অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
কতো দূর উত্তর
আরিফুল হাসান
যুদ্ধে আমরা উত্তর দক্ষিণ ভুলে গেছি। মাথার উপরে মৃত্যুর মেঘ, আর নিচে রক্তমাখা বৃষ্টি। হ্যাঁ, আমরা ছুটে চলছি নবজাতকের লাশের উপর পা রেখে। হয়তো পিতার লাশের সাথে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি মায়ের লাশের উপর। আমাদের বোনগুলোর লাশ আমরা কাঁধে বহন করে ছুটছি আর ভাইদের কবর দেবার সময় পাইনি। ছোট্ট শিশুটি কি হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো নাকি সহযাত্রীদের মধ্যে কমবয়েসী তরুণেরা পরিণাম চিন্তা না করে এগিয়ে গেলো অকস্মাৎ। আমরা অচিরেই আমাদের সামনে আকাশহামলা, স্থল ও জল হামলা হতে দেখি এবং অগ্রবর্তী দল অথবা হাত ফসকে যাওয়া শিশুটির লাশ দেখি ছিন্নভিন্ন হয়ে হয়ে উড়ে যেতে আকাশে অথবা লাশ দেখি নাÑদেখি সামনেই ভেঙে পড়ছে কোনো পনেরো তলা দালানÑকখনো পর পরÑএকাধিকÑঅনবরত। প্রচ- ধোঁয়া আর বিস্ফোরণে আমাদের কানে-চোখে তালা লেগে যায়। যখন চোখ খুলি দেখি আমাদের পথের চিহ্ন মুছে গেছে; আমরা আবার পথ হারাই।
মুর্ছাগত আমরা প্রায় যখন জেগে উঠি আমরা আবার ছুটি ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান আর পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকে থরথর। আমরা বুঝতে পারি, পালাতে চাইলেও পথ নেই। সব পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। তবু জীবনকে ভালোবেসে আমরা উত্তরের দিকে যাত্রা ঠিক করি কিন্তু ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ আমাদেরকে সূর্যের অবস্থান ঠাওরেও পথ চিনতে সায় দেয় না। আমাদের পায়ের নিচের পথ হারাতে থাকে; আমাদের জীবনের পথ হতে থাকে বঞ্চনা।
এভাবে আমাদের সব পথ হারাতে থাকলে আমরা হয়ে পড়ি পথ হারা পথিক এবং আমাদের কাঁধের উপর বোনদের লাশ আরও ভারি হয়ে উঠে। আমাদের পায়ে আর কোনো বল পাই না। আমরা যাত্রা থামাই না, কিন্তু আমরা পথচলার দিশাও যে পাচ্ছি এমনটাও নয়। ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে আমরা আন্দাজে পথ চলতে থাকে। প্রচ- ধুলিউড়া গর্জন আর বিমানের তোরজোর আমাদের দিগভ্রান্ত পথিকের মতো আচ্ছন্ন করে। আমরা অন্ধবধির এবং মুক হয়ে হেঁটে যাই।
এ অন্ধত্ব আমাদের নিজেদের আনয়ন। নিজেদের জান বাঁচাতে আমরা যেহেতু পথে নেমেছি এবং পথই যেহেতু আপনÑআমাদেরকে তো পথই হারাতে হবে। তবু যত সংশয় থাকুক, ভয় থাকুক মৃত্যুর, তবু মৃত্যুকে এগুনোর মিছিল আমাদের দীর্ঘতরো হয়। আমরা দেখতে পাই, ভিবিন্ন জায়গা থেকে লোক ফুরে উঠে আসছে অন্ধকার থেকেÑ সূর্য না চাঁদ, নাকি নক্ষত্রের মতো মানুষ ভেসে আসছে অসহায়। তারাও আমাদের মতো উত্তরে যেতে চায় এবং দিগধাধার খেয়ালে পথ ভুলেÑ স্বজন পরিজন হারিয়ে আপনজনের লাশ কাঁধে করে ছুটে যাচ্ছে।
আমাদের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আর আমাদেরকে করা হয়েছে মৃত্যুর সমার্থক। কেননা আমরা বন্দি এক মুক্ত কারাগারে আর মারনাস্ত্র আমাদের তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আরেকদিকে আমাদরে নিস্ক্রিয়চোখ আপাতঅর্থে জল ফেলে অক্ষম হুহুংকারে। তখনও আমাদের হুঁশ হয়নি। আমরা পুরোপুরো জেগে উঠিনি আর মৃত্যুর রং স্বপ্ন থেকে আমাদের ফেরানোর কোনো প্রয়োজন দেখে না কেউ। তেমন শক্তিশালী কেউ সরাসরি আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি শুধু মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা ছাড়া আমাদের সঙ্গে আর কিছুই সাথী হয় না। তাই আমরা হয়তো অন্য একটি দূরবর্তী অথবা নিকটবর্তী ভবিষ্যতের দিকে চোখ রেখে জেগে থাকি। হয়তো রাত হয়েছে, হয়তো রাত এখন অনেকÑকিন্তু আমাদের চোখে কোনো নক্ষত্র বা আকাশ প্রতিয়মান হয় না এবং পাই না আমরা সূর্যেরও হদিস।
ভাবতে ভাবতে আবার আমাদের উপর আক্রমণ আসে এবং কোনো ক্ষেপনাস্ত্র আমাদের শক্তিকেন্দ্রে আঘাত হানে এবং কাঁচের বয়ামের মতো গুড়িয়ে যেতে দেখি আমাদের স্বপ্নগুলো। এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি চাই বলেই আমরা উত্তরে ছুটছি, কিন্তু এ ছোটার যেনো শেষ নেই।
আমরা আরও কিছুদূর পথ চলি। আমাদের নারীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাদের সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে শোকের অন্তরালে এবং আমাদের কিশোরিরা চপলতা ভুলে যেনো হয়ে পড়ে আশি বছরের বৃদ্ধা আর আমাদের বৃদ্ধগুলো যেনো ধুকে ধুকে মরতে মরতে হয়ে যায় কবরের ধূলোবালি।
মেঘের রং মুছে যায়, ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে পড়ে আর ঘাসগুলো ঝলসে যায় বোমার আঘাতে। শাদা ফসফরাস আমাদের মৃত্যুগুলোকে আরও বেশি কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং আমরা মৃত্যুকূপে পড়ে উত্তোরণের আশা পোষন করি। এ লড়াইটা চালিয়ে যেতে আমাদের শিশুদের জন্য শিক্ষা থাকবে যে আগ বাড়িয়ে এমন কিছু বলতে নেই যার মাসুল তাদের কাছে অজানা। এবং সময় ও সুযোগজ্ঞান থাকা স্বত্বেও ভূখ-ের স্বাধীনতার প্রতি আমাদের প্রচ্ছন্ন প্রেম এতদিনে সাগরের ঢেউয়ের মতো জেগে উঠে এবং জন¯্রােত আরও দীর্ঘ হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর মানচিত্রের আদলে তৈরি হয় ফিলিস্তিনের মুখ।
ধ্বংসস্তুপ পেরিয়ে আমরা আবার কোনো লোকালয়ে পৌঁছে যাই এবং বরাবরই মানুষশূণ্য লোকালয়ে আমাদের তৃষ্ণার নিবারণের কোনো জায়গা থাকে না। বাড়িগুলো ভুতুরে বাড়ির মতো পড়ে আছে আর রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে নিভে আছে বাতি। এ কোন অন্ধকারে আমরা দিনাতিপাত করছিÑআমরা বুঝতে পারি না। তবু আমাদের মৃত্যুগুলো আমাদের সাথে প্রবঞ্চনা করে আমাদের আলেয়ার ভেতরÑশোকের ভেতর কোন সে জুলফিকার চমকাবে তার আশায় আমরা জেগে থাকি। পথ চলি, দীর্ঘ ক্লান্তির।
আমাদের ক্লান্তিগুলো ফুরোয়। আমরা কোনো ভাঙা কার্ণিশে জিরিয়ে নেই অথবা হামলার আশংকায় আত্মগোপন করি। আমাদের নির্দিষ্ট সংখক সহযাত্রী প্রতিদিন খুন হন আর আমাদের নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে দ্বিগুন সংখ্যক মানুষ আবার, আবারও পথে নামে। যার কারণে আমাদের জন¯্রােত আরও দীর্ঘতরো হতে থাকে এবং দীর্ঘতরো ক্ষুধা, দীর্ঘতরো মৃত্যুভয় এবং মুহুর্মূূহু হামলা আমাদের কাবু করে ফেলে। আমাদের সন্তানে হাঁটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে প্রায় এবং আমাদের লোকগুলি, মহিলাগুলো এবং আমাদের বৃদ্ধরা পথশ্রমে, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মারা যায় কেউ কেউ।
এতো মৃত্যুর পরেও আমাদের পথ চলা শেষ হয় না। আমরা আসলে উত্তরে যেতে চাই না। আমাদেরকে পাঠানো হচ্ছে। চেনা জন্মভূমি থেকে, চেনা অধিকার থেকে আমাদেরকে উৎখাত করা হচ্ছে এবং এগুলো যে কেনো করা হচ্ছে তার কোনো সঠিক জবাবও নেই আমাদের কাছে অথবা হামলাকারী খুনেদের কাছে। আমরা এখন শত্রু-মিত্রের সমার্থক।
পৃথিবীর পরিহাসে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেঠে এবং আমরা দাবার গুটি, জুয়ার গুটি হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে খেলে যেতে দেখছি মানুষের আয়ু।
উৎক্ষেপিত নরক আমাদের চারপাশে আর আমরা দিকচিহ্নহীন ছুটছি উত্তরে। ছুটতে ছুটতে হিসেব রাখছি ঘড়ির কাটার অথচ ঘরিটা তখন অচল। প্রহরের হিসেব রাখবোÑ সে উপায়ও নেই। অষ্টপ্রহরব্যপী আমাদের ছুটে চলা জীবনযুদ্ধের এক পলায়নপরতা হলেও আমাদের জন্য মঙ্গল। কারন মানুষ বাঁচলে দেশ বিনির্মাণ হবে। একটি মানুষের মূল্য মানচিত্রের চেয়েও বড়। তবু আমাদের মানুষেরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের সেতু তৈরি করছে। আমরা তাদের মৃতদেহের কাছে থমকে দাঁড়াই এবং মৃতদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা আরও উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
আমরা আরও বেশি করে উত্তরদিক হারাই। কোন পথে যাচ্ছি, কোনো যাচ্ছি সেসবও একসময় গৌণ হয়ে উঠে। শুধু জানি পেছনে মৃত্যু তাড়া করেছে ফলে হয় আমাদের পালাতে হবে অথবা রুখতে হবে।
ঢাকা