গল্প : সখ্যতার সঙ্গিনী



সখ্যতার সঙ্গিনী
সাদিক আল আমিন

এখানে মরুভূমির মতো গলা শুকোনো রোদ, ভরদুপুরে সবুজ রঙ থেকে হালকা টিয়েতে রুপান্তর হয় যুবক বয়সী পাতাগুলো। ফাঁকা চারপাশ সারি সারি বিন্যস্ত বাড়িগুলোতে কিছুটা পূর্ণ। এক মাইলের মতো ভেতরে ঢুকলে তখন দেখা যায় আবাদি জমির বিস্ফোরণ। মস্ত এলাকা জুড়ে খাঁ খাঁ মাঠসমুদ্র। বৈশাখের শুরুতে এখন গাছপাকা ফল, জমিতে প্রাপ্তবয়স্ক হতে শুরু করা হলুদ-সবুজাভ ধান, গ্রামের বুক ছুঁয়ে চলে যাওয়া শান্ত শীতল নদী। সবকিছুর সাহচর্যে এসেছিলো লাবণ্য। অনেকটা নিজের ইচ্ছায়, কিছুটা নিতুর প্রলোভনে পরে; তার মুখে মামার বাড়ির গ্রামের বর্ণনা শুনে। আজ মধ্যসকালে পল্লবপুরে এসে পৌঁছেছে দুজন। নিতুর থেকে শোনা তার মামাবাড়ি সম্বন্ধীয় বর্ণনা নিরপেক্ষই মনে হয়েছে লাবণ্যর কাছে। এক্ষেত্রে প্রথমে তার মনবাসনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেই বায়ু বদলের প্রস্তাবটা দিয়েছিলো নিতু। লাবণ্যও রাজি হয়েছিল এক বাক্যে। ইদানীং মন খুব বেশি নষ্টালজিয়া হতে চায়। তার ক্ষেত্রে তাই হওয়াতে এখানে আসা। এছাড়াও মনপটে অঙ্কিত গ্রাম্য সভ্যতাকে বাস্তব রুপ দিতে আসাটাও অন্যতম কারণ। কারণ খুঁজতে গেলে ঢের মিলবে। ছোট থাকতে দেশের বাড়ি যেতো সে। ছোটদের সাথে পালা করে খেলতো চি-বুড়ি, কানামাছি। এখন সবাই বড় হয়ে গেছে। দুয়েক বছর আগে দাদা মারা যায়। দাদি যাও বেঁচে আছে মনমরা হয়ে থাকে সবসময়। তার চোখেমুখে মৃত্যুদূতের হাসি প্রতিফলিত হয় প্রতিদিন। দাদিবাড়ি গিয়ে আর তৃপ্তি পাওয়া যায়না আগের মতো। নিতুর মামাবাড়িতে এসে সেই ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে ভেবেই এখানে আসা। এসেই গ্রাম্য লাবণ্যরুপে ডুবে লাবণ্য। নিতুর মামার বাড়িটা খুব বেশি স্বচ্ছল নয় আবার খুব একটা নিশ্চলও নয়। গ্রামীণ জীবনের মধ্যবিত্ত বাড়িগুলো যেমন হয়, চতুর্দিকে খড় বেড়া আর বাশের ঘেরার পরে মাথার ওপর ত্রিভুজাকার টিনের ছাউনি, যেন মনে হয় ভিটেরাজ্যের প্রভু। সেরকমই বাড়িটা নিতুর মামাদের। বিস্তর এলাকাজুড়ে উঠোন। মোরগ-মুরগি আর হাঁস-গরুর পালন। বেশ পরিচ্ছন্ন এবং তকতকে। শুধু বাড়ি দেখে লাবণ্যর মন ভরলোনা। বাইরের পুরো গ্রামটা দেখেই তবে স্বস্তি। তার এ উৎকণ্ঠা মুখে না বললেও মামী বুঝতে পারলেন। তিনি বিকেলের দিকে তাকে পুরো গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু রাখাল মন গোয়ালে বাধা থাকতে চায়না। তার তখনি গ্রামটা ঘুরে না দেখলে যেন অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে এমন ভাব। লাবণ্য বেরিয়ে পড়ে একাই। তার চোখে দেখা পুরনো গ্রাম্য ইতিহাস কি এখনও বহাল আছে কালের পরিক্রমাতেও? নাকি ভ্রষ্ট ছোঁয়ায় আধুনিক হচ্ছে? দেখার খুব ইচ্ছে করে। হাঁটতে থাকে কাচা রাস্তা ধরে। হাতের ডানে বিশাল জমিমাঠ, বামে লিচুর বাগান, সাথেই লাগানো কবরস্থান। সিদ্ধান্ত নিলো, গ্রামটা একাই ঘুরে দেখবে। লাবণ্যর চোখে বিস্তর জমি ধরে না। সীমা পেরিয়ে চলে যায়। সেও চায় এ সীমানা কতোদূর তা দেখতে। হাতের দুপাশে পাকাপ্রায় ধানের জমির মাঝখানের আল ধরে হাঁটে লাবণ্য। মামাবাড়ি থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এখন এদিকে এসেছে। শুধু রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা হবেনা কিছুই। তার ইচ্ছে সবকিছু খতিয়ে দেখার। শকুনচক্ষে সবকিছু অবলোকনের অভিযানে নেমেছে সে। দুধারে আধাপাকা ধানবাড়িতে পানি দেওয়া। মাটি পানি মিলে কাদা। লাবণ্যর একবার পা পিছলায় আর কাদায় পড়ে পা। থকথকে নোংরা হয়ে যায়। উচ্চবিলাসী দেমাগি কেউ হলে এতে ঘৃণায় নাক সিটকাতো নিজের পরিচ্ছন্নতার প্রশ্ন তুলে। লাবণ্যর তেমন কিছু মনে হয়না। বরং ভালোই লাগে নিজেকে মাটির খুব কাছাকাছি একজন মানুষ মনে করে। মাটির সোঁদা গন্ধ পেয়ে আনন্দিত হয়; পুলকিত বোধ করে এই ভেবে যে, এজন্মে আর গ্রামের এতো কাছে আসতে না পারলেও কোনো আফসোস থাকবেনা আজকের মতো এতো নিবিড়ভাবে নিজেকে প্রকৃতির সাথে মেশাবার কারণে। পা থেকে কাদা মোছার কোনো প্রবণতা দেখায় না। আরো যেন ইচ্ছে করে কাদার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে। সোজা আলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। এ গ্রাম আজ সে চক্ষুতৃষ্ণায় পান করবে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কম করে হলেও দু মাইলের মতো হেঁটেছে এ পর্যন্ত। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিলে মন্দ হয়না। কিছু দূরে একটা মাঝারি আকারের আমগাছ দেখা যায়। গ্রীষ্মের শুরুতে আম ধরেছে কিছু কিছু। আমও ধানের মতো আধা কাচা আধা পাকা। আহা, কী সমতুল্যতা! লাবণ্য বিশ কদমের মতো হেঁটে আমগাছটার ছায়ায় এসে অবসাদহেতু আশ্রয় নেয়। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয় একবার। দেখে, আমগাছের ওপারের ঢালু জমিতে একটা জোয়ানমতো ছেলে কাজ করছে। শ্যামলা গায়ের রং। রোদ চকচকে আলো পড়ে শ্যামলা পিঠ উজ্জ্বল তামাটে বর্ণ ধরেছে। এ ধরণের দৃশ্য আজকালকার দিনে খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। নিজেকে সৌভাগ্যিনী ভাবতে থাকে সে। নিতুর কথা ভুলে যায়। অনেক জমি পার হয়ে এতোদূর এসেছে। বাড়ি ফেরার পথও মনে নেই। কোথায় কোন বাঁক যে মিলিয়ে গেছে তারও কোনো ইয়ত্তা নে। পেছনে ফিরে তাকায় লাবণ্য। নাহ্, ফেরা হবেনা মনে হয় আজ আর। অথচ সেজন্য কোনো উদ্বিগ্নতাও কাজ করেনা মনের ভেতর। সবুজ প্রকৃতির মিলনমেলায় হারিয়ে গিয়ে এখন আনন্দিতই বেশ। কতোদিন হলো এরকম খোলামেলাভাবে প্রকৃতির সাথে মিশতে পারেনি। আসতে পারেনি প্রকৃতির এতো কাছে! সে তীক্ষ্ণ চোখে কাজ করে যাওয়া জোয়ান ছেলেটার দিকে চেয়ে রয়।  তার শ্যামলা পিঠে পড়া উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে লাবণ্যের ম্লান চোখে। দূর থেকে দেখে বিরানভূমিই মনে হয়েছিলো তার। আমগাছের নিচের দিকের জমিগুলো উত্তরের দিকে ঢালু হয়ে যাওয়ায় দূর থেকে বোঝা যায়নি। এখানে এই ছেলেটার কাজ করে যাওয়া দেখে করুণা হয়। তার কোনো গ্রাম্য বন্ধু বা পরিচিত কেউ নেই। যত বন্ধুবান্ধব সব শহরের। ছেলেটাকে দেখে মনে সখ্যতা জাগে। ইচ্ছে হয় তাকে সঙ্গী করার। কিন্তু তার মনস্তত্ত্বের সাথে কি এই ছেলেটার মনস্তত্ত্বের মিল থাকবে! অমিল থাকারও কথা নেই অবশ্য। সে গ্রাম পছন্দ করে আর ছেলেটাও গ্রামীণ। কিন্তু সমস্যা হলো মন জানতে পারাটা। লাবণ্য কি ছেলেটার মনের কাঠিনত্য কিংবা সরলতার কথা বলতে পারবে! পারবে না। তার সাথে সখ্যতা করতে এখানেই দ্বিধা হয়। যদি বেঁকে বসে! তার মতো শহুরে সুন্দরী রমনী দেখে যদি তার মনে কুটিলতা বা মন্দবুদ্ধির উদয় হয়! তখন সখ্যতার জায়গায় অসখ্যতা হবে। এদিকে খেয়াল দিতে হবে তাকে। প্রশ্রয় দেওয়ার মাত্রাটা নিম্নসীমায় রাখতে হবে। লাবণ্য ছেলেটাকে ডাকার কথা ভাবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে ডাকতে গেলেও সমস্যা। ভুল বুঝে ফেলতে পারে। একমনে কাজ করে যাওয়া গ্রাম্য জোয়ানটাকে তার উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য আমগাছটা ধরে আস্তে ঝাঁকি দেয় লাবণ্য। কিছু পাতা ঝড়ে পড়ে। ঢালু জমি থেকে কোমর সমান উপরে তাকায় জোয়ান কৃষক। কাজে বিঘ্ন ঘটে। ওপরে আমগাছ। সেখান থেকে পাতা ঝরার শব্দ কানে এসেছে তার। ওপরে তাকায়। একজন দাঁড়িয়ে। ফর্সা শরীরে রোদ লেগে লাল টকটকে হয়ে গেছে। আর কয়েকটা মেয়ের মতো এই মেয়ে নয়। টানা চোখের সীমায় আটকা পড়ে যায় তার প্রাথমিক হোঁচট। লাবণ্য অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যপাশে। এতক্ষণ যে লাবণ্য তাকে অনুসরণ করছিলো, তার শ্যামবর্ণ পিঠের উজ্জ্বল রশ্মিকে চোখে পুরছিলো সেসব খেয়াল করেনি সে। এখন আচমকাই মেয়েটার হকচকিয়ে যাওয়া চেহারা দেখে বুঝতে পারে সে বেশ অনেক সময় ধরেই তার কাজ করা দেখছে। জোয়ান কৃষক মনে মনে চিন্তিত বেশ, মেয়েটাকে তো চেনা যায় না। এদিকে এসেছে কি করতে! দেখে তো মনে হয় গ্রাম্য এলাকায় কখনো আসেনি। রোদের চটা সহ্য করতে না পেরে সাদা মুখ লাল হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লাবণ্যর দিকে তাকায় সে। বুকের ভেতর দপদপ করে লাবণ্যর। চারদিকে বিরানভূমি। কেউ নেই আশেপাশে। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জমিক্ষেতের এইদিকে তারা দুজন। ছেলেটাকে ডাকা কি তার ঠিক হলো? তার চাহনিতে কোনো আন্তরিকতা খুঁজে পায়না লাবণ্য। বরং দেখতে পায় সারা মুখজুড়ে কৌতূহল। কৌতূহল মানুষকে অপকর্মে লিপ্ত করতে সিংহভাগ দায়িত্ব বহন করে। এখনকার দিনে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। যদি কিছু করে বসে! ছেলেটাকে এগোতে দেখল সে। কাস্তে হাতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। হয়তো কিছু বলবে। খারাপ মতলবের আঁচ পেলে তখন না হয় কিছু করা যাবে। আপাতত চুপ করে থাকাই ভালো। লাবণ্য চুপ থাকে। ওদের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমতে থাকে। গা উদোম, লুঙ্গি পরা জোয়ান কৃষক এগিয়ে আসে আমগাছের দিকে। বুক টিপটিপ করছে তখন লাবণ্যর। রৌদ্রতেজে তা আরো বেড়ে গিয়ে বাইরে শোনা যায়। শব্দ হয় ধকধক। এতো উদ্বিগ্ন হবারও তার কথা নয়। ছেলেটি চলে আসে লাবণ্যর কাছে। জানতে চায় সে এই জায়গায় নতুন এসেছে কিনা। লাবণ্য মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিতে চেষ্টা করে, 'হ্যাঁ, এই গ্রামে আমি নতুন। আমি নিতুর বান্ধবী। ওর মামার বাসায় বেড়াতে এসেছি। সাত্তার আঙ্কেল ওর মামা হন।' এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে কথাগুলো। অবিরত প্রশ্নপর্ব এবং বারবার উত্তরপর্ব তার ভালো লাগেনা। আব্দুস সাত্তারের নাম শুনে জোয়ান ছেলেটা একটু ভক্তির মুখভঙ্গি করলো। আব্দুস সাত্তার হলেন এই গ্রামের প্রবীণ এবং সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। সে যেন পুরোপুরি চিনতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বলে, 'আইচ্ছা, আপনে তাইলে সাত্তার মৌলবির বাড়িত আইছেন। নিতু আফার বান্ধবী লাগেন?' লাবণ্য কোনো উত্তর দেয় না। ছেলেটা বলে, 'আমার নাম হইলো গিয়া হাবু। হাবু সরকার। সক্কলে হাবু বইলা ডাকে।' 'ও আচ্ছা', লাবণ্য সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। ছেলেটার সহজ সরল ভঙ্গির কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়না যে সে তার কোনো ক্ষতি করতে পারে। তবুও সতর্ক থাকতে সমস্যা নেই। শক্তভাবে কথা বলে লাবণ্য। মুখে গাম্ভীর্য ধরে রাখে। হাবু বলে, 'আপনে এহাই বাইর অইছেন কেন? নিতু আফা কই?' 'সে তার মামীর সাথে, রান্নাকাজে তাকে সহায়তা করছে', বলে লাবণ্য। হাবু মাথা চুলকোয়। প্রকাশ্যে তো এমন শিক্ষিত একটা মেয়ের সামনে মাথা চুলকোনো যায়না! তাই গোপনে করে কাজটা; ভাবে, সহায়তা মানে কি? শুদ্ধ বাংলাটা সে জানেনা। লাবণ্য কি বললো ভালোভাবে বুঝতে পারেনা সে। আবার জিজ্ঞেসও করতে পারেনা কি বললো! সম্মানে লাগে। মনে মনে ভাবে হাবু, এবার সাত্তার মৌলবির কাছে কিছু শুদ্ধ বাংলা শিখতে হবে। শহরের লোকেরা যেমন বলে।


হাবু সরকার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, 'আফা আপনে বাড়ি যাইবেন না? এহানে তো খুব রইদ। আপনের গা পোড়ে না?' হাবুর কথা লাবণ্যর কানে পৌঁছায় না। আনমনা হয়ে চারিদিকে তাকায় সে। দক্ষিণের কোণ ঘেঁষে চলে গেছে নদী। শান বাঁধানো হয়েছে ওদিকটায়। নদীর পাড়ে গ্রাম। বস্তির মতো সারি সারি লোকজনদের বসবাস। দূর জমিবাড়ি থেকেই সবকিছু অবলোকনে সমর্থ হয় লাবণ্য। মনে পড়ে, দেশের বাড়িতে একবার তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে নদীতে নেমেছিল। বুক সমান পানি। সাঁতার জানতোনা লাবণ্য। পানি বুক পর্যন্ত থাকার পরও ভয় করতোনা তখন। এখন হয়তো হাঁটুজলে নামতেই দ্বিধা করবে। তখন বয়সটাই ছিলো সেরকম। ভয়ের জ্ঞান তখনো মস্তিষ্কে ধাতস্থ হয়নি। হাবু সরকার একটু জোরে কাশি ঝেড়ে দেয়। লাবণ্যর চেতনা ফেরে। এতোক্ষণ হয়তো হাবু তাকে কিছু বলছিলো। কি বলছিলো তা জানতে চায়না সে। জানতে চাইলে হাবু তার অবচেতন মন সম্পর্কীয় দুর্বলতা সম্পর্কে জেনে যেতে পারে। তখন রসিয়ে রসিয়ে গল্পে মজাবে আর সেও আনমনা হয়ে তার নির্দেশগামী হবে, তার কল্পনায় বিচরণ করবে। না, তা হতে পারেনা। লাবণ্য এমন ভান করে যেন সে তার কথা শুনেছে। গম্ভীর ভঙ্গিতে হাবুকে বলে, 'আমাকে তোমাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাবে?' এমন রুপবতী একটা মেয়ে এরকম প্রস্তাব করায় যে কেউ-ই প্রথম মুহূর্তেই রাজি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হাবু দোটানায় পড়ে। সময় নিয়ে ভাবে, আজকে একটা প্রহর নষ্ট করলে তার পরবর্তী চাষাবাদের কোনো ক্ষতি হবে কিনা। না, তেমন একটা ক্ষতি হবেনা। কাল খুব ভোরে আইল পাড়া শুরু করলে ঘাটতিটা মোচন করা যাবে। তারপর দ্বিতীয় মুহূর্তে উত্তর দেয়, 'জ্বে আফা, অবশ্যি দেখাবো। বহুত সুন্দর আমাগো গেরাম। আপনে আহেন এইদিকে। রইদে একদম পুইড়া যাইতেছেন।' হাবু লাবণ্যকে জমিবাড়ি থেকে কাচা রাস্তায় নিয়ে আসে। কাদা পায়েই হাঁটে লাবণ্য। ছেলেটা পুরোপুরি সখ্যতার সঠিক সঙ্গী নয়। সে শুধু তার সুশ্রী মুখটাই দেখেছে, আপাদমস্তক চোখে নেয়নি। তার কাদামাখা পা গোচরে আনেনি। জমির সীমান্তে রাস্তায় এসে পড়ে তারা। হাবু বলে, 'এহানে একটু থামেন। আমি বাড়ি থাইকা আইতাছি।' লাবণ্য হ্যাঁ সূচক ইশারায় মাথা নাড়ে। হাবু সরকার বাড়িতে যায় যাত্রাপূর্ব প্রস্তুতিস্বরুপ ভালো লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে আসার জন্য।
কিছু সময় নিয়ে তারপর ফিরে আসে হাবু। সুন্দরী এক নারীর সাথে গ্রাম ভ্রমণে বেরোবে সে। নিজেকে একটু পরিপাটি না দেখালে তো মানায় না। হাবুর অদক্ষ সাজগোজ দেখে মুচকি হাসে লাবণ্য। ছেলেটা নতুন গেঞ্জি পড়েছে, লুঙ্গি পড়েছে, মুখে গলায় পাউডারের হালকা পরশ। বেশ সুদর্শনই দেখাচ্ছে তাকে। হাবুকে লজ্জা দিতে চায় সে। লজ্জা দিতে পারলে ছেলেটার আস্পর্ধার সীমা কিছুটা সংকুচিত হয়ে যাবে। যার আস্পর্ধার সীমা যত বেশি তার পরক্ষতি সাধনের মাত্রাও তত বেশি। লাবণ্য মুচকি হেসে হাবুর দিতে তাকিয়ে বলে, 'সেজে এসেছো নাকি?' হাবু লজ্জা পায়। লাবণ্য তাকে তুমি তুমি করে বলছে এ জন্যও, আবার তার সাজগোজের প্রশংসা করছে সে জন্যই। দুটো কারণে একসাথে লজ্জা পেয়েছে সে। লাবণ্যর মতো যদি তার মুখটা ফর্সা হতো তাহলে নির্ঘাত লাল হয়ে যেত। কিন্তু শ্যাম বর্ণ হওয়ায় মুখাকৃতিতে ধরতে না পারলেও হাবুর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে হাসায় লাবণ্য বুঝে ফেলে লজ্জার আবির্ভাব। ধাপে ধাপে এগোচ্ছে সে। প্রশ্রয় না দিয়ে, নিজের দুর্বলতা জানতে না দিয়ে, লজ্জা দিয়ে, গাম্ভীর্যতা ধারণ করে হাবুকে আয়ত্বে আনতে হবে। এমনটাই চিন্তা করে রেখেছে। আমগাছ তলায় হালকা ছায়ার প্রত্যাশায় যখন সে পথগামী হলো, স্বল্প দূরত্বে থাকা হাবুর কাস্তে হাতে তার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চাওয়া আর নিকটে আসার প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের ঝংকার তার কানে বেজেছে। মনে ধরেছে হাবুকে। নেই কোনো নাগরিক অতিব্যস্ততা কিংবা কৃত্রিম হৃদয়ে বশবর্তী করার কোনো বদ মতলব ছেলেটার মধ্যে। বুঝতে পেরেছে একটু একটু। তবুও কলস বাজিয়ে নেওয়াই ভালো। লাবণ্য বাজিয়ে নিচ্ছে-- প্রতিধাপে, সময়ে সময়ে। হাবুর লজ্জা কাটতে সময় লাগে। সময়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে ভাবে অনেক বিলম্ব করেছে উত্তর দিতে। চটজলদি বলে ফেলে, 'ইয়ে মানে..ওই ইকটু আরকি আফা।' অতিদ্রুত বলে ফেলায় কথাগুলো যান্ত্রিক শোনায়। লাবণ্য হয়তো তার কথা বুঝতে পায় অথবা পায় না। বুঝতে না পেলেও সে ধরণেরই কিছু উত্তর স্বরচনা করে মনগোচর করে; কারণ স্বরচিত উত্তর কখনো কর্ণগোচর হয়না। লাবণ্য কিছুটা দার্শনিকও বটে। সূক্ষ্ম বিষয় খুব কমই তার নাগালের বাইরে যায়। একটা বিষয় সে লক্ষ্য করেছে। হাবু নিজের বাসায় গিয়ে পরিপাটি হয়ে সেজে এলো, পরিষ্কার হয়ে এলো গ্রামভ্রমণের উদ্দেশ্যে। লাবণ্যকে নিয়েই তো যাবে সে। অথচ মেয়েটার পায়ে এখনো যে অসতর্কতাবশত আলের ধারে পা পড়ে যাওয়ায় চিটচিটে কাদা ভরে আছে, সেটা হাবুর দৃষ্টিগোচর হয়না! এক্ষেত্রে হাবুর সূক্ষপোলব্ধির অভাব অনুভব করে লাবণ্য। এর আগেও এমন উপলব্ধির সূক্ষ্ম বিচারজালে ফেসেছে হাবু। যখন লাবণ্য তাকে গ্রামটা ঘুরিয়ে আনার কথা বলেছিল, তখন সে কিছু বিলম্ব করেছিল সিদ্ধান্ত জানাতে। এটাই লাবণ্য লক্ষ্য করেছে। যাই হোক, প্রাথমিক পরীক্ষায় কিছুটা ছাড় তো দেওয়াই যায়। পরে সুদক্ষ দার্শনিক বানিয়ে নিলেই হলো। লাবণ্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাবুর কিছু বলার আশায়। যদি কাদামাখা পা তার চোখে পড়ে! কিন্তু তা হলোনা। হাবু নিশ্চুপ লজ্জামুখ দাঁড়িয়ে রইল। ব্যর্থ সময়ের পিঠে এবার হাত চাপড়ালো লাবণ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, 'চলো'।
তারা দুজনে পাশাপাশি, কিছু দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে চললো পূর্বদিকের কাচা রাস্তা ঘরে। আধঘণ্টার মতো হেঁটে তারপর নদীর পাশে জেগে ওঠা বসতবাড়িগুলোর কাছে পৌঁছল। পায়ে ব্যথা ধরেছে বটে। কিন্তু কোথাও বসবার জো নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে এখন। সবাই নিজের ঘরে। নিস্তব্ধ কাকডাকা দুপুরের অবসাদ গুটিয়ে এখন বিকেল নামতে শুরু করেছে চিলের ডানার নিচে আশ্রয় নেয়ার মতো। লাবণ্যর হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়া দেখে আর ঘন ঘন প্রশ্বাসের শব্দ শুনে হাবু তার ক্লান্তির মাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করে নিলো। না জানি কেন কিছুটা শঙ্কিত হয়ে লাবণ্যকে বললো, 'আফা কোথাও বইবেন?' লাবণ্য হাত নেড়ে তার অসম্মতির কথা জানিয়ে দিলো। কেবল তো নদীপাড় এসেছে, এখনো পুরো গ্রাম দেখা বাকি।  খানিক জিরিয়ে তারা আবার হাঁটতে লাগল। রাস্তা নদীর দিকপ্রবাহ বরাবর বেঁকে গেছে। নদীর গতিপথ যেদিকে, ক্ষুদ্র অনুসারী কাচা রাস্তাও সেদিকে গেছে। হয়তো নদীর সাথে নিজেকে তুলনা করতে চায়, নয়তো নদীর ভৃত্য সেজে তার সাথেসাথে চলার দৃশ্য দেখাতে চায়। হাবু গ্রামের ছেলে। পুরো গ্রামটা কয়েকবার পাক দিলেও তার ক্লান্তি খুব একটা আসবেনা কিন্তু লাবণ্য বড়ো নিস্তেজ, গ্রামের একটি অংশ দর্শনেই তাকে ক্লান্তিবোধ গ্রাস করেছে। যতোটা ভেবেছিল আগে, যে গোটা গ্রামটা দেখেই তবে বাড়ি ফিরবে, তেমনটা মনে হয় এখন আর সম্ভব না। এ গ্রাম বিস্তর। তবে গ্রামের এই বিস্তারিত গদ্যের প্রভাবে দর্শনশাস্ত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। লাবণ্য ঠিকই দার্শনিক বেশে হাবুর আরেকটা ভুল ধরতে সক্ষম হয়েছে। এতো ক্লান্ত হয়ে থেমে যাওয়ায় এবং খুব কাছাকাছি বাড়িগুলোর পাশে থাকার পরেও হাবু একবারও কোনো একটা বাড়ি থেকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি এনে তাকে পান করানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। গ্রাম্য ছেলেরা যেমনি সরল তেমনি অথর্ব। মনে মনে গালি দেয় লাবণ্য। পূর্ব থেকে বামে বেঁকে গিয়ে রাস্তা পড়েছে দক্ষিণে। হাবুর গ্রাম্য ভাষার শুদ্ধ বক্তব্য অনুযায়ী সেদিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অকৃত্রিম রুপধারা রয়েছে। যা দেখলে পরে দেখতেই চাবে এ মন। জুড়োবেনা কখনো। কিন্তু মন না জুড়োলে আর এসব সৌন্দর্য দেখেই বা কি লাভ! লাবণ্য ভাবে হাবুকে নিয়ে। আর ভাবে আগের কথাও। সহপাঠী রুদ্র তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। আরো অনেক প্রস্তাব এসেছে তার কাছে। সব বড় বড় পেশাদার। কিন্তু লাবণ্য অর্থ দেখেনি, দেখেছে দর্শন। তার যাচাই বাছাইয়ে কেউ টিকেনি। কেউ তার সখ্যতার সঙ্গী হবার যোগ্যতা রাখেনি। কারো দর্শনধারীতে দোষ তো কারো গুণবিচারীতে। হাবুর অতো দোষ ধরা পড়েনি। যদিও হাতেগোনা কয়েকটা আছে! লাবণ্য তার বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে এসব শুধরে নেবে। অন্যদিকে হাবু সরকারও ভাবে লাবণ্যকে নিয়ে। মেয়েটাকে তার খুব ভালো লেগেছে। যদিও সে মেয়েটার যোগ্য নয় তবুও সাত্তার মৌলবিকে একবার বলে দেখতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে যদি চিরতরে সে তার সখ্যতার সঙ্গিনী হয়ে যায়! মনের আনন্দে লাফায় হাবু। লাবণ্য ভাবে, মনের দিক থেকে হাবু স্বচ্ছ এবং বিনীত। সাদা মনে কোনো কাদা নেই আরকি। মনের সব কাদা সে ধুয়ে ফেলেছে। কিন্তু লাবণ্যর পায়ে যে এখনো কাদা! পায়ের কাদা না হয় পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা যাবে কিন্তু মনের কাদা কিভাবে ধোবে? সে নিজের ভেতর মনবাক্য রচনা করে, 'হাবু সরকার, তোমাকে দর্শনশাস্ত্রে জয়ী হয়ে আমার মনে জন্মানো তোমার ভুলস্বরুপ একগাদা কাদাও যে ধুয়ে ফেলতে হবে!'




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট