আমি কি বাংলাদেশ!
রোমেনা আফরোজ
একজন মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবুও বিবাহিত জীবনে সব পরিচয় বাদ দিয়ে মাত্র একটা পরিচয় নিয়ে বেঁচেছিলাম। এখন পর্যন্ত সেই আঁশটে গন্ধ শরীরে লেগে আছে। একটা পরিচয়কে সর্বাধিক মূল্য দিতে যেয়ে মা হতে পারিনি। নারীসত্তা কোথায়, কোন্ বাঁকে যে হারিয়ে গেছে খেয়ালও করিনি। মানুষ হওয়ার পথ তো বহুদূর বাকি। পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সর্বোপরি সংস্কৃতি আমাকে শিক্ষা দেয়নি, কেউ একবারও বলেনি, জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না; শ্বাস নিতে পারলেই জীবন হয়ে ওঠে না। এগুলো যে পরম সাধনার বস্তু, একমাত্র সাধকই পরমের সন্ধান পায়, এই শিক্ষা পেয়েছি সেদিন, যেদিন আমার মর্মমূলে সচেতনতার বৃক্ষ আস্তে ধীরে কুঁড়ি মেলছিল। এই বোধোদয়ের বিলম্বের কারণে একা চলার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমার দ্বিধাদ্বন্দ্বের হেতু শুধু আর্থিক নয়, মানসিকও। বর্তমানে রাজনীতিবিদরা যেমন অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মুক্ত হয়, আমি তেমন পথে না যেয়ে বলছি, আমার যন্ত্রণার অনেকটুকু উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হলেও এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য আমিই দায়ী। যখন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়, তখন নিজেকেই নিজের মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভুত হতে হয়। আমার চারপাশের অনেক নারীকে দেখেছি, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা অটলবৃক্ষের মত মজবুত। পারিবারিক অসমর্থন, এমনকি আর্থিক সংকটও তাদের থামাতে পারছে না। শুধু পরিবারের বিরুদ্ধে নয়, তারা সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে। তাদের জীবন আমাকে মুগ্ধ করতো। আমি তাদের মত হতে চাইতাম। একজন যোদ্ধা হতে চাইতাম, যার কাছে পরিশ্রম এবং শরীরের ঘাম সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস আরম্ভ করার সময়েও জানা ছিল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতাম। তবে সেসময় জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। সম্ভবত সেটাই কাল হয়েছিল। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কালবেলা, গর্ভধারিণীর মত বই পড়েছি। জেমস বন্ড ছিল প্রিয় মুভি সিরিজ। বাবার অনুপ্রেরণায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখতাম। তবে কো-এডুকেশনের জন্য চট্টগ্রাম কলেজে ভতির্র বিষয়টি তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বিপরীতে যেয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছি। জামাত-শিবির ট্যাগ মারা কলেজে ছোট চুলে উড়ে বেড়িয়েছি মুক্ত বিহঙ্গের মত। সেই সাতানব্বইয়ে একা একা পথ চলেছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গেছি অসংখ্যবার। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার মধ্যে পুরুষ শক্তি বিদ্যমান (মাস্কুলিন এনার্জি) ছিল। মা-বাবার মধ্যে একটা ঘাটতি তো ছিলই। তার মধ্যে আমরা পাঁচ বোন হওয়াতে ছোটবেলা থেকে এ নিয়ে নানা জন নানারকম কথা বলেছেন। সবার অবহেলা, অপমানবোধ বয়ে বেড়াতে যেয়ে সম্ভবত জেগে উঠেছিল পুরুষ শক্তি। ডারউইন তাঁর ন্যাচারাল সিলেকশনে এমন বিবর্তনের কথা বলেছেন। মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে কখনো-সখনো অনুভূতির সংযোজন করতে হয়; আবার কখনো বিয়োজন করতে হয়।
নতুন পৃথিবী আমার জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, বাধা-নিষেধ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বই পড়া বারণ। কলেজ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা একেবারে বন্ধ। এমনকি একমাত্র মেয়ে বান্ধবী নিয়েও চরম আপত্তি ছিল। এতো নিষেধাজ্ঞার শেকল নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। কিন্তু তাতে মানসিক উৎকর্ষ হয়নি। পরিবারের সমর্থনে দেবতার আচরণ ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করছিল। ড্রাকুলার মত রক্তপিপাসু হয়ে উঠছিল মানুষটা। বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের কারণে পরিবারের যুক্তিবোধের জায়গাটা শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। দেবতার গলার স্বর রপ্ত করে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন শাসন করছিল আমাকেই। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম পরিবারের রূপান্তর। এসব কারসাজির সাথে তাল মেলাতে না পেরে একসময় ভেঙে পড়ি। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনে বিভিন্ন অসুস্থতা ছায়াসঙ্গীর মত লেপ্টে থাকে। আমার শিক্ষা-দীক্ষা বোধবুদ্ধি সব পরিণত হয় অজ্ঞতায়। দুর্বলতার সুযোগে দেবতার স্বৈরাচারী আচরণ আরও বেড়ে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন সর্বগ্রাসী ফ্যাসিস্ট। একের পর এক (কালা কানুন প্রণীত হয়) গ্রেনেড হামলা চলে। একসময় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিতে আকণ্ঠ ডুবে যাই। এক মুহূর্ত চিন্তার করার অবকাশ নেই। সারাক্ষণ অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কা, ভয়-ভীতি। তখন স্বপ্ন দেখিনি। ভাবতাম, এক মুঠো ভাত এবং মাথা গোঁজার ঠাই পেলে ঠিক পালিয়ে যাব। কিন্তু একবারও অনুধাবন করিনি, মুক্তি বিনিময়যোগ্য উপহার সামগ্রী নয়।
বর্তমানে আমরা প্রায় একটা মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের (সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন) কথা শুনে থাকি, যাকে নরমালাইজেশন বা সাধারণীকরণ বলা হয়। যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য শোক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজও নির্যাতনকে এমনভাবে সাধারণীকরণ করার পাঁয়তারা করে। আমিও সমাজের একজন নারী। যার দরুণ মনের মধ্যে একটা ভীতু শিশু দিনদিন বেড়ে উঠছিল। সেই ভীতু শিশুর নাম অবচেতন মন বা সাবকনশাস মাইন্ড। ডক্টর ব্রুসলিপটন বলেছেন, আমরা জিনের(এবহব) বলির পাঁঠা নই। আমরা আমাদের অবচেতন মনে প্রোগ্রাম হওয়া মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির পাঁঠা। যাকে বলে সাংস্কৃতিক জন্ম। সেই কারাবাসের দিনগুলিতে বাইরে বের হতে গেলে পুরুষ নামক দানবের ভয় হতো। কথা বলতে গেলে জড়তা। কল্পনা করতে গেলেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। আমার জানা ছিল না, যেখানে কল্পনা হার মানে সেখানে বাস্তবতা তৈরি হয় না।
বস্তুত মানুষ একদিনে মানুষ হয়ে ওঠে না। দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফলে একজন মানুষ মানুষের স্তরে উন্নীত হয়। কিন্তু নির্যাতন এবং অপমানের ফলে আমার মধ্যকার সে সকল বোধ লোপ পেয়েছিল। সকল সামাজিক পরিচয় ধূলিসাৎ করে শুধুমাত্র বেঁচেছিল একজন স্ত্রী, যার কাছে মান-সম্মানের চেয়ে ধুকেধুকে বেঁচে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই অবচেতন মন বিভিন্ন প্রকার মায়া-মোহ দ্বারা আমাকে বেঁধে রাখছিল। বিভিন্ন প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বৃত্তের বাইরে না যাবার যুক্তি প্রদর্শন করতো। পরিবারিক সংস্কৃতির মিথ্যা জালে আটকা পড়ে আত্মমর্যাদার স্থানকে দেখছিল ক্ষুদ্র করে। আসলে দীর্ঘদিনের অনভ্যাসের ফলে আমার ব্যক্তিত্ব ক্ষয়ে যেয়ে তার স্থলে বাঙালি নারীর প্রাগৈতিহাসিক চরিত্র জেগে উঠেছিল। আমি হয়ে উঠেছিলাম আমার মায়ের মতো দুর্বল কিংবা দাদীর মত ভীতু। যার দরুণ সমাজ কী বলবে, সেসব বিষয় নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। ছোটখাটো প্রতিবাদ যে করিনি তা নয়। কিন্তু প্রতিবাদের যখন লক্ষ্য থাকে না, তখন সেই অবস্থা প্রতিপক্ষকে নমনীয় করতে পারে না। বিষয়টা অনুধাবন করে দেবতা নিজের জীবন-যাপনে পরিবর্তন আনেনি। এদিকে আমি নিজের অধিকার গুটিয়ে নিতে নিতে একটা কুকুরের চেয়েও অল্প জায়গা নিয়ে বেঁচেছিলাম। প্রতিমুহূর্তে নিজের অক্ষমতা টের পেতাম। এই অক্ষমতার বিপরীতে অবচেতন মন বিভিন্ন প্রকার যুক্তি নির্মাণ করতো। কিন্তু সচেতন মন এসব গাল-গল্পে বিশ্বাস না করে পাল্টা যুক্তি দিতো। সচেতন মনের পরামর্শে একটু একটু সাহস সঞ্চয় করছিলাম। যদি পরিবারের ন্যূনতম সমর্থন পেতাম, তবে যুদ্ধটা নয় মাসেই সমাপ্ত হত। কিন্তু নিয়তির ভিন্ন রকম পরিকল্পনা থাকায় আমাকেই সচেতন হতে হয়েছে।
শেষমেশ একদিন নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। নিজের বোধের কাছে প্রশ্ন করলাম, আমি কি একজন স্ত্রী হিসেবে সারাজীবন শুধু অপমান আর বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে চাই? সেক্ষেত্রে নারীসমাজের প্রতি আমার যে-দায়-দায়িত্ব তার কী হবে? আমি কি তাদের মুখ বুজে সহ্য করার অপসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেবো? নারীসমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে না হোক, অন্তত একজন মানুষ হিসেবে সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই একদিন দ্বিধাদ্বন্দ্ব, শঙ্কা ঝেড়ে ফেলে কাগজে সাক্ষর করলাম। বহুদিন পূর্বে যাকে মন থেকে মুছে ফেলেছি আজ তাকে সামাজিকভাবেও বিদায় দিলাম।
আমি স্বীকার করছি, জীবনের জন্য একজন পুরুষ মানুষ ভীষণ জরুরি। কারণ নারী-পুরুষ একে-অপরের পরিপূরক। তবে মাদী মার্কা পুরুষ দিয়ে পরিবার এবং সমাজের চললেও যে-নারীর বোধের জগত জাগ্রত হয়েছে, তার জন্য এমন অচলমুদ্রা কাম্য নয়। একজন পুরুষকে শারীরিক এবং মানসিক দু’ভাবেই সঙ্গী হতে হয়। যদি দাম্পত্য জীবনে দুজন দু’মেরুর বাসিন্দা হন এবং আলোচনার পরিবেশ না থাকে, তবে সেই সম্পর্কে সবল পক্ষ হয়ে ওঠে শাসক। দুর্বল পক্ষ হয়ে ওঠে প্রলিতারিয়েত। সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ অত্যন্ত জরুরি। অনেকেই হয়তো এই ধ্যান-ধারণাকে নারীবাদী বলবেন, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে অপমান, অবহেলার জীবন কারো কাম্য হতে পারে না। যারা মনে করছেন, বয়স একটা ফ্যাক্ট, তাদের বলছি, বোধোদয়ের কোনো দিনক্ষণ নেই; জীবন আরম্ভ করার কোনো বয়স হয় না। পরিশেষে নারী বা পুরুষ হিসেবে নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে শিখুন।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট