মানুষ, সভ্য-সমাজ ও কবিতা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। আর মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য অন্য সবকিছু সৃষ্টি। একজন ‘কবি সমাজের মানুষ, কিন্তু তবু তিনি সমাজের বাইরে।’১ কবিতা সমাজকে প্রভাবিত করে। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য দিয়েই কবি ও তাঁর কবিতাকে বিচার করতে হয়। ‘মানুষের সমস্ত সৃজনপ্রেরণার উৎস তার সমাজ ও সময়। সমাজ ও সময়লালিত হবার ফলেই ব্যক্তির সংবেদনা, আবেগ, অনুভব ও জীবন-কল্পনা সমষ্টির মধ্যে আত্মমুক্তির সন্ধান করে।’২‘মানুষের বস্তুগত কর্মপ্রক্রিয়া ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ প্রয়োজনবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ধারণা, অনুভব ও চেতনা। কবিতা এই চেতনারই শব্দময় ও চিত্রকল্পময় অভিব্যক্তি।’৩
‘ব্যক্তির আবেগপুঞ্জের সাথে সংঘ-জীবনাবেগের সংযোগের ফলেই কবিতার সৃষ্টি। মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিই হচ্ছে তার আত্মপ্রকাশ-প্রবণতাÑযে প্রবণতা ব্যক্তিকে সমষ্টিগত জীবনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। এই প্রকাশ আকাক্সক্ষার গভীরে নিহিত রয়েছে মানব মনেই সেই মৌল অভীপ্সা, যা সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষকে সামূহিক জীবনচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।’৪
“প্লেটো-অ্যারিস্টটলের শিল্প, দর্শন ও নন্দনতাত্ত্বিক অভিনিবেশের মধ্যেও কবিতার জীবন ও সমাজনিষ্ঠ স্বীকৃতি বিদ্যমান। প্লেটো কবিতাকে দৈবপ্রেরণাজাত সৃজনপ্রয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ‘শিল্প অনুকরণ’Ñএই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তিনি কবিতাকে অলৌলিকতার পর্যায় থেকে লৌকিক জীবনের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন অলক্ষ্যে। অ্যারিস্টটলই প্রথম লোকায়ত জীবনের সহজ সম্বন্ধের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পকে। প্লেটো কথিত ‘আইডিয়াল রাষ্ট্রে’ কবিতার অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও তিনি শিল্প যে অভিজ্ঞতা বা জীবনের অনুকরণ এ সত্যে বিস্মৃত হন নি। আর অ্যারিস্টটলের চিরায়ত গ্রন্থ চড়বঃরপংÑ এর ভিত্তিমূলে রয়েছে এই অনুকরণবাদ। পোয়েটিক্স বা কাব্যতত্ত্বে ট্রাজেডির সংজ্ঞা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের মন্তব্য লক্ষণীয়, ট্রাজেডি ‘ঘটনার অনুকরণ এবং জীবনের অনুকরণ আর জীবনের রূপ কার্যেই প্রকাশিত।’ কোনো অলৌকিক দৈব-প্রতিভাস হিসেবে নয়, মানব স্বভাবের গভীরেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্প-সৃষ্টির উৎস।”৫
সমাজজীবনের অন্তঃসারকে আত্মস্থ করেই যেহেতু কবিতার উদ্ভব, বিকাশ ও ক্রমযাত্রা, সে-কারণে বিশেষ ভৌগোলিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মানচিত্রগত বৈচিত্র্যের ফলে কবিতার স্বরূপও বিভিন্ন হতে বাধ্য। এই বিভিন্নতার পরিচয় প্রতিটি যুগের কবিতায় অভিব্যক্ত।
যে-কোনো সভ্যতার উদ্ভব-পর্যায়ের সৃষ্টি মহাকাব্য। ইলিয়াড-ওডেসি এবং মহাভারত-রামায়ণের গঠনমান সভ্যতার শৈল্পিক-প্রকাশই মুখ্য। প্রথম-পর্যায়ের কাব্যসমূহ তাই কোনো ব্যক্তি বিশেষের সৃষ্টি নয়, সভ্যতা-বিকাশ-পরম্পরায় ব্যক্তিচেতনা পুঞ্জের সমন্বিত সৃষ্টি।
সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তন ও ক্রমযাত্রার পথপরিক্রমায় ক্রমাগত শ্রম-বিভাজনের ফলে শ্রেণিগত বিভেদ হয়ে ওঠে অনিবার্য। এই শ্রেণিগত বৈচিত্র্য একেকটা পর্যায় অতিক্রম করার সাথে সাথে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়াটাও হতে থাকে দ্রুততর। শ্রেণিসমূহের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টির ফলে বাস্তববিচ্ছিন্ন শোষকশ্রেণির উদ্ভব হয়, ব্যক্তিগত মালিকানা হয় সুসংহত, উপজাতিক যৌথজীবনের ধ্বংশাবশেষের ওপর জন্ম নেয় জমিদার, ভূমাধিকারী। শুরু হয় মানবিক বিপর্যয়। মানবীয় আত্মচ্যুতির মূলে বিদ্যমান নিজের সৃজিত সম্পত্তি থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। মহাকাব্য পরবর্তী কবিতার যুগ তাই মানবসমাজের অবক্ষয়ের যুগ, তার হীন মন্যতার যুগ। অবশ্য মহাকাব্যগুলোতেও আমরা একজন দেবতাধিপতিÑ যেমন ইলিয়াডের জিউস এবং মহাভারতের কৃষ্ণকে দেখতে পাই। ঈস্কাইলাসের ‘চৎড়সবঃযবঁং ইড়ঁহফ/ প্রমেথিউস বাউন্ড’-এ শোষিত-লাঞ্ছিত মানবাত্মার আর্তনাদই বাণীরূপ পেয়েছে। দেবতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই প্রমেথিউস বাউন্ড এর মুখ্য বিষয়। সমাজজীবনের অবরুদ্ধার অনুষঙ্গেই ঈস্কাইলাসের কাব্যে প্রমেথিউস বন্দী। সফোক্লিসের ঙবফরঢ়ঁং ঃযব শরহম, ঙবফরঢ়ঁং ধঃ ঈড়ষড়হড়ং, অহঃরমড়হব Ñ প্রভৃতিতেও নিয়তিতাড়িত ও অসহায় মানবজীবনের যে হাহাকার ও করুণ পরিণতি বিধৃত, তার মূলেও বিদ্যমান সামাজিক মানুষের জৈবনিক ট্রাজেডি। ট্রাজেডিগুলোতে কোরাসের উপস্থিতি তার সামাজিক চরিত্রকে অধিকতর সুদৃঢ় করেছে।
সমাজ ও সভ্যতার দ্বন্দ্বময় বিকাশের নিয়মই হচ্ছে ক্রমবিবর্তন। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব যখন চরম রূপ ধারণ করে, তখনই সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য। ধর্মের আশ্রয়েই যেহেতু রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থিতি, সে কারণে রাষ্ট্রশক্তির জয় পরাজয়ও অনেকাংশে ধর্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। যেমন রোমান সভ্যতা পতনের পর ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের আক্রমণে পতন ঘটে হেলেনীয় সভ্যতার। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার গণতন্ত্রের গৌরবসূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বকবিতার পটভূমিতে সূচিত হয় একটা শূন্যতাময় তমসাপ্রবাহ। বিশেষ সমাজে এক ধর্মের আধিপত্যের পরিবর্তে ধর্মও একটা জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজ ও ধর্মের এই সংঘাতময়, দ্বন্দ্ববহুল ও বিচিত্র রূপবৈশিষ্ট্যের অঙ্গীকারই প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতায় বিধৃত।
ইংরেজি সাহিত্যের আদিকাল-পর্ব অ্যাংলো-স্যাক্সন পর্ব। এই কালসীমা সপ্তম থেকে দশম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পর্বে ইংল্যান্ডে ঐহিক জীবনচেতনাপরি¯্রুত যে কাব্যধারার উদ্ভব ঘটে, তা মূলত সমসাময়িক কালের জার্মানিক বা টিউটোনিক সাহিত্যের প্রভাবজাত। গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভুত এই সাহিত্য ধারা ভূমধ্যসাগরের উত্তরে অর্থাৎ ইউরোপের প্রধান ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করে। জার্মানিক সাহিত্যের সাথে অ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতার যোগসূত্র একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্মিলনের প্রতিফলন।
ইংরেজি কবিতায় রেনেসাঁসলব্ধ জীবন চেতনার প্রকাশ ঘটে ষোল শতকের মধ্য পর্যায়ে। স্যার টমাস ওয়াট (১৫০৩-১৫৪২) এবং আর্ল অব সারের (১৫১৮-১৫৪৭) এর কবিতা নবচৈতন্যময় জীবনান্বেষার শিল্পরূপ। রেনেসাঁস-যুগের ইতালির ভাবপুরুষ পেত্রার্ক এই যুগচৈতন্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
এলিজাবেথীয় যুগে রেনেসাঁস-প্রভাবিত জীবনবোধ এবং নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার অঙ্গীকারে এডমন্ড স্পেন্সার এবং শেকস্পিয়র মানবীয় সমাজ ও তার সমগ্রতাকে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। স্পেন্সারের কাব্যে জীবনের বিচিত্র সম্মিলন ঘটেছে। শেকস্পিয়রের কবিচৈতন্যের সার্থক প্রকাশ তার সনেটে এবং নাট্যকার শেকস্পিয়রের সাফল্য ও সিদ্ধির উৎস তাঁর কবিত্ব শক্তি। জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৮) রেনেসাঁসলব্ধ ইংল্যান্ডীয় জীবনচৈতন্যের পরিণত কবিপুরুষ। ইংরেজি কবিতার পটভূমিতে তাঁকে রেনেসাঁসের শেষ প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রেনেসাঁসের মূল্যবোধ ও জীবন চেতনা মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (১৬৬৭) কাব্যকে চিরায়ত শিল্পমহিমায় উন্নীত করেছে। ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রথম নর-নারী আদম-ঈভ কর্তৃক ঐশী বিধি লংঘন, তাদের স্বর্গচ্যুতি, ঈশ্বরের ন্যায় বিচার প্রভৃতি প্রসঙ্গÑএই কাব্যের প্রধান বিষয়বস্তু। রেনেসাঁসের প্রভাবে সমাজচৈতন্যে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল হলো যে, মানুষের জন্য একটা নতুন উন্নতর জীবনের দ্বার এখন উন্মুক্ত। সুতরাং মানুষ হিসেবে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে হলো স্বতঃস্ফূর্ত। যে সৌন্দর্যচেতনা ব্যক্তির জীবনবোধ ও সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতাকে করে প্রাণময়, এ সময়কালের ফরাসি কবিতায় সেই ধর্মবন্ধনমুক্ত সৌন্দর্যচেতনার নবদিগন্ত হলো উন্মোচিত। রেনেসাঁসের প্রভাবেই ফ্রান্সে ধ্রুপদ সাহিত্যের পথ হলো অবারিত। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি সমাজপ্রবাহ, তার সংগঠন ও সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত লা ফতেঁর (১৬২১-১৬৯৫) কবিতায় বিদ্যমান।
ইংরেজি সাহিত্যে এলিজাবেথীয় যুগের কল্পনাময় ও ভাবাবেগ রেস্টোরেশন যুগে (১৬৬০-১৭০০) যুক্তিবাদিতা, বস্তুতান্ত্রিকতা এবং ক্ল্যাসিক মতবাদে ক্রমবিকশিত ও সুসংহত হয়। ১৬৮৮ সালের ‘গৌরবদীপ্ত বিপ্লব’ এবং ১৬৮৯ সালের উইলিয়াম ও দ্বিতীয় চার্লস কন্যা মেরি কর্তৃক ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের পট পরিবর্তন পরিবর্তন হয়। এ সময়ে কবিতার ক্ষেত্রে জন্ ডাইড্রেন ও স্যামুয়েল বাটলার যুগপ্রতিনিধিত্বশীল কবি প্রতিভা। অগাস্টান যুগে (১৭০০-১৭৫০) ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় দ্বন্দ্বের অবসান, রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে সহযোগী মনোভাব সমাজজীবনের স্থিতিশীলতার দ্যোতক। পার্লামেন্টের প্রাধান্য বিস্তারের ফলে স¤্রাট ও অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের গতি হয় অবরুদ্ধ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজদরবারের পরিবর্তে ‘কফি হাউসের’ প্রাধান্য বিসতৃত হয়। আলেকজান্ডার পোপ এ যুগের শ্রেষ্ঠতম কবি।
মানবীয় সক্রিয়তার এক বিস্ময়কর বিকাশ পর্যায় শিল্পবিপ্লব বা ওহফঁংঃৎরধষ জবাড়ষঁঃরড়হ। এই বিকাশ-পর্বে ইংল্যান্ড বিশ্বব্যাপী তার বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তারের চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। তবে, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তর্গত ক্ষয়শীলতারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের এই বিশ্বব্যপ্ত পটভূমিতে সংগঠিত হলো ‘ফরাসি বিপ্লব’ (১৭৮৯)। ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক প্রতিক্রিয়া ইউরোপীয় চৈতন্যে হলো দূরসঞ্চারী। যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার জীবনবেদ ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে নিহিত ছিল, ইংল্যান্ডের সমাজচৈতন্যে তার অভিঘাত অপরিমেয় জীবনচাঞ্চল্যে হলো গতিময়। টমাস পেইনের ‘রাইটস্ অফ ম্যান’(১৭৯১) গ্রন্থটি রুশো-ভলতেয়ার প্রভাবিত বিপ্লবী জীবনচেতনার উত্তরাধিকার সমৃদ্ধ। জৈবনিক মুক্তির মধ্যেই মানুষের কল্পনার সর্বময় মুক্তি নিহিত। আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তাই ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব এতো গভীর ও তাৎপর্যময়। রোমান্টিসিজমের জীবনচৈতন্য ও সাহিত্যাদর্শ ফরাসি বিপ্লবের কাছে অনেকাংশে ঋণী।
রোমান্টিক যুগের প্রথম পর্বের প্রধান কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড এই নব্য জীবন চেতনার সার্থক কবি প্রতিনিধি। এ সময়ের আরেকজন প্রধানতম কবি হলেন কোলরিজ। উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড ও কোলরিজ দু’জনের সম্মিলিত প্রয়াসে খুৎরপধষ ইধষষধফং (১৭৯৮) এর উদ্ভব আধুনিক জীবন চৈতন্যের অঙ্গীকারে গৌরবমন্ডিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের রোমান্টিক কবিদের মধ্যে শেলী, কীট্স, বায়রন বিদ্রোহ ও জীবনচেতনায় একই আদর্শের প্রতিনিধি। উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড ও কোলরিজের বিদ্রোহ ছিল অন্তর্গত, কিন্তু শেলী কীট্স বা বায়রনের বিদ্রোহ জীবনাচরণ ও কবিতায় যুগপৎভাবে প্রতিফলিত। শেলীর চৎড়সবঃযবঁং টহনড়ঁহফ সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রতীকী কাব্যরূপ।
ইংরেজি সাহিত্য-শিল্পের ভিক্টোরিয়ান যুগ (১৮৩৭-১৯০১)। এই সময়কে বলা হয় পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়ের যুগ। এই অবক্ষয় শিল্পবিপ্লবের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবজাত। সৌন্দর্য এবং বাস্তবজীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে সমন্বয়বিধানের প্রয়াস সত্ত্বেও পরিণামে বস্তুজগতের দৈনন্দিনতার অভিঘাতদীর্ণ জীবন মুখ্য হয়ে ওঠে টেনিসনের কবিতায়। ভিক্টর হুগো ফরাসি রোমান্টিসিজমের সার্থক প্রবক্তা।
পুঁজিবাদী সমাজের গতি ও উদ্যমের উৎস পুঁজি। ব্যক্তির অবস্থান সেখানে মূল্যহীন। তার ক্রিয়াশীলতা পুঁজির মানদন্ডেই বিবেচিত। শিল্পসৃষ্টি সেখানে এক অনুৎপাদনশীল শ্রমমাত্র।
‘পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বহির্দ্বন্দ্বের চরম প্রকাশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)। সা¤্রাজ্য-বিস্তার ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ যে বিশ্বব্যাপ্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, প্রথম মহাসমরের মধ্য দিয়ে সূচিত হলো তার অবক্ষয় পর্ব। কালের এই অস্থিরতা, অবক্ষয় ও অনিশ্চয়তার পটভূমিতে টি. এস এলিয়টের উপলব্ধি তাই গভীর যন্ত্রণা এবং রক্তক্ষরণে পর্যবসিত। আইরিশ কবি ইয়েট্স-এর বিশ্বাস ও অনুভবের বাস্তব-উৎস বিপন্ন হবার ফলে, তাঁর ইতিবাচক প্রত্যাশার ভিত্তিভূমি হয় পর্যুদস্ত। যুদ্ধোত্তর জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়ায় ইয়েট্স-এর চেতনার রূপান্তর হলো অবশ্যম্ভাবী। তাঁর প্রকৃতিসংলগ্ন চেতনার কেন্দ্রমূলে সূচিত হলো যুদ্ধজনিত রক্তক্ষরণ, অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ববোধ। তবুও ইয়েট্স এর মধ্যে জীবন জিজ্ঞাসার ইতিবাচক সূত্রসমূহের উপলব্ধি নি:শেষিত নয়। যুদ্ধোত্তর জীবনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সার্থক দৃষ্টান্ত টি. এস এলিয়টÑএর কবিতা। জীবনের অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় ও অবিশ্বাসবোধ থেকে এক সীমাহীন অমীমাংসার অন্ধকারে নিমজ্জিত তাঁর কবিচৈতন্য। সেখানে উজ্জীবনের কোনো সম্ভাবনা নেইÑ সকলেই ধ্বংসপ্রবণ পরিণতির দিকে ধাবমান। সংযোগ এবং বিচ্ছিন্নতা, দ্বন্দ্ব এবং অবক্ষয় তার কবিতার সমান্তরাল অভিব্যক্তি লাভ করে।’৬
টি. এস এলিয়টের বিশ্বাসের পরিণতি ক্যাথলিক ধর্মবোধে আর এজরা পাউন্ড যুগধর্মের অন্বিষ্ট হিসেবে সনাক্ত করেন চিত্রকল্প। এজরা পাউন্ডের মতে, কবির কাম্য সংগ্রাম বা সংঘশক্তি নয়, কবির দরকার একটি ভালো চিত্রকল্প। পুঁজিবাদী সমাজে আশ্রিত কবি এক পর্যায়ে উপলব্ধি করেন নিজের অস্তিত্ত্বে নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতা। কবি শ্রমের শোষক বা পুঁজিপতি নন, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোষিত। সুররিয়ালিস্টিক কবি এই সমাজের স্বভাবধর্মকে অতিক্রম করতে পারেন না বলেই তিনি যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হন।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার প্রথাগত ধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচক। এ পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর ছিরেন কবি পুশকিন। ইতালির দান্তে বা পেত্রার্কের মতো পুশকিনকে বলা হয় ‘রাশিয়ার বসন্ত’।
‘আধুনিক সভ্যতা মানবচৈতন্যের উজ্জীবনকে যেমন সর্বময় করেছে, তার বিস্তারকে যেমন গভীরতা ও ব্যাপ্তি দান করেছে, তেমনি তার জন্য স্থিতিশীল জীবন পটভূমি নির্মাণ করতে হয়েছে ব্যর্থ। দ্বন্দ্বময়, জটিল ও স্তরবহুল সমাজ সংবেদনশীল চৈতন্যকে নিক্ষেপ করেছে সীমাহীন জিজ্ঞাসা ও কৌতুহলের মধ্যে। একেকটি আদর্শের উদ্ভব যেমন প্রত্যাশাদীপ্ত স্বপ্নকল্পনার কার্যকারণ হয়ে ওঠে, তেমনি সমাজ ও জীবনের অনিশ্চিত-গতি পদবিক্ষেপে সেই প্রত্যাশার দিগন্তও আলোকিত সম্ভাবনার পরিবর্তে উপনীত হয় এক শূন্যময় তমসাপ্রবাহের সীমাহীনতায়। কতিার প্রকরণ এ কারণেই তার প্রথাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায়Ñ কবির অর্জিত বিশ্বাস প্রতিনিয়তই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। দুঃস্বপ্নের চোরাবালিতে পথ হারিয়ে ফেলে চৈতন্য। এভাবেই কবির অন্বিষ্ট সমষ্টির পরিবর্তে হয়ে ওঠে আত্মগত। বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাঁর কাম্য। প্রত্যাশিত আদর্শের প্রতিষ্ঠা-সম্ভাবনা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখনি আদর্শগত সংগ্রাম থেকে সামূহিক বোধ থেকে কবি হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। র্যাঁবোর পরিণতি যেন সে-সত্যেরই ইঙ্গিত।’৭
তথ্যসূত্র :
১ . মনজুরে মওলা : প্রসঙ্গ-কথা, কবিতা ও সমাজ, রফিকউল্লাহ খান, (ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা ১৯৮৯), বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
২ . রফিকউল্লাহ খান : কবিতা ও সমাজ (ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা ১৯৮৯), বাংলা একাডেমী, ঢাকা। পৃষ্ঠা : ০৯।
৩ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১১
৪ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১৪
৫ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১৯
৬ . প্রাগুক্ত। পৃ : ৭৯
৭ . প্রাগুক্ত। পৃ : ৭৮
কবি, কথাকার ও এম. ফিল গবেষক।