অপমৃত্যু
নাজনীন সুলতানা নূহা
ছুটির ঘন্টা বাজে, হই হই করে ছাত্ররা ক্লাস থেকে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরে। প্রতিদিনের মতই রাকিব থাকে সবার আগে, তাকে কেউ ধরতে পারে না। কালামুন্সির ক্ষেতের আইল দিয়ে নেমে রাকিব পথ ছোট করার চেষ্টা করে। সাথে ক্ষেতের পাশের আম গাছটার আম কুড়ানোর সুবিধাটাও করে নেয়।
রাকিব আজকে খুব খুশি। একদম টসটসে পাকা দুইটা আম ধানের চারার ভিতরে পড়ে রয়েছে। তড়িগড়ি করে আম দুটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিযে সোজা বাড়ি। ভাইকে এভাবে আসতে দেখে মাহাদি ভাইয়ের পিছনে ছুটে। রাকিব রসুই ঘর থেকে দা নিয়ে বসে। মাহাদি বলে, আমারে দিবা? রাকিব চুপচাপ আম কেটে যাচ্ছে। বাটিতে রাখা আমের টুকরোগুলো মাহাদি একটা একটা করে গুনে রাখছে। রাকিবের কড়া নিষেধ, কাটা শেষ হবার আগে একটা ও মুখে দেওয়া যাবে না।
লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে শেফালি বেগম ছেলেদের কাছে আসেন, পিছনে আবদুল হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের পিছু পিছু আসে। আজকাল আর আবদুলকে কোলে নিতে পারেন না তিনি । খুব কাহিল লাগে শরীরটা, অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেন। সকালে রাকিবের বাবা ধরে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গেছেন, মনে হলো তখন যেন তিনি এক চুল নড়েতে পারছিলেন না। ছেলেদের দেখলেই যেনো একটু শক্তি পান। রাকিবকে আম কাটা দেখে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করেন, আম কোথা থেকে এনেছিস বাবা? রাকিব কালামুন্সির ক্ষেতের কথা বললে শেফালি বেগম ছেলেকে কাটা আম সহ আস্ত আমটি দিয়ে আসতে বলেন, সেই সাথে বলে দেন, ‘অনুমতি ছাড়া কারো গাছের কিছুতে হাত দেওয়া ঠিক নয়।’ রাকিব প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মায়ের শীতল চোখের দিকের তাকিয়ে গোটা আমটা নিয়ে কালামুন্সির বাড়ির দিকে রওনা দেয় সাথে কাটা আমেটির টুকরো গুলোও। নাজমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ছেলে গুলো কী তার মানুষ হবে? অজানা আশঙ্কায় হৃদয় যখন মূর্ছিত তখন কোথা থেকে এক ক্ষীণ সরু আলোর রেখা ভেসে উঠে। একটি অস্পষ্ট মুখচ্ছবি ক্ষাণিক ভেসে আবার তলিয় যায়। এটা তো রাকিবই, তাই না!..
নাজমা বেগম ক্ষাণিক শক্তি সঞ্চয় করে ঘরের দিকে পা বাড়ান।
২
সাধারনত রাকিব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে। বাবা ডেকে মসজিদে নিয়ে যান। আজকে মনে হচ্ছে বাহিরে রৌদ উঠে গেছে, তাহলে কী বাবা ডাকেনি? কিন্তু কেনো? বাবা তো এমন সচরাচর করেন না। হঠাৎ কী মনে পড়তে রাকিব উঠে এক দৌঁড়ে মায়ের ঘরে ছুটে যায়। ছোট খালা, মামা সবাই মায়ের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাকিব মামার এক পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে সরাসরি তাকায়, তার মনে হয় মায়ের দৃষ্টি পুরো ঘরে শুধু একটি জায়গায় স্থির, আর মায়ের দৃষ্টির গভীরতা রাকিবকে ক্রমেই তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। রাকিব অস্ফুট স্বরে ডাকে ‘মা’। মায়ের চোখের পাতা একবার নড়ে উঠে।
তারপর অনেকদিন চলে যায়, কিন্তু রাকিব অবুঝ মনকে বুঝাতে পারেনি, সেদিন ঘুম থেকে উঠে কেনো সে মায়ের ঘরে গেলো? কেনোইবা মা বলে ডাকলো? যদি সেদিন সে না ডাকতো তাহলে হয়ত মা বেঁচে থাকতো, মায়ের চোখ তো খোলাই ছিলো, এভাবেই নাহয় থাকতো। এখন তো একেবারেই নেই! সত্যিই নেই? রাকিবের বুক শক্ত হয়ে উঠে, হালকা কাঁপুনি আসে। নাহ!.. আর ভাববে না সে সেই কালো দিনটির কথা।
৩
রাকিবের অনেক দায়িত্ব, মেহেদি -আবদুল কে পড়াশোনা করাতে হবে, দেখে রাখতে হবে। মা মারা যাবার পর বাবাকে অনেকেই বিয়ে করতে বলেছে, ছোট বাচ্চা গুলো দেখে রাখার জন্য ঘরে একজন স্ত্রীলোক থাকা দরকার। কিন্তু ফারুক মিয়া খুব দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলো তিনি বিয়ে করবেন না, সন্তানদের যদি আপন বাবা দেখে রাখতে না পারেন, তবে সৎ মা কীভাবে দেখে রাখবে !.. ফারুক মিয়া বড্ড বেশি ভালোবাসতেন বউকে। তিনটি বছর ক্যান্সারে ধরে ঘরে শুয়ে থাকলে ও কখনো যতেœর ত্রুটি রাখেননি।
রাকিবের এখনো মনে আছে একদিন সন্ধ্যায় বড় ফুফু বাবাকে একটা মেয়ে ঠিক করছে বলে জানালেন।
বাবা তখন বললেন ‘নাজু, আমার শুধু বউ ছিলো না, প্রেমিকা ও ছিল; প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কত যুবক চিরকুমার থাকার নজির অহরহ আর আমি প্রেমিক কী বৈরাগী ও হতে পারবো না? সত্যিই বাবা বৈরাগী হতে মেয়ে চেয়েছিলেন কিন্তু ছেলেদের পিছুটানে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। যতদিন মনে হলো ছেলেগুলো অবুঝ ততদিনই ছিলেন, রাকিবের এইচএসসির পর একদিন সব কিছু রাকিবকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মায়ের কাছে।
আবদুলকে ছোট খালা নিয়ে যায়। মাহাদি কলেজের হোস্টেলে থাকে। বাবার রেখে যাওয়া দোকানের ভাড়া আর টিউশনের টাকায় রাকিব আর মাহাদির খরচ চলে। রাকিব খালাকে বলেছে অনার্স শেষ করেই একটা চাকরি নিয়ে আবদুলকে নিয়ে আসবে। তিনভাই মিলে একটা বাসা নিয়ে থাকবে। টিএসসি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাকিব এসব ভেবে যাচ্ছে। মাহাদিকে বুয়েটে ভর্তি করাতে কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাবে? আবদুলটাকে এখন থেকে একটু একটু স্বপ্ন দেখাতে হবে, আজকে বাসায় যাওয়ার সময় আবদুল এর জন্য খেলনার একটা স্টেথোস্কোপ নিয়ে যাবে।
৪
মিথিলা পাশে এসে এক থাপ্পড় দিয়ে বলল; এই ভবঘুরে, কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি, এমন করে কী ভাবছিস? রাকিব স্বল্পভাষী মানুষ, বলে; খেয়াল করিনি। মিথিলা কফির অফার করে, রাকিব কাজ আছে বলে মিথিলাকে এড়িয়ে চলে যায়। রাকিব বুঝে যে মিথিলা কেনো এমন গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে, কিন্তু রাকিবের এসবে মনোযোগ নেই। আগে তো ঘর তোলা পরেই না ঘরনি ঠিক করা।
ঢাবি ক্যাম্পাসে চার বছর অথচ বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই রাকিবের। রাকিব জানে বাস্তববাদী মানুষের তেমন বন্ধু জোটে না। বন্ধুদের দেওয়ার মত তেমন সময়ও নেই তার। টিউশন, বই পড়া, মাঝে মাঝে ভাইদের দেখে আসা এসবে ব্যস্ত থাকতে হয়।
আজকে আবদুলকে দেখতে খালার বাসা মিরপুর যাবে রাকিব। নিউমার্কেট থেকে বাসে উঠবে। কয়েকটা বাস চলে যায় রাকিব উঠতে পারে না। বাসে তিল পরিমান জায়গা নেই। দিনদিন ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনভোগান্তি। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, রাকিব কোনোরকমে একটা বাসে উঠে দরজায় ঝুলে পড়ে। গাড়ি ছুটে চলছে, রাকিব আনমনা হয়ে ফেলে আসা পথটায় চেয়ে আছে। এমন করে রাকিব কতগুলো অতীত ফেলে আসছে। হঠাৎ পিছনে একটা বাস খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো। রকিবের মনে হলো বাসটি কী একটু বেশিই জোরে চলছে না!
৫
আইসিউতে শুয়ে রাকিব মনে করার চেষ্টা করছে, লাস্ট কী হলো তার? কিন্তু সব কেমন যেনো ঝাপসা লাগছে, মাথা পুরা ব্লক, শরীরটা ভীষণ ভারি। আস্তে পা নাড়লো, হাত নাড়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু ডান হাতটা কেমন অপরিচিত লাগছে, দুইটা হাত নিয়েই তো রাকিব বাসে উঠছে। রাকিব এর খুব কষ্ট হয়, ঘেন্না হচ্ছে নিজের উপর!.. পঙ্গত্ব বরণ কত সহজে হয়ে গেলো, কিন্তু দুইটা ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করা কী সহজ হবে রাকিবের ?...
নাহ! পঙ্গত্ব নিয়ে আর রাকিব কে ভাইদের দায়িত্ব নিতে হয়নি। পৃথিবীর বুক আরেকবার নিঃস্ব করে দিয়ে রাকিব চলে যায় না ফেরার দেশে। আর একটি স্বপ্ন ঝরে যায় দুইটি চলন্ত বাসের প্রতিযোগিতায়। লিখে যায় আরেকটি অপমৃত্যুর গল্প।