এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়
মনিরা মিতা
ডাস্টবিনের ময়লা আর্বজনা খেতে আসা কাকগুলোর কর্কশ কন্ঠের কা কা শুনতে শুনতে হেঁটে চলছে আব্দুল বাতেন আর তার স্ত্রী আজিরন। ঢাকা শহরের ল্যাম্প পোস্টগুলোর বাতি এখানো নেভে নাই। ব্যস্ত শহর একটু পরেই আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠবে, শুরু হবে কোলাহল। ফজরের নামাজ আদায় করেই আব্দুল বাতেন আর এক মুহূর্ত দেরি করে নাই, স্ত্রীর হাত ধরে বেড়িয়ে পরেছে পথে। গতরাতের ঘটনার পর এই শহরে থাকার ইচ্ছেটা তার একেবারেই মরে গেছে।
অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আব্দুল বাতেন স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়; গোলগাল ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে। এই শহর মাত্র দুটি বছরে মমতাময়ী এই মহিলাটির বয়স যেন বিশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে।
রক্তের টান যেমন বড় টান, তেমনি রক্তের অপমানও বড় অপমান। হ্যাঁ, গত দুই বছর ধরে বড্ড অপমানিত হয়েছেন এই বৃদ্ধ মানুষ দুটো। অনেক নির্ঘুম রাত পার করেছেন নিজ সন্তানের বাসায়। এই বয়সে এতো অপমানিত হতে হবে এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তারা।
রাফিদ তাদের বড় কষ্টের ধন। বিয়ের ৬ বছর পরও যখন তাদের সন্তান হচ্ছিল না তখন অজিরন বেগম অস্থির হয়ে যায়। স্বামীর হাত ধরে বহু ডাক্তার, কবিরাজ এমন কি মাজারে পর্যন্ত গিয়েছে। যে যা বলেছে তাই করেছে। নামাজের পাটির উপর রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছে, রোজা থেকেছে, মানত করেছে। অবশেষে আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন। বহু সাধনায় তার কোল আলো করে এসেছে রাফিদ।
ছেলেকে মানুষ করতে শহরে পাঠিয়েছে তারা, ভালো কলেজ- ভার্সিটিতে লেখাপড়া করিয়েছে। আর সেজন্য একে একে বিক্রি করতে হয়েছে ফসলের ক্ষেত। শেষ সম্বল ভিটে বাড়িটাও বিক্রি করে ছেলের হাতে টাকা দিয়েছিল নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। ছেলের চাকরি হয়েছে, সংসার হয়েছে। ছেলের ইচ্ছে অনুযায়ী বৃদ্ধ বাবা-মা এসে উঠেছে ছেলের সংসারে।
ঢাকা শহরে আসার এরপর থেকে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। এ জীবনের প্রতি পদে পদে অপমান আর অপদস্ত। সকাল হতে না হতেই বৌমার চিৎকার শুরু হয়। কেনই বা হবে না! সকালে তাদের অফিসে যাবার তাড়া তার উপর আবার বাড়তি এই মানুষ দুটোর ঝামেলা, যদিও কাজের মানুষ আছে তবুও বাড়তি বৃদ্ধ মানুষ দু’টোর চেহারা সহ্য করাও কি কম কষ্টের!
বৌমার উঁচু গলার আওয়াজ আব্দুর বাতেন আর আজিরন বেগমের কানের গহব্বরে প্রতি নিয়ত গরম সিসার মতো ঢুকে পরে। অফিস থেকে ফিরেই আবার শুরু হয় অশস্তি। এই বৃদ্ধ দুটি মানুষ সারাক্ষণ তার ঝগড়ার কারন হয়ে দাঁড়ায়। আজিরন বেগম মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠে, বলে ‘চলেন আমার গ্রামে ফিরা যাই।’
‘গেরামে কই যামু রাফিদের মা? গেরামের সব কিছুই বেইচা দিছি, ওইহানে গিয়া কই থাকুম?’
‘আইচ্ছা ঐ যে সরকার গুচ্ছ গেরাম বানাইছে ওইহানে একটু ঠাঁই হইবো না আমাগো!
আর নয়ত চলেন বৃদ্ধাশ্রামে চইলা যাই। ওইখানে শুনছি আমাগো মত অসহায় মাইনষের থাকনোর জায়গা দেয়, খাওন দেয়।’
স্ত্রীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আব্দুল বাতেন বলে- ‘বউের উপর রাগ কইরা পোলার শাস্তি দিবা রাফিদের মা? আমরা এমনে চইলা গেলে মাইনষে আমাগো পোলারে মন্দ কইবো। পরের মাইয়া যাই করুক আমাগো পোলায় তো কিছু করে নাই হেই তো আমাগো ভালা পায়।’
‘হ, ভালা পায়। বিবির সামনে ভেড়া হইয়া যায় আপনের পোলায়। একবার ও বাপ-মার খোঁজ নেয় না। বিবির কথার প্রতিবাদ করে না।’
‘অশাস্তির ভয়ে কয় না কিছু, আমরা আর কয়দিন আছি কও, সহ্য করো রাফিদের মা আল্লাহ’য় একদিন মুখ তুলে চাইবো।’
‘হ, আল্লায় য্যান তাড়াতাড়ি চায়। দুনিয়ার থেইক্কা যাইতে পারলেই সব অশাস্তি ফুরাইবো।’
ঢাকা শহরে খাঁচায় বন্ধি পাখির মত ছটফট করতে থাকে অসহায় মানুষ দু’টি। গ্রামের মেঠোপথ, ক্ষেতের আইল, কঁচি ঘাস, সজনে গাছ, পুঁয়ের লকলকে ডোগা, গোবর লেপা উঠান, পাটের আঁশের গন্ধ, মজা পুকুর এসব কিছুর জন্য তাদের মনটা অনচান করে। ছুটে গ্রামে চলে যেতে মন চায় কিন্তু পারে না। তাদের শরীর থাকে এই বন্ধি খাঁচায় আর মন পরে থাকে গ্রামের চিরচেনা বাড়ির আঙ্গিনায়।
রাত প্রায় একটা বাজে। আব্দুল বাতেন শ্বাস নিতে পারছে না, তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুকটা পাথরের মত ভারি হয়ে আসছে। স্বামীর অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ডাকতে যায় আজিরন বেগম। ছেলেকে ডাকতেই খেকিয়ে ওঠে ছেলের বৌ।
‘এতো রাতে কি চাই! আপনাদের জন্য কি একটু ঘুমাতেও পাবো না?’
‘রাফিদ তাড়াতাড়ি এদিকে আয়, তোর আব্বা য্যান কেমন করতাছে।’
‘আহা! ঘরে যান তো, সে এখন যেতে পারবে না।’
আজিরন বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে তার বোবা সেজে আছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না।
রাফিদের মা আর কিছু না বলে দ্রুত স্বামীর কাছে ফিরে আসে। তেল গরম করে স্বামীর বুকে মালিশ করে। গরম তেল আর গরম চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর রাফিদ আসে। হয়ত সন্তান হিসেবে বিবেক তাকে ধাক্কা দিয়ে এখানে আনে। যদিও ওর মায়ের সন্দেহ হয় ওর ভিতর বিবেক বলে কিছু আছে কি না! নাকি পুরোটাই স্ত্রীর কষাঘাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
বাবার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় রাফিদ। হঠাৎ বাবা মারা গেলে সবাই তাদের সন্দেহ করতে পারে কেননা আশেপাশের সবাই তার বাবা- মায়ের সাথে বউয়ের খারাপ ব্যবহারের কথা জানে। এমন কি মাঝে মধ্যে দু’একজন প্রতিবাদও করছে কিন্তু তার বউ এসব গায়ে মাখে নাই বরং উল্টো তাদের উপর চড়াও হয়েছে।
বাবার বুকের ব্যথা আরও বেড়েছে দেখে বাবাকে হাসপাতালে নেয় রাফিদ। ডাক্তার ইমারজেন্সি রোগী দেখে অপেক্ষা না করে আইসিইউতে নিয়ে যায়। প্রথম প্রথম রাফিদ ভাবে এসব ডাক্তারদের বাড়াবাড়ি, টাকা কামানোর ফন্দি।
কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। চিকচিকে ঘাম উঁকি দেয় সে ভাঁজে।
ওদিকে আজিরন বেগম হাসপাতালের বারান্দায় জায়নামাজে বসে পরেন।
রাফিদ থেকে থেকে পায়চারি করছে, কিছুক্ষণ পর পর তার ফোনটা বেজে উঠছে আর রাফিদ কেটে দিচ্ছে। সে জানে এজন্য তার কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে তবুও কল ধরে ঝাঁঝালো গলা শোনার ইচ্ছে তার এই মুহূর্তে হচ্ছে না।
পরদিন বেলা ৮টার দিকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো।
‘ডাক্তারসাব কি হইছে তেনার? উনি ভালা হয়ে যাইবেন তো?’
‘আপনার সাথে আর কে আছে?
‘জি, আমি ওনার ছেলে।’
‘আমার সাথে চেম্বারে আসুন।’
ডাক্তারের রুম থেকে ফিরেই রাফিদের চেহারা ফ্যাকাসে দেখায়।
‘কিরে বাজান কি কইলো ডাক্তার? তোর আব্বা ভালা হইয়ে যাইবো তো?’
‘হ্যাঁ, তুমি চিন্তা করে না।
কয়েকদিন পর আব্দুল বাতেন একটু সুস্থ হয়। ডাক্তার তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। এখন তার সঠিক যতœ দরকার, পরিবারের সবার ভালোবাসা দরকার। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও হার্টের অপারেশন জলদি করাতে হবে নইলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রাফিদ তার বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা বাড়ি কোথায়? আব্দুল বাতেনের কাছে এটা দোযখ মনে হয় যেখানে প্রতিমুহূর্তে জ্বলছে তার স্ত্রী, ছেলে আর সে।
আগে তাও বৌমার উচ্চ আওয়াজের বিপরীতে ছেলের নিচু গলার আওয়াজ শোনা যেত যা তাদের অসহায় মনকে একটু শান্ত¡না দিত কিন্তু ইদানিং সেটাও বন্ধ। প্রথম প্রথম ছেলের উপর অভিমান হলেও এখন ওর প্রতি মায়া হয়। বেঁচে থেকেও প্রতিদিন যে পুরুষের আত্মা পুড়ে যায় তার মত দুর্ভাগা আর কে আছে? আব্দুল বাতেন শিক্ষিত মানুষ না তবুও বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতন নিয়ে বহু আলোচনা হতে শুনেছেন কিন্তু কখনও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে শোনেননি। তাহলে তার ছেলের এই অবস্থাকে তিনি কি বলবেন? শরীরে হাত তুললে সেটা নির্যাতন আর মানুষিকভাবে প্রতিমুহুর্তে কুচিকুচি করে কাটলে সেটার কি নাম দেওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না আব্দুল বাতেন।
রাত তখন প্রায় একটা, আব্দুল বাতনের চোখে ঘুম নেই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর ঘরের ভেতর বইছে ঝড়। সে ঝড়ের গর্জন নিজ রুমে শুয়েও শুনতে পায় আব্দুল বাতেন আর আজিনর বেগম। প্রচন্ড ডাক পরার আওয়াজে ছোট বাচ্চা যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে আজিরন বেগমও তেমনি কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওঘর থেকে ভাঙ্গচুরের শব্দ আসছে সাথে বৌমার চিৎকার।
‘আস্তে কথা বলো সাথী। বাবা-মা শুনবে।’
‘শুনতে পেলে কি হ্যাঁ! শুনুক তারা। তাদের শোনার জন্যই বলছি।’
‘সাথী চুপ করো বলছি, বাবা অসুস্থ।’
‘বুড়ো বয়সে অসুস্থ হবেন এটাই স্বাভাবিক আর কত দিনই বা বাঁচবেন? এমনিতেই তো মরার বয়স হয়েছে তাহলে এতো টাকা নষ্ট করে হার্টের অপরেশন করানোর কি দরকার?’
‘উনি আমার বাবা। সে আমাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। তাছাড়া তোমার বাবার উচ্চাকাঙ্খা মেটাতে গিয়ে আমার বিয়ের জন্য ভিটেমাটি পর্যন্ত বেঁচে দিয়েছেন। এখন আমি না দেখলে কে দেখবে? কোথায় যাবেন তারা বৃদ্ধ বয়সে?’
‘উনি যা করেছেন তা সব বাবারাই করে এটা তার দায়িত্ব ছিলো। আর যাওয়ার জায়গা নেই কে বলেছে, ওনাদের মতো বোঝা নিরাপদে রাখার জন্যই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে। ওনাদের নিয়ে তোমার এতো ইমোশনাল হবার কি আছে আমি বুঝি না।
‘তুমি এটা বুঝবেও না সাথী কারন তোমার সে মনই নাই। আর আমি কখনো তাদের বলতে পারবো না তোমরা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাও। তারা এখানেই থাকবে আর আমি বাবার অপারেশন করাব।’
‘বাজে কথা বলবে না রাফিদ। আমি ফ্ল্যাটের বুকিং দেব। ঢাকা শহরে আর কতদিন এভাবে ভাড়া গুনবো? বহু কষ্টের টাকা এভাবে নষ্ট করতে দেব না। আর কান খুলে শুনে রাখ, আমিও চাকরি করি সুতরাং টাকা তোমার একার না আমারও সমান অংশ তাই এই অপারেশন আমি হতে দেব না।’
‘ফ্ল্যাট পরেও কেনা যাবে কিন্তু বাবা ...’
‘আহ্ ...... আর কোন কথা শুনতে চাই না। আমি এই অপারেশন করাতে চাই না। এনিয়ে আর কোনো তর্ক আমি শুনতে চাই না। এরপরও যদি তুমি বাড়াবাড়ি করো তাহলে আমি আগুন লাগিয়ে দেব তোমার সংসারে তারপর চিরতরে চলে যাব বাবার বাড়ি আর তুমি সারাজীবন পরে থাকবে ওই বুড়ো দুটোকে নিয়ে।’
এবার রাফিদের গলা আর শোনা গেল না। হয়ত এবার আর প্রতিবাদের ভাষা নেই তার কাছে।
ছেলে-বৌয়ের ঝগড়া শুনে মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে আজিরন বেগম।
‘কাইন্দো না রাফিদের মা। আমাগো সাথে আল্লাহ্ আছেন তিনি সব ঠিক কইরা দেবেন। আমার হার্টের অপারেশ লাগবো না, দেইখো আমি এমনই ভালা হইয়া যামুনে। তয় আমার যদি টাকা থাকতো ডাক্তাররে কাইতাম বৌমার বুক অপরেশন কইরা দেখতে ওইখানে কি সত্যিই হৃদয় বইলা কিছু আছে আছে নাকি পুরাটাই পাথর?’
‘রাফিদের আব্বা আমি আর এইহানে থাকমু না। আপনি আমারে অন্য কোনহানে নিয়া চলেন। এইহানে আমার দম বন্ধ হইয়া যাইতাছে।’
‘যাইবা রাফিদের মা! গাছতলায় থাকবার পারবা? এহন তো আমি পথের ফকির, তোমারে দুইবেলা খাওয়াইতেও পারমু না।’
‘হ, পারমু। এই দালানে থাকার চাইতে গাছতলায়ও শান্তি পামু। এতো অপমানের গোশতো ভাতের চাইতে নিঝগড়ার উপসোও ভালা।’
চারিদিকে এখন আলো ফুটছে, ফুরফুরে বাতাস বইছে। আব্দুল বাতেন স্ত্রীর হাত ধরে পার্কের একটা বেঞ্চে এসে বসলো। কৃষ্ণচূড়া গাছে লাল ফুল ধরেছে, গাছে গাছে পাখি ডাকছে। প্রকৃতি আজ বড্ড সুন্দর আয়োজন করেছে যেমনটা করেছিলো বহু বছর আগে তাদের বিয়ের সময়।
অজিরন বেগম স্বামীর কাধে মাথা রেখে বসে আছেন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, বাতাসে তার ঠোঁট কাঁপছে। আব্দুল বাতেন পরম মমতায় স্ত্রীর মাথায় হাত রাখেন। আজিরন বেগম চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকায়, চার দেওয়ালের বন্ধিশালা থেকে মুক্তির আনন্দে দুজনের চোখেই তৃপ্তির হাসি উছলে পড়ে।
অফিসে যাবার আগে রাফিদ বাবা- মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে তারা ঘরে নেই। বুকটা কেমন ধক্ করে ওঠে ওর, মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন তাদের পাওয়া যায় না তখন রাফিদের বুঝতে বাকি থাকে না আসল ঘটনা। বাবা-মা তাদেরকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে, দূরে বহুদূরে।
রাফিদের মুখটা কালো হয়ে যায়, শুক্নো বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বাবা-মা তাদেরকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে এটা মানতে কেন জানি কষ্ট হয় তার।
ওদিকে সাথী খুব খুশি আজ, নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হয় আর কোন বাড়তি ঝামেলা নেই তার সংসারে, এখন কেবল সুখ আর সুখ। এই সুখবরটা মাকে জানাতে কেবল মোবাইলটা হাতে নেয় সে ঠিক এমন সময় বোনের ফোন আসে। রিসিভ করেই সাথী হাসিমুখে বলে ‘জানিস আজ আমার সব দুশ্চিন্তা শেষ হয়েছে। আমার শ্বশুড়- শ্বাশুড়ি আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’
ঠিক তখনি ওপাশ থেকে বোনের কান্না শুনতে পায় সাথী।
‘আপা, মা খুব অসুস্থ। হসপিটালে নিতে হবে তুমি জলদি চলে আসো।’
কথাটা শোনা মাত্রই সাথীর পুরো দুনিয়াটা কেঁপে উঠলো, আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথায়। মা তাদের দুই বোনের একমাত্র সম্বল।
বছর খানিক আগে হঠাৎ করে বাবাকে হারিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরেছে দুই বোন। ছোট বোন এখনো লেখাপড়া করছে। মায়ের আর বোনের সমস্ত দায়িত্ব সাথীর উপর। মা থাকবে না একথা সে চিন্তাও করতে পারে না।
সাথী দ্রুত মায়ের কাছে ছুটে যায়। দুইদিন পর শুকনো মুখে ফিরে আসে হসপিটাল থেকে। হার্ট অ্যাটাক করেছে তার মা, এখনই অপরেশন করাতে হবে। অনেক টাকা দরকার।
ফ্ল্যাট কেনার টাকাগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাথী। ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া ছিলো তার স্বপ্ন অথচ আজ তার সে স্বপ্নের ইতি ঘটবে। তবুও সাথী তৃপ্তির হাসি হাসে কেননা সন্তান হিসাবে সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে।
তার স্বপ্ন থেকে তার মা অনেক বড়। সুতরাং সে তার স্বপ্ন দিকে তাকায় না; তাকায় তার মায়ের দিকে।
সাথীর মুখে আজ অনেকদিন পর হাসি ফুটেছে। আজ তার মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওর বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর সরে গিয়েছে, মা হারানোর যন্ত্রণা তাকে পেতে হয়নি এটাই আল্লাহ্ কাছে অনেক শুকরিয়া।
হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের মালিক ফোন করে। অপমানিত হবার লজ্জায় সাথীর দু’চোখে পানি চলে আসে, ভয়ে ভয়ে বলে ‘ভাই আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে ফ্ল্যাট কেনার টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমরা ফ্ল্যাট নিতে পারছি না, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন।’
ঠিক তখনই ওপাশ থেকে হাসির রোল পড়ে যায় ‘কি বলছেন ম্যাডাম, আপনারা তো প্ল্যাটের পুরো টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। আপনারা চাইলে যে কোন সময় ফ্ল্যাটে উঠতে পারেন। সময় করে এসে কাগজপত্র নিয়ে যাবেন।’
কথাটা শুনে রাফিদ আর সাথী দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেল। এ কি করে সম্ভব? নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে, হয়ত ভুল করে তাদেরকে ফোন করেছে। ওনার ভুল ভাঙ্গানো দায়িত্ব নিয়ে দুজনে দ্রুত চোখের নিমিষে ছুটে যায় ফ্ল্যাটে।
ফ্ল্যাটের মালিক রাফিদ আর সাথীকে দেখে মুখে একটা চওড়া হাসি এনে দৌড়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র নিয়ে আসে। কাগজে চোখ বুলিয়ে দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
হ্যাঁ, তাইতো ফ্ল্যাটের মালিকানায় রাফিদের নাম লেখা কিন্তু এ কী করে সম্ভব! একটি টাকাও দেয়নি তারা তাহলে কি করে হলো এসব? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে দুজনের মনে। এমন সময় রাফিদ একটি চিঠি দেখতে পায়, সে এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা শেষ করে।
চিঠিটা পড়ে রাফিদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়, পা দুটো টলতে থাকে। যে মানুষ দুটোকে তারা এত অবহেলা করেছে, এতো কষ্ট দিয়েছে তারাই কি না বাবার অপারেশন না করিয়ে ফ্ল্যাটের টাকা বুকিং দিতে চেয়েছে আর সেই বাবা তার জন্য এই ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে কিন্তু এ কি করে সম্ভব? যে বাবাকে নিঃস্ব অসহায় ভেবে সাথী দিনের-পর-দিন কটাক্ষ করেছে কটুক্তি করেছে সেই বাবা তার তিল তিল করে গচ্ছিত টাকা দিয়ে রাফিদের স্বপ্ন পূরণ করেছে।
রাফিদের দু’চোখে বান ডাকে। মা-বাবার প্রতি করা অন্যায়ের অনুতপ্তে তার বুকের ভেতরটা ফেটে যায়। যে মানুষ দুটোকে এত অবহেলা করেছে একটা মুহূর্ত যাদেরকে শান্তি দেয়নি সেই মানুষ দুটোই তাদের শান্তির জন্য গোপনে এতো কিছু করেছে!
বাবার হার্টের অপারেশন করা জরুরি অথচ তার পরিবর্তে বাবা; না, আর ভাবতে পারে না রাফিদ। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, সাথীও তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। রাফিদ আর সাথী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়, পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে বাবা-মাকে। শহরে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ায় কিন্তু কোথায় তার বাবা- মা?
রাফিদ মনে মনে বলে বাবা-মা তোমরা একটি বার ফিরে আসো তোমাদের মাথায় তুলে রাখবো। তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। মা তুমি কোথায়? বাবা তুমি কোথায়? কিন্তু এই অচেনা শহরের প্রতিটি দেওয়ালে সেই কথা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে শুধু ফিরে আসে না বাবা-মা।
হারিয়ে যাওয়া মানুষকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু আতœ গোপনে থাকা মানুষকে কি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়?
শিরোমনি, খুলনা।