাই তোর পাশে কবর খুইড়ি, শুইয়ি পড়ি, তোর শাড়ির নিচি।
তারপর ঝুলন্ত মাকে ঘরের আড়া থেকে নামিয়ে, গ্রামের মানুষে গোরস্থানে রেখে এসেছিল, এসেই বাপজান বার বার হালিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, বাপরে তুই আর তোর মাকে পাবি না। তখন হালিম না বুঝেই, তার বাপজানের কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল। মা মারা যাওয়ার পর, ছোটবেলায় থেকেই দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে সে। তখন থেকেই গ্রামের আহাম্মেদ মূন্সীর বাড়ি বান্দা কাজ করে আসছিল। হঠাৎ একদিন তার বাপজান দ্বিতীয় বিয়ে করে, শ্বশুর বাড়িতে (দ্বিতীয় মা বাপের বাড়ি) চলে যায়। তখন হালিম আরো একা হয়ে যায়।
তার জায়গা হয়, গ্রামের মসজিদের মূয়াজ্জ্বীন মজিবরের বাড়ি। মজিবরও থাকতো, আহাম্মদ মূন্সীর আশ্রয়ে। আহাম্মদ মূন্সী এ গ্রামের মন্ডল মানুষ। তার অনেক বড় গৃহস্থালী রয়েছে। গ্রামের অনেকেই তার বাড়ি জনখেটে খায়। তবে মজিবর মসজিদের মূয়াজ্জ্বীন হওয়ায় তার আলাদা সম্মান আছে। তাই আহাম্মেদ মূন্সী, তার সবচেয়ে বড় দাগের জমির পশ্চিম আলে, একটু জমি মজিবরকে দিয়ে, বাড়িও করে দিয়েছে। সে বাড়িতে মজিবর, তার বউ কুলসুম এবং একমাত্র মেয়ে ছইরননেসাকে নিয়ে বসবাস করে। পাশাপাশি আহাম্মেদ মূন্সীর বড়দাগের জমিটার ফসলাদিও দেখাশুনা করতে পারে। এখানেই হালিমের থাকার জায়গা হয়।
হালিম একটু স্বাবালক হলে আহাম্মেদ মূন্সী নিজেই ছইরনের সাথে হালিমের বিয়ে দিয়ে দেয়। সংসার জীবনে পা রেখেই হালিমের চোখে পড়ে অনেক ঘটনা।
হালিমের শাশুড়ি কুলসুম খাতুনের আর সন্তানাদি হয়নি। দেখতেও সুন্দরী। ছইরননেসা আর কুলসুম খাতুনকে এক জায়গা দাঁড় করিয়ে দিলে, মা ও মেয়েকে দেখতে মনে হয়, পিঠাপিঠি
দু’বোন। হালিমের চোখে প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে, তার বিয়ের দু’বছর পর। যখন তার শ্বশুর, আযানের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে, মসজিদের দিকে যায়, সে সময় ওই জমির পশ্চিম আলে, আহাম্মেদ মূন্সী এসে পায়চারী করে। প্রায় প্রতিদিনই আহাম্মেদ মূন্সীকে আসতে দেখে, হালিম একদিন তার শাশুড়ির ঘরের কোণে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। তার যা সন্দেহ হয়, ঠিক তাই দেখতে পায়। জানালার ফাঁক দিয়ে, হালকা পূর্ব আকাশের আলোয়, দিব্বি দেখা যায়। কুলসুমের নগ্নবুকের উপর উন্মত্ত হয়ে, খেলা করতে থাকে আহাম্মেদ মূন্সী। ডান হাতে, কুলসুমের এক পা উঁচু করে ধরে, অনর্গল নড়তে থাকে আহাম্মেদ আলীর প্রায় নগ্ন পাছা। এরপর আহাম্মেদ আলী উঠে দাঁড়িয়ে থাকে কুলসুমের সামনে। আর কুলসুম খোলাবুক সম্মূখের দিকে ঠেলে দিয়ে দু’হাত দিয়ে, তার লম্বা চুলগুলো গুছিয়ে পিছনে খোঁপা বাঁধতে থাকে। তখন মূন্সী তার দু’হাত দিয়ে নেড়ে দেয়, কুলসুমের খলবলিয়ে দুলে বেড়ানো স্তন দুটো। এ দৃশ্য দেখে, হালিম স্থির থাকতে পারে না, সে দ্রুত নিজ ঘরে ঢুকে, ছইরননেসাকে নগ্ন করে সঙ্গমে মত্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে আহাম্মেদ মূন্সী খোস মেজাজে, বাম হাতে নিজের লুঙ্গির শেষ অংশ ধরে, উঁচু করে, বাইরে বেরিয়ে, মুখ উঁচিয়ে, থু শব্দ করে, থুথু ফেলে চলে যায়।
সকাল হলে, হালিমের মন বিরক্ত ও অভিমান-অভিযোগে ভরে থাকে। কাজে তেমন মন বসে না। এভাবেই কেটে যায় আরো দুটি বছর।
দ্বিতীয় ঘটনা দেখে হালিমের মনে সন্দেহ আরো দানা বাঁধে। হালিমের বউ রইছননেসাকে নাতনী সম্মোধন করে ডাকে আহাম্মদ মূন্সী। প্রায় মশকরাও করে। এ মশকরাতে অংশও নেয় ছইরন। সেদিন সন্ধ্যা-ঘোরে, আহাম্মেদ মূন্সীকে ছইরননেসার ঘর থেকে বের হতে দেখে হালিম। হালিমের সামনাসামনি হওয়ায়, আহাম্মেদ মূন্সী হালিমের পিঠে হাত দিয়ে বলে, নাইতজামাই সকাল-সকালই তো বাড়ি আইসি গিছো!- ভালো ভালো, বউ’র প্রতি ভালোবাসা থাকা ভালো। দেকি রাইকু আমার নাতনীডারে...,।
হালিমের শরীরের ভিতর আগুন ধরে যায়। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। মনে মনে ভাবে, মূন্সীরই খায়-পরি, মূন্সীর বাড়িই থাকি।
আল্লার উপর বিচার দেয়, আল্লা গো, তুমি বিচার কইরু।
ভাবতে ভাবতেই চোখের আড়ালে চলে যায় আহাম্মেদ মূন্সী। হালিমের চোখের সামনে, শাশুড়ির দুলানো নগ্নবুক আর পিছনে কাইত হয়ে দু’হাতে, চুল বাঁধার দৃশ্য, বার বার ঘুরেফিরে ভেসে আসে। চোখ থেকে মুছতে গিয়ে, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে নিজ বউয়ের নগ্নবুক আর খোলা এলোমেলো চুলগুলো।
না; হালিম আর বসে থাকতে পারে না, দ্রুত উঠে পড়ে। সে তার বাপজানের মত, এই গ্রাম ছেড়ে, ছইরননেসা আর মদিনাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
উঠানে পা দিয়ে দেখতে পায়, ছইরননেসার পিঠের উপর চুলগুলো বেয়াড়া হয়ে ছড়িয়ে আছে। আর মদিনা তার ছোট দুটি হাত দিয়ে, তার মায়ের চুলগুলো যত্ম করে গুছিয়ে দিচ্ছে।