নিমফুল
নেহাল অর্ক
রিক্সা থেকে নেমেই পুথি নিজের ব্যাগ থেকে একটি বিশ টাকার নোট চালককে দিলো ; ততক্ষণে ভিজে জবুথবু অবস্থা তার। ক’দিন ধরে বৃষ্টিতে নাকাল নগরবাসী। সারা শহর খানাখন্দে পরিপূর্ণ, ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আষাঢ় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজির হয়েছে প্রকৃতির মাঝে; যদিও মানুষ এবারের বর্ষা বন্দনার কথা ভুলেই গেছে। তবে কিছুদিনের বৃষ্টিতে বর্ষা আসবে আসবে ভাব। প্রকৃতি কখনও বঞ্চিত করে না মানুষকে; নিজের নিয়মেই সবসময় উদারভাবে দিয়ে যায় তার দান, আমাদের বুঝতে ভুল হয় কেবল। এসব ভাবনার মাঝেই ভেজা কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকে পুথি নিজের রুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে। পুথির মা তখন এককাপ চা নিয়ে এসে বলে,
“তোকে বলেছিলাম আজ বাহিরে না যেতে কিন্তু কে শুনে কার কথা!” একটা অভিমান নিয়ে পুথির মা চায়ের কাপটা রেখে চলে যাবে এমন সময় পুথি তার মাকে জড়িয়ে ধরে,
“সরি মা, রাগ করো না। রাতুলের একটা সমস্যা ছিলো তাই যেতে হলো।”
“সমস্যা কি শেষ হলো?” পুথির মা জানতে চায়।
শেষ হয়েছে, তবে ওদের এই বাসা থেকে চলে যাওয়া ছাড়া এই সমস্যা চলতেই থাকবে; পুথির জবাবের পর আরও কিছু কথোপকথনের মাঝে কোনো রাকডাক না রেখে মা পুথিকে বলেই ফেললো,
“তুই কি তাহলে রাতুলকেই বিয়ে করবে?
জানি না মা, আমি কারো উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না; যদি কেউ নিজে থেকে আমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তবেই আমি তার হতে রাজি। আমি রাজার মতো নিতে পছন্দ করি, মা। সেটা দূর্বাঘাস হলেও আমার কাছে তার ঢের মূল্য আছে কিন্তু ভিখারির মতো রাজ্য নিতেও আমার বাধে। এসব কিন্তু আমি শিখেছি তোমার শিক্ষা আর বাবার ব্যক্তিত্ব থেকে; বলেই পুথি মাকে একটু মৃদুহেসে জড়িয়ে ধরে। অনেক সময় নিজের কষ্টগুলো প্রবল হলেও মানুষ তার আপনজনদের উপর আঁচ লাগতে দেয় না; সে কেবল নিজেই পুড়ে ছারখার হয়। পুথির কথায় একটু ধাক্কা খেলো মা; পুথির কাছে তার স্বামী সম্পর্কে শুনেই হয়তো এমনটা হলো। ঠিক আছে তুই বিশ্রাম কর, বলেই মা পুথির রুম হতে বের হয়ে গেলো।
তখনও সন্ধ্যা হতে কিছুটা বাকি; বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতা ছুঁয়ে মাটিতে পড়ছে; পাতা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশের দান আগলে রাখতে চেয়েও পারছে না, গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে নীচে। আসলে, যার গ্রহন করার ক্ষমতা যতটুকু এর বেশি সে ধরে রাখতে পারে না। প্রকৃতি তার প্রতিটি পরতে পরতে আমাদের জন্য তার কতো মূল্যবান শিক্ষা সাজিয়ে রেখেছে; এর কোনো শেষ নেই। উদাসীন বৃষ্টির ভাবনার সাথে পুথির মনে একটা হাহাকার এসে যোগ হয়। রাতুলের কথা মনে পড়ে খুব; আজ এতো বছর রাতুল আর আমি বন্ধুত্বের আবরণে নিজেদের সম্পর্কের গভীরতায় ডুব দিয়েছি কিন্তু তা এখনও নির্ভরতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া এতোসব প্রশ্ন ঝড়ের পূর্বাভাস দেয়। ভাবনার গভীরতার মধ্যেই দিনের আলো নিভে যায়; নিয়ন বাতির আলোক রশ্মি ভেদ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আরও বড় হয়ে দ্বিগুন বেগে মাটির বুকে পড়ে পড়ে ক্ষত তৈরি করছে; মাটি তার আপন নিয়মেই এই ক্ষতগুলো আড়াল করে ভেতরের ক্ষত পুষে রাখছে; যেনো এক অসীম বেদনার ভার বয়ে চলছে জীবনভর!
কলিং বেলের শব্দে পুথির ভাবনার জগতে একটা চির ধরে; ব্যালকনি থেকে সরতে চাইছে না পুথি; তাই মা-ই দরজাটা খুলে দিলো। একটা বিস্ময়ের বলিরেখা পুথির মায়ের চোখে মুখে দেখা দিলো। চিরচেনা ঘরের পরিবেশটা বদলে গেলো একমুহূর্তে।
পুথির মা কিছু বলতে পারলো না মুখে; পাথরের মতো শুধু দরজায় দাড়িয়ে রইলো। কি হলো মা? কে এলো? কিছু বলছো না যে? একসাথে এতগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিতে দিতে মায়ের কাছে এলো পুথি। এসেই দরজায় দাড়ানো একজন পুলিশ অফিসারকে দেখে পুথি কিছু বুঝতে পারছিলো না। বাড়িতে পুলিশের আগমনে পুথি বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে কৌতুহলী হয়ে উঠলো।
ভেতরে আসতে বলবেন না? পুথির মাকে লক্ষ্য করে এই প্রশ্নটা করলো পুলিশ অফিসার। পুথির মা কোনো জবাব দিতে পারলো না, কেবল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। বাহিরে ভারি বৃষ্টি; আকাশের বুক খালি করে বৃষ্টির ফোঁটা মাটির সাথে যে তাল তৈরি করছে কেবল সেই হাহাকার পুথির মায়ের কানে আসলো, আর কোনো শব্দ তাকে ছুঁতে পারেনাই। যেনো পৃথিবীর সমস্ত আয়োজন এক লহমায় নিরব হয়ে গেলো। বিধাতা কোনো কোনো সময় তার সৃষ্টিকে নিয়ে খুব খেলতে ভালোবাসে, তাই নিজেই মাঠ প্রস্তুত করে দিয়ে দর্শক সেজে বসে থাকে।
“অবশ্যই, ভেতরে আসুন’ বলেই পুথি তার মাকে দরজা হতে একটু সরিয়ে নিতেই পুলিশ অফিসার ভেতরে প্রবেশ করলো। পুলিশ অফিসার ঘরের ভেতরে ঢুকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ পুথির বাবার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালো। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ছবিটা খুব যতœ করে পুথির মা আগলে রেখেছে প্রায় বারো বছর ধরে। পুথির বয়স যখন আট বছর, তখন এমনই এক বৃষ্টিস্নাত ঝড়ের রাতে বাহির হতে তার বাবা আর ঘরে ফিরে আসেনি। আজও তার বাবার কোনো খোঁজ পায়নি তারা। দীর্ঘ বারোটি বছর পুথির মা বুকের ভেতর পাথর বেঁধে মেয়েকে আগলে ধরে বেঁচে আছে।
পুলিশ অফিসারকে দেখে মা এমন অস্বাভাবিক হলো কেন? এর আগেও অনেক পুলিশ অফিসার বাসায় এসেছে তার বাবার মামলার তদন্ত করতে ; তার মাকে যথেষ্ট সহায়তা করতেও দেখেছে সে কিন্তু আজ এই অফিসারকে দেখে তার মা কেমন হয়ে গেলো; কোনো হিসাব মিলাতে পারছে না পুথি। মাকে ড্রয়িংরুমে রেখে পুথি নিজেও সোফায় বসলো মায়ের সাথে। এমন সময রাতুল পুথির মোবাইলে একটা কল দিলো।
“তুমি আসো, আমি আসছি’ বলে পুথি ফোন কেটে দিলো। বেশ কিছু কথাবার্তার মাঝে পুলিশ অফিসার পুথির নামসহ আরো কিছু জিজ্ঞাসা করলে পুথি তার জবাব দিলো।
মা, আমি একটু যাবো আর আসবো। রাতুল আসছে; জাস্ট দেখা করেই চলে আসবো।
‘ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চলে এসো’; অনেকক্ষণ পর এই ক’টি কথা পুথির মায়ের মুখ হতে বের হলো।
ঠিক আছে মা, আমি আসছি বলে দ্রুতই বেরিয়ে গেলো পুথি।
শুনশান নিরবতা ঘরময় বিরাজ করছে; বাহিরে বৃষ্টির উলঙ্গ নৃত্য কিছুটা কমেছে। জানালার ফাঁকে বাতাসের সাথে বৃষ্টির নিমগ্ন খেলা প্রত্যক্ষ করছে পুথির মা। মুখোমুখি বসে আছে দুজন মানুষ তবু পিনপতন নিরবতায় নিঃসঙ্গ বেদীর তলে অজানা আশঙ্কার স্রোতে তীর ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো পুথির মা’র হৃদয় ভেঙে চলছে অবিরত।
কে আগে কথাটা শুরু করবে তা আর ঠিক করতে পারছিলো না কেউ। হঠাৎ পুলিশ অফিসার নিরবতা ভেঙ্গে বলে ফেললো, ‘মেয়েটা কি তোমার, শালিনী ?’
হ্যাঁ, একমাত্র মেয়ে; কেমেস্ট্রিতে অনার্স করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
‘সুখেই আছো তাহলে, শালিনী! এতোদিন পর্যন্ত একবারও আমার খবর নিতে মন চায়নি?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহুল কথাটা বললো।
শালিনী কোনো উত্তর না দিয়ে নতশিরে কেবল মেঝের উপর জীবনের ¯্রােতর ধারা বয়ে যাবার অগণিত রেখা গুনছে; এভাবে নিজের একটা অসম্পূর্ণ অতীত সামনে বসে থেকে নিজের মনের গভীরে চাপা পড়ে থাকা বেদনাকে খুড়ে খুড়ে তুলবে তা ভাবতে পারেনি শালিনী ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শালিনী জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কেমন আছো, রাহুল?
আছি, যতটুকু থাকলে আমার আমিকে চেনা যায়, ঠিক ততটুকু ; রাহুলের কথাটা শেষ না হতেই শালিনী আবার জানতে চাইলো,
‘তোমার স্ত্রী কি করে? ছেলে মেয়ে ক’জন? ওরা কি তোমার সাথেই থাকে?
একটা অট্টহাসি দিয়ে রাহুল বললো, এতোসব প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটার যে আগে উত্তর দেই তা বুঝতে পারছিনা। শালিনী অনেকদিন পর রাহুলের এই অকৃত্রিম হাসিটা চুরি করে একনজর দেখার সুযোগ পেলো। পৃথিবীর বুকে এমন কিছু সৌন্দর্য মাঝে মাঝে এসে হাজির হয়; তাকে সরাসরি দেখতে পারলেও লুকিয়ে দেখার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ থাকে; সেটা কেবল মনের গহীনে শান্ত ¯্রােতের মতো বয়ে যায়। তার কোনো তান্ডব নেই, তবে এটিই নদীর প্রাণে জল সিঞ্চন করে। কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে বাদাম খাওয়া, কথার ছলে রাহুলের প্রায়শই হেসে ফেলা; এইসব ভাবতে ভাবতে শালিনী এক নস্টালজিয়ায় ডুব দিলো।
কিছু ভাবছো শালিনী? মনে মনে ভাবছো তোমার সুখ নষ্ট করতে কেন আবার এলাম? ভয় পেয়ো না আমি তোমার সুখ নষ্টের কারণ অতীতেও ছিলাম না বর্তমানেও হবো না। রাহুলের মুখে কথাগুলো শুনে একটা নাড়া খেয়ে শালিনীর চেতনা ফিরে এলো।
‘কি হলো; কিছু বলবে না বুঝি?’ রাহুলের কাছে উল্টো শালিনী আবার আগের প্রশ্নটার উত্তর জানতে চায়। তোমার যদি বলতে বাধা থাকে দরকার নেই; শালিনীর এই জিজ্ঞাসায় একটা অভিমান আছে সেটা বুঝতে পারে রাহুল।
আমার এমন কিছু নেই যে বলার মতো। আমি খুবই একা; বলেই রাহুল কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলো।
একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস শালিনীর বুকের ভেতরে নোঙর ফেলা দীর্ঘ তেইশ বছরের সংসারের ভিতকে একমুহূর্তে টলিয়ে দিয়ে গেলো। কিছু বলতে পারছে না একটা তীব্র অভিমান আর ঘৃণায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শালিনী আবার বলতে লাগলো-
একা কেন? বিয়ে করোনি! এখানে কবে এলে? তারপর, আমার ঠিকানাই বা পেলে কীভাবে? এমন আরও কিছু কৌতুহলী প্রশ্নের মাঝে কথোপকথন চলতে থাকে দুজনের। গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে যেমন তীরভাঙ্গা ঢেউয়ের এক অনুরণন বাজে; তেমনি বহুদিন পর দেখা হওয়াতে এক পোড়া অতীত খুড়ে খুড়ে দুজনেই বেদনার মাঝে সুখ খুঁজতে থাকলো। শালিনীর মনে পুথির ফিরে আসার এক আশংকা মাঝে মাঝে উঁকি দেয়; তবুও কথোপকথনের প্রবাহে কোনো ছেদ পরেনি।
তোমার ঠিকানা খুঁজে পাওয়া অনেকটা নাটকীয় বলতে পারো, শালিনী। থানায় মামলার সব পুরনো ফাইল খুঁজতে খুঁজতে এই ফাইলটাকে আমার কাছে অনেকটা রহস্যজনক মনে হলো। লোকটা মিসিং এতোদিন কিন্তু কোনো তদন্ত হয় নাই; এই ঘটনার সুত্র ধরেই এই বাড়িতে আসা। আমি জানতাম না ভদ্রলোক তোমার স্বামী; এসে তোমার মুখোমুখি হতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।
শালিনী খানিকটা চুপ রইলো; কোনো জবাব দিলো না; খানিক পরে মাথা তুলে বললো, হ্যাঁ, কোনো তদন্ত হলো না কেন বুঝলাম না! আমি ও পুথি এটি নিয়ে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছি কিন্তু কুলকিনারা পাইনি।
আচ্ছা শালিনী, বলোতো যখন উনাকে পাওয়া যায় নাই তখন তো তুমি উনার ফোনে কল দিয়েছিলে? তখন যে লোক ফোনটি ধরেছিলো; তুমি কি লোকটিকে চিনতে পেেেরছিলে?
না রাহুল, চিনতে পারলে তো অনেক আগেই জট খুলতো এই রহস্যের।
ঠিক আছে, এতো বিচলিত হইও না ; যেহেতু আমি এখানে আছি এর রহস্য উন্মোচিত হবেই।
তারপর পুলিশের নিজস্ব কৌশলে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাঝে সময় কিছু কেটে গেলো। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে শালিনী উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকেই পুথি পুলিশের কাছে গিয়ে তার বাবার হারানোর রহস্য নিয়ে বিস্তারিত অনেক কথা বললো।
পুথি, কোনো চিন্তা করো না আমি এর রহস্য উন্মোচন করবোই; এবং এর শাস্তি নিশ্চত করবো। মা, তুমি স্যারকে কিছু আপ্যায়ন করো নি?
ঠিক আছে আপনারা বসুন, আমিই ব্যবস্থা করছি। পুথি উঠে গেলে শালিনী তার ডাগর দুটি চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রাহুলের দিকে। কী এক বেদনা ভরা অসাহায়ত্ব নিয়ে শালিনী তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা রাহুল বুঝতে পারে। রাহুলের মনের ভেতর তোলপাড় চলছে; মনে হচ্ছে একবার জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে শালিনীর কোমল চুলগুলোতে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে একটু আদর করে। নিয়তি তার নিষ্ঠুর খেলায় সারা জীবন মানুষকে জীবনের অংক সহজভাবে করতে দেয়নি; তাইতো মানুষ আজীবন তার দাস হয়ে আছে।
শালিনী তোমার দীঘল-কোমল চুলগুলি কি এখনও মাঝে মাঝে ছেড়ে দাও? এখনো কি বৃষ্টির দিনে গোলাপি শাড়ি পড়ে চুলগুলো খোঁপা বাঁধো; যা তোমার মরাল গ্রীবার একাপাশ ছুঁয়ে ছ্ুঁয়ে শোভা ছড়ায়? এরকম হাজরো প্রশ্ন মনে তোলপাড় করছে রাহুলের কিন্তু বলতে পারছে না; কোথায় যেনো বাধা। কিছু ঢেউ এমনিতে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আসে; তীর ভেঙ্গে জমি, ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কেবল পড়ে থাকে চিহ্ন। আজ অনাহুত তীব্র ঢেউয়ে রাহুলের সব যেনো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে; এখনও ঢেউয়ের তা-বলীলা শেষ হয় নি। জলের মধ্যে ভাসছে কেবল সাদা সাদা সফেন। খানিকপরে রাহুল নিজেকে সামলে নিয়ে অনেক প্রশ্নোত্তর শেষে বললো, ‘তোমার সব কথাই শুনলাম, শালিনী; কিন্তু যতীনকে তো আমার কাস্টডিতে নিয়ে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম।’
একটা বজ্রপাতের আওয়াজ যেমন কানের ভেতরে প্রবেশ করলে তার শব্দের ব্যপকতা নিরুপণ করা যায় না; যতীনের নামটা শালিনীর কানে আসতেই কানের ভেতরটায় এমন বিকট শব্দ হলো। কোনো উত্তর নেই, কেবল শালিনীর চোখ গড়িয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো।
‘আমার কোনো উপায় ছিলো না, রাহুল। মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে এর কোনো বিকল্প ছিলো না’ বলেই শালিনী হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো।
মায়ের কান্নার শব্দ শুনে পুথি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিতে লাগলো; কিছু সময়ের মধ্যে শালিনী নিজেকে সামলে নিয়ে পুথিকে আপ্যায়নের কিছু নিয়ে আসতে বললো। পুথি চলে যাবার পর শালিনী রাহুলকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমার অপরাধের যা শাস্তি হবে তা মাথা পেতে নেবো। তুমি সঠিক তদন্ত রিপোর্ট দাও; এ বিষয়ে আমার কোনো আর আপত্তি নেই। কিছু আত্মসমর্পণের ভেতর লুকিয়ে থাকে এক তীব্র অভিমান, শুধু অনুভুতি দিয়েই কেবল এর বিচার চলে। আদালতের কাঠগড়ায় তার বিচার করা যায় না।
সম্পর্কের যোগবিয়োগ কোনো কোনো সময় নিজের দায়িত্বটুকুর প্রতি চরম অবহেলা বয়ে নিয়ে আসে; এর থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। রাহুল শালিনীর মুখ হতে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে নিজেও খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো।
ঠিক আছে শালিনী, এই ফাইল আর কোনোদিন কেউ খুঁজে পাবে না; আমি এই ব্যবস্থা করবো। তুমি এ নিয়ে কোনো টেনশন করো না।
শালিনীর চোখ দিয়ে কেবল জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো। কোনো শব্দ নেই তার। আসলে, কিছু ভাঙার কোনো শব্দ থাকে না; কেবল অনুভব হয়।
কিছুক্ষণ পর পুথি একটি ট্রেতে করে খাবারের রকমারি আয়োজন নিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের সামনে দিলো। অফিসার কিছু নিলো, সাথে পুথিও। কথাপকথনের শেষ অংশে শালিনী রাহুলের মোবাইল নাম্বারটা চাইলো। রাহুল মোবাইল নাম্বারটা শালিনীকে দিয়ে বিদায় নিলো। গাড়ি পর্যন্ত মা-মেয়ে দুজনই রাহুলকে এগিয়ে দিয়ে আসলো।
শালিনী ঘরে ফিরে এসে দেখে সারাটা ঘর যেনো ফাঁকা; একটা তীব্র ঝড়ে সবকিছু উলাট পালট করে দিয়ে গেলো। আসবাবপত্র, বিদ্যুতের আলোতে আগের মতোই শোভা ছড়াচ্ছে কিন্তু আগের সেই প্রাণ নেই। রাহুল এসে এতো বছরের একটা অজানা আশঙ্কার শেষ করলো ঠিকই কিন্তু প্রাণটা কেড়ে নিয়ে গেলো।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ব্যাঙ ডাকছে আপন মনে আরও বৃষ্টির তৃষ্ণায়, সাথে ঝি ঝি পোকার ডাক; এক অভিমানী রাতের তীব্র দহনের মাঝে শালিনীর অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ পথহারা পথিকের মতোই ঠিকানা খুঁজে ফিরছে। রাতের অন্ধকারে নিয়ন বাতির আলোতে গাছের পাতার ভেজা উপরিভাগে শালিনী নিজের জীবনের প্রতিবিম্ব দেখছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। সাদা সাদা বুদবুদের মতোই চিন্তারা জাগছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা পর তার মোবাইলে একটা কল এলো। শালিনীর নামটা ধরে ডাকতেই জড়ানো কণ্ঠে সে বলে উঠলো ‘আবার কবে আসবে রাহুল..?’