প্রিয়তমার শেষ স্পর্শ
তারেকুর রহমান
আম্মু, আম্মু, কই তুমি?
কিরে এত চেঁচাচ্ছিস কেন?
চেঁচাবোনা? তুমি এখনো রেডি হওনি। কখন আমরা বিয়েতে যাবো।
আচ্ছা রেডি হচ্ছি। তোর আব্বুকে ফোন দিছোস? অফিস থেকে বের হয়েছে?
ফোন দিছি, আব্বু বের হচ্ছি, বের হচ্ছি বলছে এক ঘণ্টা যাবত।
তার কি এসবের খেয়াল আছে? সারাদিন থাকে শুধু অফিস নিয়ে।
সালেহা বেগম তার মেয়ে নিতুর সাথে কথা বলছে। নিতুর এক চাচাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবে। রেডি হতে দেরি হচ্ছে দেখে নিতুর শাসানি শুনছে। মেয়ের আদুরে শাসন সালেহা বেগমের বেশ ভালো লাগে। সচরাচর বিয়ের অনুষ্ঠানে তার যাওয়া হয়না। সংসার সামলাতে সামলাতে আর সামাজিকতা রক্ষা করা হয়না। তাছাড়া নিতুর বাবা এত বেশি ব্যস্ত থাকে তাদের আর কোথাও যাওয়া হয় না। দ্রুত রেডি হতে হবে না হয় মেয়ের বকা শুনতে হবে। সালেহা বেগম একটা লাল রঙের শাড়ি পরলো। এটা সম্ভবত কোন এক বিয়ে বার্ষিকীতে নিতুর বাবা গিফট করেছিলো। সালেহা বেগমের এখন আর সেই ইচ্ছা ও নেই। আগে তার খুব সাজতে ইচ্ছে হতো। খুব ইচ্ছে হতো একটু সেজেগুজে কোথাও ঘুরতে যেতে। কিন্তু স্বামীর ব্যস্ততার কারনে সব ইচ্ছার জলাঞ্জলি দিতে হয়ছে। কখন যে তার ইচ্ছেগুলো মেঘে ঢেকে গেছে তা টেরই পায়নি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকআপ ঠিক করছেন তিনি। নিতু এসে ধমকের সুরে বললো,
আম্মু রেডি হয়েছো?
এইতো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আম্মু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
তোর মা তো তাই বলছিস।
না আম্মু, সত্যিই সুন্দর লাগছে। ও তুূমি ফিংগার রিং পরো নাই?
আংটি কোথায় রাখছি তাওতো মনে নাই।
তাড়াতাড়ি খুঁজে পরে নাও।
আচ্ছা ঠিক আছে।
সালেহা বেগম আংটি খুঁজতে লাগলেন।
এই ড্রয়ার, ওই ড্রয়ার খুঁজতেই আছে। ইদানীং তার কোন কিছুই মনে থাকেনা। অবশ্য ইদানীং বললে ভুল হবে আগে থেকেই সে একটু ভুলোমনা ছিলো। অনেক্ষণ পর আংটির বাক্সটা পেলো। এই বাক্সে তার নানারকম আংটি রয়েছে। সালেহা বেগম খুঁজতে লাগলেন কোন আংটিটা পরবেন। একটা আংটি হাতে নেয়ার সাথে সাথে তার বুকের ভেতর মোছড় দিয়ে উঠলো। এতদিন পর এই আংটি হাতে নেয়ার পর তার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। এই আংটির একটা ইতিহাস আছে। এটার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি।
পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি করার খুব ইচ্ছে ছিলো। চাকরি পাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। এদিকে নানান জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। মেয়ে শিক্ষিত, ফ্যামেলি ভালো হওয়ায় অনেক ভালো ভালো জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে লাগলো। একটা প্রস্তাব আসলো, ছেলে শিক্ষিত তার ফ্যামেলিও শিক্ষিত। বাবা মসজিদের ইমাম। ছেলে একটি বেসরকারি চাকরি করে। ছেলের সব পছন্দ হয় কিন্তু তার যে চাকরি তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হবে। ছেলেটাকে সবার পছন্দ হয়, সালেহা বেগমের ও পছন্দ হয়। মানুষ যা চায় সবতো পায়না। কিছু কিছু জায়গায় ছাড় দিতে হয়। মা এসে বললো, সালেহা দেখ হয়তও ছেলেটার ইনকাম কম কিন্তু সেতো শিক্ষিত, ভদ্র, তাছাড়া ফ্যামেলিও ভালো মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় এখানেই আত্মীয়তা করা ভালো হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে বিয়ে হয়ে গেলো। ফাহিম হলো সালেহার স্বামী। বাসর রাতে ফাহিম অনেক কান্না করে। মধ্যবিত্তের টানাপড়েনের কারনে লাইফের কোন কিছুই তার পাওয়া হয়নি। সালেহাই ফাহিমের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। বাসর রাতে ফাহিম সালেহাকে একটা আংটি গিফট করে। এই আংটি কিনতে অনেক কষ্ট হয়েছে এ গল্প অবশ্য সালেহা বিয়ের কয়েকদিন পর জানতে পেরেছে।
দুজনেই সংসার শুরু করলো। একদম শূন্য থেকেই শুরু হলো তাদের সংসার। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া কিছু জিনিস নিয়ে তারা নতুন বাসায় উঠলো। ছোট বাসা হলেও বেশ সুন্দর বাসা। বাসায় কোন খাট ছিলোনা। ফ্লোরিং করেই দুজন ঘুমাতো। জানালায় পর্দা হিসেবে সালেহার ওড়না আর গামছা ব্যাবহার করতো। আস্তে আস্তে তারা সংসার গোছাতে লাগলো। অল্প আয় দিয়ে খুব হিমসিম খেতে হতো। কোনো এক মাসে বাসার জন্য কোনকিছু কিনলে সে মাস তাদের অনেক কষ্টে যেতো। স্ত্রীকে কোন কিছু দিতে না পারার কারনে ফাহিমের মধ্যে অনেক আফসোস কাজ করতো। তারপর ও এই টানাপড়েনে অল্প কিছু হলেও স্ত্রীকে কিনে দেয়ার চেষ্টা করতো। প্রথম যেদিন তাদের সংসারে খাট আসে সেদিন তাদের আনন্দকে দেখে। আস্তে আস্তে বাসায় ফ্রিজ ও এলো। ফাহিম বাজার করে আনলে সালেহা সব কিছু ভাগ করে রাখতো। দুই পিছ করে মাছ ভাগ করে রাখতো। এক কেজি মাছ দিয়ে অনেকদিন চলে যেতো। ফাহিমের খুব শখ ছিলো স্ত্রী যেন সবসময় সেজেগুজে থাকে। সালেহা ছিলো বরাবরের মতো এসবে উদাসীন। সালেহা ভুলোমনা টাইপের ছিলো। অন্যদিকে ফাহিম ছিলো সিরিয়াস টাইপের। তার সব কিছু মনে থাকতো। কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দিতোনা। বাসায় আসলে অবশ্য সে অলস হয়ে যেতো। এ নিয়ে সালেহার সাথে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে। সালেহাকে বাপের বাড়ি ে যেতে দিতোনা। ফাহিম বলতো, সালেহা চলে গেলে এই একলা ঘরে সে থাকতে পারবেনা। একাকীত্ব নিয়ে তার অনেক ভয় ছিলো। দু’জনের ভালবাসার কমতি ছিলোনা। সালেহা তার সারাজীবন এত কষ্ট করেনি যতটুকু কষ্ট করেছে এই সংসার নিয়ে। সে কখনো অভাব দেখেনি। কিন্তু এখানে অভাব নিত্যসঙ্গী। মাঝে মাঝে সে হাঁফিয়ে উঠতো। এরকম টানাপড়েনে থাকতে আর ভালো লাগেনা। কি এক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাদের ঝগড়া হয়। সালেহা রাগের মাথায় অনেক কথা বলে ফেলে। সালেহার কথা শুনে ফাহিম ভেঙ্গে পড়ে। এই হতাশাই যে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আজ যে তার স্ত্রী এই যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিলো। ফাহিম হু হু করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার মৃত্যু ছাড়া তোমার কোন মুক্তি নাই। যদি মরে যাই তবে তুমি এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পাবে। দুজনের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। রাতে সালেহা ফাহিমের কাছে ক্ষমা চায়। ফাহিম ও ক্ষমা চায়। ফাহিম সালেহাকে বললো।
-সত্যি আমি যদি মরে যাই কষ্ট পাবে?
-এসব কথা না বললে হয়না?
-বলোনা কষ্ট পাবে কিনা?
-কষ্টতো পাবোই। ওই কষ্ট সইতে পারবোনা।
-কিন্তু লাইফের এই গ্লানি থেকে তো মুক্তি পাবে। হা হা...
-আবার এসব? আমি কিন্তু কথাই বলবোনা।
-আচ্ছা ওসব বাদ, ওকে?
-ওকে...
মাঝেমাঝে ফাহিমের প্রচ- বুকের ব্যাথা উঠে। সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা। বুকের ব্যাথায় সে সারারাত ঘুমাতে পারেনা। সালেহা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। ফাহিম তাকে চিন্তা না করার জন্য বলে। এটা নেহায়েত গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা অন্য কিছু না। দুই তিন মাস পর একদিন মধ্য রাতে ফাহিমের বুকের ব্যাথা উঠে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাহিম কেমন যেন হয়ে গেলো। সে সালেহাকে ধরে কাঁদতে থাকে। সালেহা কি করবে বুঝতে পারছেনা। সালেহার কোলে মাথা রেখে হঠাত ঘুমিয়ে গেলো ফাহিম। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সালেহা ফাহিম ফাহিম বলে চিৎকার করছে। ফাহিম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তার নিথর দেহ পড়ে আছে সালেহার কোলে। এত দ্রুত একজন মানুষ হারিয়ে গেলো। ফাহিমের মৃত্যুর পর সালেহা বাপের বাড়িতেই আছে। তার অনেক শখ ছিলো বাপের বাড়িতে বেড়ানোর। এখন সে শখ পূরণ হচ্ছে। যে মানুষটা একা থাকতে চাইতোনা। সে কিভাবে সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকছে? সালেহা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ফাহিমের মৃত্যুর পরের পৃথিবীটা আরো অনেক কঠিন হয়ে গেলো সালেহার জন্য। সবাই কেমন যেন করুণার দৃষ্টিতে দেখতো। সালেহার আবার বিয়ে হয়ে গেলো। বেশ বড়লোকের সাথে। বয়সে অনেক ফারাক থাকলে ও তার টাকার অভাব নাই। আগে এক বিয়ে করেছেন। স্ত্রী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। স্ত্রীর দুঃখে অনেক দিন বিয়ে করেননি। সালেহার দুঃখ গুলো গুছতে লাগলো। তার সব চাহিদা পূরণ হয়ে গেলো। আগের কষ্টের স্মৃতি গুলো ভুলেই েেগছে। ফাহিমের কথা তার তেমন মনে পড়েনা। এত সুখের মাঝে অতীতের দুঃখকে মনে রাখার কি দরকার। তবে এখানে অনেক কিছু থাকলেও ভালবাসার বড্ড অভাব। সারাদিন স্বামীর ব্যস্ততা সালেহাকে কষ্ট দিতো। সে স্বামীকে একটু কাছে চাইতো কিন্তু স্বামী শুধু ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকতো। বাপের বাড়ি গিয়ে মাস খানেক থাকলেও কিছু বলতোনা। সালেহা নিজ থেকে না গেলে তাকে নিয়ে যেতোনা। সালেহার খুব ঘুরতে ইচ্ছে করতো, সাজতে ইচ্ছে করতো। এইসব ইচ্ছের দাম তার স্বামীর কাছে নাই। সুখের জন্য যতটাকা লাগবে সে দিতে প্রস্তুত। স্ত্রীকে সময় দেয়ার মতো সময় তার নাই। সালেহার কোলজুড়ে আসে মেয়ে নিতু। নিতুকে নিয়েই তার পৃথিবী। এত টাকাপয়সা এত কিছু, একটা সন্তানের শখ তাও পূরণ হলো তারপর ও কি যেন নাই সালেহার জীবনে। হয়তও মানসিক সুখ। মানসিক সুখটারই অভাব তার জীবনে। অথচ ফাহিমের টাকা ছিলোনা আর সবই ছিলো। ভালবাসার কমতি ছিলোনা। টাকাই কি সুখ দিতে পারে? সালেহা উত্তর খুঁজে পায়না।
-মা তাড়াতাড়ি চলো।
মেয়ের কথা শুনে সালেহা বেগম দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো। ফাহিমের দেয়া আংটিটা পরেই বের হলো। আর কখনোই হয়তও এই আংটি পরা হবেনা। শেষবারের মতো স্মৃতিটুকু স্পর্শ করলো সালেহা বেগম।