সব পাখি ঘরে ফেরে না



সব পাখি ঘরে ফেরে না
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসিফ দেখতে পেল দরজায় তালা ঝুলছে। বুঝতে বাকি রইলো না, তিশা আবারো বাসা ছেড়ে চলে গেছে। এই নিয়ে ছয় বার, তাই আসিফ খুব বেশি অবাক হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়িওয়ালার বাসায় গেল চাবি আনতে। চাবি দেওয়ার সময় বাড়িওয়ালা দু’চার কথা শুনিয়ে দিল। ‘শুনেছি প্রেম করে বিয়ে করেছিলে। দুই বছর পার হলো না এর মধ্যে অনেকবার ঘর ছেড়েছে। কেমন প্রেম করেছিলে যে বউ কথায় কথায় ঘর ছেড়ে চলে যায়। এবার বাচ্চাকাচ্চা নাও মিয়া, এতে করেও যদি তোমাদের সংসার কোনো রকমে টিঁকে থাকে।’ এসব শুনে আসিফ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চুপ করে মাথা নুইয়ে চাবি হাতে নিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নেয়। তালা খুলে ঘরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে জগের নিচে রাখা চিরকুটটা হাতে নিল। তারপর বেড রুমে ঢুকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চিরকুট খুলে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। গতানুগতিক সেই একই কথা। ‘তোমার সাথে আর সংসার করা সম্ভব নয়। আর ফিরে আসছি না। ভুলেও আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে না।’ তবে এবার নতুন করে যোগ হল, ‘আমি তোমাকে খুব দ্রুত ডিভোর্স নোটিশ পাঠিয়ে দিব। এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।’ আসিফ চিরকুট থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ডিভোর্স নামক শব্দে তার চোখ আটকে আছে। কখন যে চোখের কোণে পানি এসে গেল, সে বুঝতে পারলো না। চোখের পানি মুছে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তিশাকে কল দিতে গিয়ে থেমে গেল। ডিভোর্সের কথাটা মনে হতেই আসিফের খুব অভিমান হয়েছে। গতকাল রাতে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রাগের মাথায় একটা চড় মেরেছে, তাই বলে ডিভোর্স দিতে হবে! এটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না আসিফ। অফিস থেকে ফিরে হালকা নাস্তার অভ্যাস আছে কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। পেটে ক্ষুধা নিয়েই বিছানায় শুয়ে থেকে এক ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে। মনে পড়ছে সেই পুরানো দিনে কথা।

এক সময় আসিফের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। একের পর এক বিভিন্ন রকম ইভেন্ট অর্গানাইজ করে তখন দু’হাত ভরে টাকা কামাই হচ্ছিল। একটা ইভেন্টের কাজে আসিফের সাথে তিশার পরিচয়। তারপর ফেসবুকে বন্ধুত্ব এবং মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করতে করতে একসময় ঘনিষ্ঠতা। আসিফের সাথে যতবারই তিশার দেখা হয়েছে, কোনো না কোনো নামীদামি রেস্টুরেন্টে কিংবা শপিং মলে। এছাড়াও প্রাইভেট কার ভাড়া করে এখানে ওখানে লং ড্রাইভে যাওয়া। তিশাকে খুশি করতে একসময় আসিফ ব্যাংক লোন নিয়ে ডাউন পেমেন্ট করে নিজেই একটা প্রাইভেট কার কিনে নেয়। আসিফের চাকচিক্য ও আভিজাত্য তিশাকে বরাবরই মুগ্ধ করে রাখে। স্বামী হিসেবে মেয়েরা এমন ছেলেই পছন্দ করে। আসিফকে বিয়ে করতে তিশা মরিয়া হয়ে উঠে। যদিও আসিফ তখন বিয়ের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারপরেও তিশার চাপ উপেক্ষা করতে পারেনি। তাই বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তিশার ইচ্ছায় বিয়ের পর হানিমুনে গেল থাইল্যান্ড। হানিমুন থেকে ফিরে এসে আসিফ ব্যবসায়ে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখে প্রচুর দেনা পড়ে গেছে। কিন্তু দেনা পরিশোধের জন্য ব্যাংক একাউন্টে তেমন টাকাও নেই। আসিফ ভালো ব্যবসায়ী, তাই সাপ্লাইয়ের পার্টিরা বাকিতে ইভেন্ট অর্গানাইজ করার মালামাল দিত। বাকিতে মালামাল নিলেও সে সবার টাকাই ঠিক মতো পরিশোধ করত। তবে বিগত চার মাস যাবত আসিফ কারো টাকাই ঠিকমতো পরিশোধ করেনি। বর্তমানে সাপ্লাইয়ের বিভিন্ন পার্টি পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য অফিসে বসে থাকে। এদিকে নতুন কাজ হাতে নিতে পারছে না কারণ টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত কেউ বাকিতে মালামাল দিবে না। তখন আসিফের মনে পড়ে, যে টাকা দিয়ে সে ধুমধাম করে বিয়ে এবং হানিমুনে করেছিল, সেটা ছিল সাপ্লাই পার্টিদের বাকির টাকা। বাধ্য হয়ে ডাউন পেমেন্টে কেনা নতুন গাড়ি বিক্রি করে দেয়। যদিও বেশি টাকা পায়নি কিন্তু অল্প করে পার্টিদের কিছু টাকা পরিশোধ করে। এদিকে আসিফের ব্যবসার দূরাবস্থা, অন্যদিকে তিশার উচ্চ বিলাসিতা। কোনো দিক সে ঠিক মতো সামাল দিতে পারছে না। দিনে দিনে তিশা বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং প্রায় প্রতিদিন এটা ওটা নিয়ে আসিফের সাথে রাতভর ঝগড়া করে। যেদিন মাত্রাতিরিক্ত ঝগড়া হয়, পরের দিন সকালে তিশা বাপের বাড়ি চলে যায়। আবার আসিফ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অনেকটাই নাকে খত দেওয়ার মত করে তিশাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

অনেক চেষ্টা করেও আসিফ ব্যবসায়ে ফিরে আসতে পারেনি। একের পর এক কাজ হারাতে থাকে। অফিস ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যেখানে দায়, সেখানে পাওনাদারের টাকা পরিশোধ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। তাই শেষ মূহুর্তে বাধ্য হয়ে আসিফ তার এক বন্ধুর কাছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটা বিক্রি করে দিয়ে সবার দেনা পরিশোধ করে। ব্যবসা হারিয়ে সে হন্য হয়ে চাকরি খুঁজতে থাকে। ভাগ্য ভালো ছিল, তাই এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটা স্বনামধন্য এড ফার্মে সে চাকরি পেয়ে যায়। মোটামুটি যা বেতন পেত, দুজনের পরিবার সুন্দর ভাবেই চালানো যেত। কিন্তু তিশার উচ্চ বিলাসি মানসিকতা আসিফের প্রতিকূল পরিস্থিতি বুঝতে চাইতো না। বিভিন্ন ভাবে আসিফকে মানসিক টর্চার করত। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিশার মন জয় করতে পারত না। কারণ তিশার বিলাসিতার কাছে আসিফের আয় ছিল সীমিত। এক সময় তিশা নিজেও চাকরি করতে চায়। সেই চাকরিটাও আসিফ জোগাড় করে দিল। চাকরিতে জয়েন করার মাসখানেক পর থেকে তিশা আসিফের প্রতি আরো বেশি উদাসীন হয়ে যায়। আসিফ খেল কি খেল না, কোনো কিছু নিয়ে তিশার মাথা ব্যথা নেই। সংসারের খরচ আসিফ দিয়ে যাচ্ছে আর তিশা নিজের ইনকাম দিয়ে বিলাসিতা করছে। এভাবেই চলছে, তবুও আসিফের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। যদিও মাঝেমধ্যে নিজের সাথে আক্ষেপ করে কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলেনি। সে সব সময়ই চেষ্টা করে তিশার সাথে ঝগড়া এড়িয়ে চলতে। তবে এক সময় লক্ষ্য করে তিশার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। তিশা মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। তার মোবাইল ফোন ধরলে আসিফের সাথে ঝগড়া করে। কখনো কখনো রাত করে বাসায় ফিরে। এসব নিয়ে কথা বললেই আসিফের সাথে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। আবারো বাপের বাড়ি চলে যায়। আবারো নাকে খত দেওয়ার মত করে তিশাকে ফিরিয়ে আনতে হয়। শেষমেশ অনেকটাই নিরুপায় হয়ে আসিফ তিশার সবকিছুই বাধ্য হয়ে মেনে নেয়। সে চায় অন্তত সংসারটা টিঁকে থাকুক। সত্যি কথা বলতে, আসিফ তিশাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাই সে চায় না কোনো ভাবেই তিশাকে হারাতে। একটা গানের কথায় আছে, মন ছুটলে কাউকে ধরে রাখা যায় না। তিশার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হল।

অফিসের কাজে পারদর্শী না হলেও কীভাবে বসের মন জয় করতে হয়, তিশা সেটা খুব ভালোই জানে। তাই চাকরির ছয় মাসের মাথায় জব কনফারমেশনের সাথে একটা প্রমোশনও পেয়ে যায়। তিশা তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলতে থাকে। দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠে। অফিসে বসদের সাথে ঘেঁষাঘেষি করা যেন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য নারী কলিগরাও এসব দেখে নাক সিটকায় কিন্তু এতে করে তিশার কিছুই যায় আসে না। একদিন অফিসের এক পার্টিতে পরিচয় ঘটে অন্য এক কোম্পানির একজন ইয়াং ডিরেক্টর নাঈম আহমেদের সাথে। তিশা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে নাঈম আহমেদের নজরে আসার চেষ্টা করে এবং এসেও যায়। ফেসবুকে ও মোবাইলে আলাপচারিতায় কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের মধ্যে বেশ অন্তরঙ্গ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তার হাত ধরে মাস দুয়েক পর সে ওই কোম্পানির অফিসে ডাবল প্রমোশন নিয়ে জয়েন করে। নতুন অফিসে জয়েন করার পর তিশার গেটআপ বদলে গেছে। এখন তার মধ্যে একটা আভিজাত্য ভাব ফুটে উঠেছে। নাঈম আহমেদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পার্টিতে যাচ্ছে। সে যেমন জীবন চেয়েছিল, তার সাথে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে। এদিকে আসিফের প্রতি তিশার প্রায় সব রকম আগ্রহ ও টান ফুরিয়ে গেছে। শুধুমাত্র একটা সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য আসিফের সঙ্গে থাকা। একদিন রাতে আসিফ তিশাকে একটা ভিডিও ফুটেজ দেখায়। নাঈম আহমেদের সঙ্গে তিশা অভিজাত হোটেলের রুমে ঢুকছে। ওই হোটেলে চাকরি করে আসিফের বন্ধু। সে সিসি ক্যামেরা হতে ওই ফুটেজ সংগ্রহ করে আসিফকে দিয়ে ছিল। ওই ফুটেজের বিষয়ে তিশার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হতে হতে এক পর্যায়ে আসিফ তিশার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তিশা আর কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে থাকে আর আসিফ ড্রয়িং রুমের সোফায়। পরদিন সকালে ঘুম ওঠে আসিফ রেডি হয়ে অফিসে চলে যায়। তিশার সেদিন ডে-অফ থাকায় সে দরজার চাবি নিয়ে যায়নি। আসিফ চলে যাওয়ার পর তিশা ঘুম থেকে ওঠে। তারপর লাগেজ গুছিয়ে একটি চিরকুট লিখে ডাইনিং টেবিলের জগের নিচে রেখে বাসা ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে বাসার চারি বাড়িওয়ালার হাতে বুঝিয়ে দেয়।

তিশার উপর আসিফের রাজ্যের অভিমান থাকলেও সে যোগাযোগ না করে থাকতে পারেনি। সপ্তাহখানেক পর তিশার বাবার মোবাইলে কল দেয়। সালাম দিয়ে ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিয়ে তিশার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান তিশা তো বাসায় আসেনি। তখনই আসিফের মাথাটা চক্কর মেরে ওঠে। তিশার বাবা অতিমাত্রায় একজন ভদ্রলোক। শুধুমাত্র উনার জন্যেই তিশা প্রত্যেক বার আসিফের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়ে ছিল। তবে তিশার মা তার ঠিক উল্টো। আসিফকে নাকে খত দিয়ে তারপর তিশাকে যেতে দেয়। যা হোক, আসিফ ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় কিন্তু শ্বশুরকে জানায়নি যে তিশা এক সপ্তাহ আগে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন তিশার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না, তখনই একটা কল আসে আসিফের মোবাইলে। সে কল রিসিভ করতে অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠে, ‘আমি নাঈম আহমেদ। আপনার স্ত্রী তিশা আমার কাছে আছে। সে আপনাকে ডিভোর্স দিতে চায়। যদি মিউচুয়ালে হয়, তাহলে সবকিছু সহজেই হয়ে যাবে। আশাকরি আপনি কোনো আপত্তি রাখবেন না। আপত্তি করলেও তিশা আপনাকে একতরফা ডিভোর্স দিবেই। আপনি ভেবে চিনতে আমাকে আগামী তিনদিনের মধ্যে জানাবেন।’ আসিফ তিনদিন ধরে অনেক অনেক চিন্তা ভাবনা করে কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আবারো নাঈম আহমেদের কল আসে। সে জানিয়ে দেয় মিউচুয়াল ডিভোর্সে সে রাজি নয়। তিশার জন্য সে অপেক্ষা করবে, যদি তার সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন আসে। আসিফের কথা শুনে নাঈম আহমেদ অট্টহাসিতে মেতে ওঠে এবং বেস্ট অফ লাক বলে কল কেটে দেয়। কিছুদিন পরেই তিশার পক্ষ হতে ডিভোর্সের উকিল নোটিশ আসে। তবুও আসিফ হাল ছাড়েনি। অপেক্ষা করতে থাকে। যদি তিশার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় শেষে ডিভোর্স চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হয়। তখন আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপলব্ধি করে, সব পাখি ঘরে ফিরে না।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট