তোমরা আমাকে ডেকো বিবর্ণ সবুজ বলে...
মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
আমি কি মারা যাচ্ছি?
পিঠের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা উষ্ণ ¯্রােত। আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি ওটা রক্তা ছাড়া আর কিছু নয়। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। চারপাশের কোনো শব্দ আমার কানে আসছে না। আমি শুধু অনুভব করছি, একটা ¯্রােত বহমান আমার পিঠের নিচে। রক্তের ¯্রােত। আজ কুরবানীর দিন। এই তো সকালেই নামাজ শেষ করে গরু জবেহ করার সময় এরকম রক্ত¯্রােত দেখেছি। পিঠের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ¯্রােতটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে অনুভব করতে পারছি ওটা রক্তেরই ¯্রােত।
একটু আগেই একটি দ্রুতগামি মোটরসাইকেল আমাকে ধাক্কা দিয়ে গেছে। প্রচ- ধাক্কায় আমি আছড়ে পড়েছি পিচঢালা রাস্তায়। প্রচ- ব্যথা, অতপর অদ্ভুত এক ঘোর। এতটা তীব্র আঘাতে জ্ঞান হারানোর কথা ছিল। যেহেতু রক্তের েেস্রাত অনুভব করতে পারছি, তাহলে হয় তো জ্ঞান হারাইনি। নাকি সব কিছুই আমার অবচেতন মনে ঘটছে। জ্ঞান না হারালে তো আমার সাথে থাকা বন্ধুদের কথা শুনতে পেতাম। তাদের হুড়োহুড়ি টের পেতাম। কিন্তু আমি কিছুই টের পাচ্ছি না। পার্থিব কোনো শব্দই আমার কানে আসছে না। শুধু মনে হচ্ছে রক্তের ¯্রােত পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে পিচ ঢালা কালো পথটা।
মুখটা ভরে গেছে নোনতা স্বাদে। এ নিশ্চয়ই রক্ত! আমি অদ্ভুত ঘোরের মধ্যেই মনে করতে চেষ্টা করলাম কী ঘটেছে আমার সঙ্গে। হ্যা, একটু একটু মনে করতে পারছি। সকালে ঈদের নামাজ পড়েছি। বাবার সঙ্গে গরুর কাছে ছিলাম। গোশত মার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দিলাম। মা রান্না চড়িয়েছেন। ঠিক তখনই আমি ঈদের পাঞ্জাবী পড়েই বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। মা রান্না ঘর থেকে কী যেন বলছিলেন চিৎকার করে। আমি শুনতে পাইনি। ঈদের বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খোলা রাস্তাায় হাঁটার আনন্দের কাছে মায়ের সেই ডাকাডাকি কিছুটা গুরুত্বহীন মনে হলো। আমি বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটছিলাম। কথা বলছিলাম বিভিন্ন বিষয়ে। সম্প্রতি শেষ হওয়া মাস্টার্স ফাইনাল নিয়ে কথা হল বেশ। আমার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলতে ভুলিনি। মিষ্টি খাওয়ানোর প্রমিজও করতে হলো শেষ পর্যন্ত। একটু গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠেছিলাম এক ফাঁকে। তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো ‘এই আকাশ আমার’ কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।’ অতপর নীলিমাকে নিয়ে বন্ধুদের খোঁচা মেরে কথা বলা। আমি ছিলাম সবার ডান দিকে। আমি মনে মনে বললাম, নীল আকাশ নয়, নীলিমা কোনো উত্তর দেবে না। কখনই না। ঠিক তখনই মোটরসাইকেলটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে গেল।
আমি মোটর বাইক চালাতে ভালোবাসতাম খুব। রাস্তা ফাঁকা পেলেই গতি উঠিয়ে দিতাম। কেন যেন গতি আমার খুব ভালো লাগতো। মনে হতো গতি বাড়তে বাড়তে একদিন আলোর গতি পেয়ে যাব। ভবিষ্যত দেখতে পাব স্পষ্ট। দেখতে বোধ হয় পেয়েছিলামও। নইলে আমি হঠাৎ করেই আমার ফেসবুক আইডির নাম পরিবর্তন করে আরিফ থেকে বিবর্ণ সবুজ করতে যাব কেন? সব রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। আমি তো আসলেই এখন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছি। সবুজ আমার ডাক নাম। মায়ের আদর করে রাখা নাম। রক্তের ধারায় ক্রমেই যেন আমি বিবর্ণ সবুজ হয়ে যাচ্ছি।
আমার বাইক চালানোতে নীলিমার খুব আপত্তি ছিল। ও সবসময়ই বলতো, তুই কিন্তু কখনোই বাইক চালাবি না। কখনো না। তাহলে তোর সঙ্গে আড়ি দেব।’ কিন্তু আমার কেন যেন ওর নিষেধ অমান্য করতে বেশ ভালো লাগতো। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করত। নীলিমার পরিচয়টা বলা হয়নি। আমি ওকে খুব পছন্দ করতাম। পাগলের মতো ভালোবাসতাম। কিন্তু সেটা ছিল একতরফা। নীলিমা জানতো। ও থাকতো নিরুত্তর। তারপরও ওর কেয়ারিং শেয়ারিংয়ে আমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। আচ্ছা নীলিমা কি আমাকে বকবে আজ। কিন্তু আমি তো বাইক চালাইনি আজ। কেন বকবে?
রেডিওর নব ঘুরালে যেমন হঠাৎ হঠাৎ দুই একটি স্টেশন চলে আসে, আবার কিছুক্ষণ পরেই নয়েজ হতে থাকে। আমার মাথার মধ্যে এখন সেরকমটাই হচ্ছে। হঠাৎ শোরগোল শুনতে পাচ্ছি। আবার কিছুক্ষণ পর আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন ব্যথাতুর ঘোরে নিমগ্ন হয়ে যাই বার বার।
মায়ের মুখটা ভাসছে এখন আমার চোখে। আচ্ছা মা এখন কী করছেন? তিনি কী খবর পেয়েছেন আমার? আমার মন বলছে, মা এখন আমার প্রিয় মাংসের বড়া বানাতে ব্যস্ত। পরম মমতার স্পর্শে তৈরি করছেন মাংসের বড়া। প্রতিবারই মা বড়া বানান। প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলেন, বেশি খাবি না। তাহলে মোটা হয়ে যাবি। রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবি কিন্তু। তারপরও মা যেন চাইতেন, আমি আরেকটা খাই। সন্তান খেলেই মায়েদের চোখ জ্বল জ্বল করে। পরম তৃপ্তিতে তাদের মন ভরে ওঠে। হয়তো তাদের চোখের কোণায় তখন আনন্দের অশ্রু এসেও জমা হয়। মাথা নিচু করে খাওয়ার কারণে সেই জল আমরা দেখতে পাই না।
আমার রেডিওর নব আবার একটু ঘুরলো মনে হচ্ছে। শোরগোল শুনতে পাচ্ছি। বন্ধুদের চেচামেচি হবে হয় তো। কেউ একজন বলছে, অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে। তারচে’ বরং রিকশাভ্যানে করে উপজেলা হাসপাতাল কমপ্লেক্সে নিয়ে চল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’ অন্যরাও তার কথা সায় দিল। হ্যা তাই কর, তাই কর। সময় নষ্ট করা যাবে না। যে করেই হোক ওকে বাঁচাতে হবে।’
বাবার কথা মনে পড়ছে খুব। বাবার সাথে আমার কথোপকথন হয় অনেকটা ভারতীয় সিরিয়ালের মতো। নব্বই ভাগ কথাই হয় মনে মনে। বাকি দশ ভাগ হু হা। বাবা প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দেই। নিজ থেকে কিছু বলি না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-ছেলের সম্পর্ক যেমন হয়। কথাবার্তা সার্ফেস লেভেলে হলেও আমাদের সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। বাবাকে আমি প্রচ- রকমের ভালোবাসি। বাবাও বাসেন। কিন্তু কেউ প্রকাশ করি না। বাবা কিছু কিনে দিলে বা কেনার জন্য প্রত্যাশিত বাজেটের চেয়ে বেশি দিলে প্রচ- খুশি হই। কিন্তু মুখ ফুটে সেই খুশির কথা বলতে পারি না। মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দেই। প্রচ- আবেগে চোখ ছল ছল করে। মুখ ঘুরিয়ে নেই। বাবাও বুঝতে পেরে কেটে পড়েন।
সেই বাবার সাথে গত রাতে গড় গড় করে রাজ্যের কথা বলে ফেললাম। আমার মাস্টার্সের রেজাল্টের ব্যাপারে বিস্তারিত বললাম। আমার ফার্স্ট হওয়ার সম্ভাবনা বললাম। পড়া শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের জন্য কী কী করব তার একটা আবেগি বিবরণ পেশ করলাম। বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। চোখেমুখে তার ফুটে উঠেছিল খুশির ঝিলিক। বাবা হয়তো অবাকও হয়েছিলেন কিছুটা। ভাবছিলেন, ছেলে আমার হঠাৎ করে এত কথা বলছে কেন।
বাবা বললেন, আমার একটা ছেলে যদি বিসিএস ক্যাডার হয় তাহলে সেটাই আমার সফলতা। কষ্টের উপার্জন বিনিয়োগ সার্থক হবে।
-বাবা, আমার ভয় হয়। শেষ পর্যন্ত পারব তো আপনাদের আশা পুরণ করতে?
-বোকা ভয় কীসের? মনে আত্মবিশ্বাস রাখবি। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। পাশাপাশি পরিশ্রম করে যাবি।
-মাঝে মাঝে মনে হয় বিসিএস ক্যাডার হব না, শিক্ষক হব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
-শিক্ষক হওয়াও তো ভালো কথা। তবে বিসিএস ক্যাডার হলে আমি বেশি খুশি হব।
-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াটা কঠিন। বিসিএসও কঠিন। বাবা দোআ করবেন। েেদখবেন হয়ে যাবে।
-দ্যাখ বোকা ছেলে কী বলে। বাবার কাছে কী দোয়া চাইতে হয়?
কুরবানির গোশত রান্না করার জন্য নতুন কেনা মশলা মা গুছিয়ে রাখছিলেন বিভিন্ন কৌটায়। আমাদের কথোপকথন শুনে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। তার হাসির রেখাটা এখনো চোখে ভাসছে আমার।
আচ্ছা বাবা কী আমার খবর শুনতে পেয়েছেন? তিনি কী নিতে পারবেন এই খবর? এই ভার বহন তো অনেক কষ্টের। এই ভার তো বাবাকে পরাজিত করে দেবে। বাবার মেরুদ- বেঁকে যাবে এই বোঝা বইতে গিয়ে।
আশ্চর্য! আমি এরকমটা ভাবছি কেন। তাহলে কী সত্যি সত্যি আমি মারা যাচ্ছি? সিনেমায় যেমন ফ্ল্যাশব্যাকে অতীত দেখানো হয়। আমার মাথার মধ্যে এখন সেরকম হচ্ছে। শৈশবের বিভিন্ন খ-চিত্র ভেসে উঠছে চোখের সামনে। নিকট অতীতও আছে কিছু।
মাস্টার্স ফাইনাল শেষ হওয়ার দুই দিন পর ছিল আমার জন্মদিন। পুরান ঢাকার যে মেসে থাকতাম সেখানের বন্ধুরা জাঁকালো উদযাপন করেছিল। প্রিয় দোলন স্যারও ছিলেন। কেক কাটার পর ক্রিম মাখামাখির ঘটনাও বাদ যায়নি। সূচনা করেছিলেন দোলন স্যার নিজেই। মাখামাখির এক পর্যায়ে বাদ যাননি স্যারও। সেই অদ্ভুতুরে ক্রিম মাখানো মখুগুলো ক্যামেরাবন্দী করেছিল হাসান অথবা সোহাগ। মঞ্জুও কিছু ছবি তুলেছিল। সবশেষে ছিল মঞ্জুর কণ্ঠে হাসানের গান পরিবেশনা। জম্পেশ খাওয়া দাওয়া। সেই মুখগুলো বার বার মনে পড়ছিল। এরকম সেলিব্রেশন কী আর হবে? আচ্ছা ওরা এখন কী করছে? আমার খবর তো ওরা জানে না। ওরাও হয়তো মায়ের হাতের গোশত রান্না খেয়ে বেরিয়েছে হাওয়া খেতে। আড্ডা দিচ্ছে কোনো টং দোকানের সামনে বসে।
প্রচ- ব্যথা অনুভূত হচ্ছে এখন। সঙ্গে চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাচ্ছি। হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কে যেন কাঁদছে। মা নয় তো! কণ্ঠটা চেনার চেষ্টা করলাম। হ্যা! মা-ই তো! শিশুদের মতো করে কাঁদছে মা। শিশুদের কান্না যেমন সান্তনা দিতে গেলে আরো বেড়ে যায়। মাও তেমন। আমার বন্ধরা সান্তÍনা দিতে গেলে মা আরো জোরে কেঁদে উঠছে। একটু পরে বাবার কান্নার আওয়াজও পেলাম। ছোটো ভাইটাও কাঁদছে ভেউ ভেউ করে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কথা বলতে চাচ্ছি কিন্তু কোনো শক্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে সব স্নায়ু বিকল হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের আদেশ মানছে না।
আমার বাঁচার প্রবল আগ্রহ জেগে উঠল। রক্তের ¯্রােত তখনও বইছিল। সময়টা অনুমান করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছি না। পেছনের স্মৃতিগুলো কেমন যেন বিলিন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ফোল্ডার ধরে ধরে ডিলিট করে দিচ্ছে। পেছনের কোনো একটা স্মৃতি ধরে সময়টা বের করা যেত। সময় কী আমার জন্য স্থির হয়ে যাচ্ছে তাহলে?
আবার আমি অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলাম। এলোমেলো কিছু দৃশ্য ভাসছে চোখের সামনে। একবার দেখছি আমি ৮০ কিলোমিটার বেগে বাইক চালিয়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করে বলছে, আরিফ অতো জোরে বাইক চালাচ্ছিস কেন? পরক্ষণেই আমি ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছি। এবারও কে যেন আমাকে বলছে, এই হাদারাম, খালি পেটে সিঙ্গারা খেলে প্রচ- গ্যাস হয় সেটা জানিস না?’ শাসনগুলো অদ্ভুত মায়া ভরা ছিল।
আমার রেডিও নব ঘুরলো বোধ হয়। কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। নিশ্চয়ই মা। কেউ একজন বলল, ঈদের দিন তো। ডাক্তার কেউ নেই।’ আরেকজন বলে উঠল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো জরুরি ডাক্তার থাকবে না, এটা কী করে হয়? ঈদের দিন তো কী হয়েছে?
আমার মস্তিষ্ক খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। মা জড়িয়ে বসে আছেন সেই অনুভূতিটুকু শুধু কাজ করছে। অনুভূতি না স্মৃতি বুঝতে পারছি না। কিছু মনে করতে পারছি না। আমার প্রচ- ভয় করছে। মৃত্যুর পরবর্তী জগৎটা কেমন হবে কিছুই তো জানি না। সেখানে তো পরিচিত কেউ থাকবে না। মায়ের সঙ্গে আর কখনোই কথা বলতে পারব না। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, মা আমি বাঁচতে চাই। মা আমি বাঁচতে চাই। বাবা...। কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। অস্ফুট স্বরে বলতে চেষ্টা করলাম, বিদায় হে পৃথিবী। বিদায় মা। বিদায় বাবা। যাচ্ছি আল্লাহর কাছে। তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তোমরা আমাকে ডেকো বিবর্ণ সবুজ বলে।