গল্প : তাজমহল



তাজমহল
নবাব আব্দুর রহিম

তিথির মনটা সকাল থেকেই ভারি ভারি ছিল। একরাশ বিষন্নতা ছেয়ে আছে তার চোখেমুখে। কিন্তু এখনকার ঘটনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ও তো কোনমতেই নয়।

তিথি আমার বান্ধবী। ছোট থেকেই একসাথে বেড়ে উঠেছি, একসাথে পড়ালেখা করছি। আমরা দুইজনেই সামনে বছর এসএসসি পরীক্ষা দিব। কাহিনী কয়েকমাস আগে শুরু। শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশরের গোধূলিলগ্নে দাঁড়িয়ে নবযৌবনের অপেক্ষায়। যে সময় মনের বাগানে অচেনা অজানা কিছু ফুল পাপড়ি মেলে। ভালোলাগা- ভালোবাসার দোদুল দোলায় মন দুলতে থাকে এমন এক সময়ে আমরা দুইজনেই উপনীত হয়েছি।
আমাদের স্কুল বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। খাঁড়ি আর পুল পার হয়ে বিশাল এক আমবাগানের মধ্য দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে। তারপর অন্য এক গ্রাম। এই লম্বা পথটা সবসময় নির্জন থাকে। সাধারণ মানুষের চলাচল অনেক কম। এ গ্রামে স্কুল না থাকায় ওখানেই সবাইকে যেতে হয়। আর আমবাগানের পাশে আরেকটা গ্রাম আছে। ও গ্রামের ছেলেরা এ রাস্তার পাশে একটু ফাঁকা জায়গায় ক্রিকেট খেলে। আর কেউ কেউ রাস্তায় আড্ডা দেয়। বিশেষ করে স্কুল শুরু-শেষের সময়ে।
ছেলেদের অনেকে সাইকেল নিয়ে যায়। আমি হেটেই যাই। হেটে যাওয়া আসা করলে বন্ধুদের সাথে গল্প করা যায়। যদিও তিথিই এর প্রধান কারন। সেদিন সকালে ক্লাস যাওয়ার পথে একটা ছেলেকে দেখলাম তিথির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। অস্বাভাবিক নয়। অসম্ভব সুন্দরী তিথি অনেকের আড়চোখের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে সবসময়। তবুও তখন কেন জানি আমার বুকের ভেতর কী যেন মোচড় দিয়ে উঠে!
সেদিন থেকে যাওয়া আসার পথে সবসময় ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকত। সুদর্শন হওয়ায় আমি খুব হিংসে করতাম।  কয়েকদিন যেতে না যেতেই তিথিও ওর এরকম আচরণে রেসপন্স করতে লাগলো। ছেলেটা তিথিকে উদ্দেশ্য করে আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলত।
এক শনিবার আমার খুব জ্বর আসলো। সারাদিন উঠতে পারিনি। ক্লাস বাদ গেল। পরদিন কিছুটা সুস্থ হলে ক্লাস এ্যাটেন্ড করলাম। যাওয়ার সময় তিথি আমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাইল। জানিনা কেন তিথির সাথে সময় কাটাতে আমার অনেক ভালো লাগে। খুশি হলাম। আমরা সবার পিছনে হাটছি।
তিথি আমাকে বলল: অপূর্বকে চিনিস ? ওই যে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে ছেলেটা!
: না তো।
ও আমাকে ডানদিকে ইশারা করে বলল ওর বাড়ি এদিকে! নাম অপূর্ব।
আমি বললাম তুই কিভাবে জানলি ?
বলল যে ওই নাকি এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ছেলে।
: রিয়্যালি ? তোর এত খোঁজ নেয়াও হয়ে গেছে? প্রেমে পড়েছিস নাকি ?
কথায় কেমন একটা টান দিয়ে বলল, আসলে তা না। কাল অপূর্ব আমাকে প্রোপোজ করেছে!
এই বলে সে মুচকি হাসছে। আমি পুরাই হা হয়ে গেছি। আমি এতদিন তিথির সাথে আছি। সে না আমাকে বুঝল, না আমার ফিলিংসগুলোকে। কিন্তু এই ক’দিনের দেখা একটা ছেলের প্রোপোজালে এত খুশি খুশি লাগছে তাকে!
আমি বললাম: তুই কিছু বলেছিস নাকি ওকে ?
বলল: প্লিজ কাউকে বলিস না। আমি কিন্তু এ্যাক্সেপ্ট করিনি এখনও।
: আর বলতে হবেনা। তোর এতদিনের বন্ধু আমি। তোর ফিলিংস আমি বুঝিনা?
অনেক কষ্ট পেলাম। বুঝতে না দিয়ে তাকে বললাম: দেখ! রিলেশন করবি না করবি সেটা তোর ব্যাপার। আমি কিছু বলব না। তবে বুঝে-শুনে ওদিকে পা দিস। আর ওই গ্রামের জানলে তোর বাপ- মাও মেনে নিবেনা!
: হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয়না শুভ! মানবেনা কেন!?
: সেটা না। তারপরেও...
: থাক তোকে ভাবতে হবেনা। শুধু কাউকে বলিস না তাহলেই হল।
তিন মাস কেটে গেল। তিথি এখন আমার মন থেকে অনেক অনেক দূরে। প্রয়োজন ছাড়া আর কথাও হয়না। আজ সকালে আমাকে বলল: কি করব শুভ! কিছু ভাল্লাগছেনা।
আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে! সে বলল কিছুক্ষণ আগে অপূর্ব তাকে ফোনে জানাল তার বাপ- মা তার জন্য বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আজকেই বিয়ের ডেট ছিল।
একটু পরই বিয়ের জন্য চলে যাবে!
আমি অবাক হয়ে বললাম, তোকে আগে বলেনি কেন?
কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, জানিনা! ও আমাকে তার সাথে পালিয়ে যেতে বলছিল।
আমি বললাম, পালিয়ে কি হবে!? আর এখন কি করবি তুই?
ও কাঁদতে লাগলো। বলল, কি করব!? ভাগ্যে ছিল! আমি মা বাপের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবো না; ওকে বলে দিয়েছি।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কি বলব! এ কঠিন সমস্যার সমাধান দেয়া আমার পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়।
তার অন্ধকার সময়ের সব খবরই আমার জানা আছে। অপূর্বের সাথে ওর রিলেশনের কারণে ও তো আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তবে এসময়ে অপূর্ব’র বন্ধু রাশেদের সাথে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক হয়েছে। তার কাছ থেকে তিথি আর অপূর্বের সব খবর পাই। যার অনেকটা রঙিন, জাঁকজমকপূর্ণ মনে হলেও ছিল অন্ধকার। অপূর্বের বাড়ি থেকে কিছু দূরে বসবাসহীন একটা বাড়ি ছিল। সে আর তার বন্ধুরা বলত ‘অপূর্বের তাজমহল’। তবে এই তাজমহল আর শাহজাহানের তাজমহলের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এ তাজমহল শুধু অবৈধ আর অনৈতিক সম্পর্কের নিদর্শন।
রিলেশন শুরুর কয়েকদিন পরেই অপূর্ব তাকে তাজমহলে নিয়ে যায়। প্রথমে তিথি সংকোচ বোধ করলেও পরবর্তীতে অপূর্বের সাথে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিল। সপ্তাহে দু’তিন দিনই তাদের গন্তব্য থাকতো তাজমহল।
কিন্তু তার চেয়েও বড় একটা বোমা বিস্ফোরিত হল এখন। আমি বন্ধুদের সাথে নুমান মামার দোকানে বসে আছি। তিথি ওর ছোটবোনকে কিছু কিনে দেয়ার জন্য দোকানে এসেছে। এমন সময়ে তিনটা কার ওখান দিয়ে পার হয়ে গেল। অপূর্বের বিয়ের গাড়ি ছিল! এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলল, ‘মেম্বারের ব্যাটা পঙ্খীরাজ চড়ে গিয়েছিল বউ আনতে’! আরেকজন বলল, ‘আরে এর আগে তো ওর বিয়ে হয়েছিল পায়ে হেঁটেই! খড়ের গাদায় গ্রামেরই এক মেয়ের সাথে ধরা পড়েছিল! পরে তালাক দিয়েছিল।’
আমি জানতাম এটা। তিথি জানতো কিনা জানিনা! জানাতেও পারিনি কোনদিন। ততক্ষণে দেখলাম তিথি ঢলে পড়ে গেছে! অপূর্ব তাকে এটাও জানায়নি বুঝি!!








শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট