শিল্পীর সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত কবে হবে?
আবুল খায়ের
সংগীত মানুষের মনকে আলোড়িত করে। খাদ্য যেমন পেটের খোরাক, তেমনি সংগীত হলো মনের খোরাক। সংগীত আত্মার পরিশুদ্ধতার একটি মোক্ষম উপাদান। সংগীত চর্চা একটি মননশীল পেশা। আর যারা এই সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের সাথে সম্পৃক্ত তারা সমাজের আর দশটা মানুষের মতো নয়। কিছুটা হলেও আলাদা স্বভাবের এবং আলাদা মন মানসিকতার হয়ে থাকে। যদিও তাঁদের কোন চাহিদা তেমন নেই-সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে। কেউ শখে বশে কিংবা নিজের কল্পনাকে বাস্তবরূপে প্রকাশের নিমিত্তে সংগীত চর্চা করে থাকেন। আমাদের দেশে সংগীত চর্চাকে এক সময় ভালো দৃষ্টিতে দেখা হতো না। সংগীতের একটি আধুনিক শাখা হলো ব্যান্ড সংগীত। পশ্চিমা সংগীতের অনুকরণে অত্যান্ত আধুনিক/ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং দেশীয় কিছু যন্ত্রপাতির সংমিশ্রণে একটি ফিউশান ধর্মী সংগীতই হলো ব্যান্ড সংগীত। যা আরো খারাপ বা পাগলাটে সংগীত হিসেবে মনে করা হতো শুরুর দিকে। তবে কালে ভদ্রে তা মানুষের মনে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এখন আর কেউ ব্যান্ড মিউজিক’কে অতোটা খারাপ দৃষ্টিতে দেখে না, বরং বেশ কিছু ব্যান্ড সংগীতের গান জনপ্রিয়তার চরম শীর্ষে অবস্থান করতে দেখা গেছে। যেকোন বিয়ে বা উৎসবে ব্যান্ড সংগীত না হলে কি আর চলে? তবে নামী দামী কিছু ব্যান্ড এবং ব্যান্ড তারকা মানে নতুন কিছু বা বেশী কিছু। যা অনুষ্ঠানকে নতুন মাত্রা দিয়ে থাকে। নব্বইয়ের দশকে ব্যান্ড মিউজিক ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ৮০ থেকে ৯০ দশক’কে এদেশের ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
বিশে^র প্রায় সব দেশেই সংগীত শিল্পীদের সম্মান অনেক উঁচুতে থাকে। শিল্পীরা যেন যথাযথ সম্মান এবং সম্মানী পেতে পারেন তার জন্য রয়েছে বহু সংস্থা এবং রাষ্ট্রীভাবে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা, তদারকি ও ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা। শিল্পীদের শতভাগ সম্মানী/রয়্যালিটি পাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য যা করা দরকার তার সবই আছে উন্নত দেশগুলোতে। আমাদের দেশে এখনও এরকম কোন সংস্থা নেই, যারা শিল্পীদের যথাযথ সম্মানী বা রয়্যালিটি নিশ্চিত করবে। ফলে শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাঁদের ন্যায্যপ্রাপ্য থেকে। অনেকে প্রতারণার স্বীকার হতেও দেখা যায় মাঝে মধ্যে। কোন গান-কখন, কোথায় বাজতেছে, তা একজন শিল্পীর জানার কোন উপায় নেই বা হিসেব রাখার কথা নয়, তা সম্ভবও নয়। তাহলে কে নিশ্চিত করবে শিল্পীর গানের রয়্যালিটি/সম্মানীর। কে দেখবে, কার দায়িত্ব? এসব দেখার কেউ নেই? অথচ সংগীত বড় একটি শিল্প মাধ্যম এবং বহু জনবল এ সেক্টরের সাথে জড়িত। যাঁরা বাংলা সংগীতকে বিদেশে নিয়ে গেছেন এবং যাঁদের অবদানের কারণে আজ বাংলা সংগীত সারা বিশে^র মধ্যে একটি মর্যাদার স্থান দখল করে আছে। তাঁদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান নিশ্চিত করা জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। যে দেশে গুণীর কদর থাকেনা, সে দেশে গুণী জন্মায় না।
আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্মান প্রায়শই দেখা যায়-মরনোত্তর প্রদান করতে। যা একটি শিল্পীর জন্য সম্মান দেখানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে যদি ওই সম্মান নিশ্চিত করা যায়, তবে শিল্পীদেরকে যথাযথ সম্মান জানানো সম্ভব। বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ফাহমিদা নবী এক টিভি সাক্ষাতকারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-তাঁর বাপের গাওয়া গানের জন্য তাঁরা কোন দিনও কিছুই পাননি। নিজের গাওয়া গানের কী হবে তাও তিনি জানেন না। প্রখ্যাত ব্যান্ড তারকা মাইল্সের শাফিন আহমেদ একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন-তাঁর বাপের গাওয়া, মায়ের গাওয়া গানের কোন প্রকার রয়্যালিটি কখনও তারা পাননি। নিজের গাওয়া গান নিয়ে কী হবে তাও জানেন না। তবে সোলসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য টিপু’র আশা-যেহেতু কিছু কিছু কাজ হচ্ছে ইদানিং রয়্যালিটি ও শিল্পীদের অধিকার নিয়ে, তবে সেটা আরো দ্রুততার সাথে এবং ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত বলে মনে করেন। তবে শিল্পীদের পাওনার বিষয়ে শিল্পীরা নিজেরাও অনেকটা উদাসিন, যার ফলে কোন আন্দোলনই সফলতার মুখ দেখছেনা বলে মনে করেন তিনি।
ব্যান্ড তারকা গীতিকার, সুরকার, লিডগিটারিষ্ট (এলআরবি), সঙ্গীতাকাশের উজ্জল নক্ষত্র, ব্যান্ড সংগীতের রাজাধিরাজ, সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু পরপারে পাড়ি দিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর এই অকাল প্রস্থানে কী পরিমান ভেঙ্গে পড়েছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। ঢাকা থাকতে তাঁর কোন কনর্সাট মিস্ করতাম না। যা হোক। তাঁকে আমি দেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে ‘বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড্স এসোসিয়েশন (ইঅগইঅ)’ আয়োজিত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে ‘শাহিন স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে, ঢাকায়; এবং সর্বশেষ গত ১৬ তারিখ রংপুর জেলা স্কুল মাঠে। ঢাকা’র সেই কনসার্টের উচ্ছ্বাস আর রংপুরের কনসার্টে তাঁর সে উচ্ছ্বাস আমরা দেখিনি। হয়তো অসুস্থ থেকেও ভক্তদের টানেই ছুটে এসেছেন রংপুরে। ঢাকার এক কনসার্টে তিনি বলেছিলেন যদি-আবার পৃথিবীতে আসতে পারতাম! কারণ ভক্তদের এতো ভালোবাসা পেলে কে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাইবে? যাক সে সব। তিনি কী জানতেন-এই কনসার্টই তাঁর জীবনের শেষ কনসার্ট? মঞ্চে উঠেই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধাভরে। গাইলেন দরদ দিয়ে-‘অবিনাশী আমি, অভিমানী তুমি.. যানে অন্তর্যামী... কেউ আগে পরে, সবাইকে একা করে-চলে যাবো অন্ধঘরে, আর কতো এভাবে, আমাকে কাঁদাবে? আরো বেশী কাঁদালে... উড়াল দিবো আকাশে।। এই গাওয়াই তাঁর জীবনের শেষ গাওয়া। এই দেখাই শেষ দেখা!
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর গাওয়া গানগুলোর চাহিদা আরো অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যা সামাজিক যোগাযোগ’সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিয়মান হচ্ছে। এমনিতে তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গান সকল শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে-সে নব্বইয়ের দশক থেকে। দূভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে-তাঁর গাওয়া গানগুলো বাজবে বিভিন্ন চ্যানেলে বা রেডিও’তে, কিন্তু রয়্যালিটি সিস্টেম না থাকার কারণে তাঁর পরিবার বঞ্চিত হবে রয়্যালিটি থেকে। যদিও আইয়ুব বাচ্চু’র মতো অনেক গুণী শিল্পীরা এদেশে বেঁচে থাকতে যথাযথ মুল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। ব্যান্ড সংগীতের গুরু প্রয়াত আযম খান, প্রয়াত লাকী আকন্দ’সহ আরো অনেকেই বেঁচে থাকতে যথাযথ মুল্যায়ন পাননি। তাঁদের সৃষ্টিকর্ম কী অবস্থায় আছে, কেউ জানে না। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করার দাবী ভক্ত ও শ্রোতাদের।
অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে..., আম্মাজান আম্মাজান তুমি বড়ই মেহেরবান...প্রভৃতি প্লেব্যোক গান সাধারণ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদিও তিনি আইয়ুব বাচ্চু প্লেব্যাক থেকে অনেকটা অভিমান করে দূরে ছিলেন বহু দিন। চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ এক সাক্ষাতকারে বলেছেন-কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু একদিন তাকে বলেছিলেন যে ‘আম্মাজান’ গানটির জন্য তাঁর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল কিনা?
আন্তর্জাতিকভাবে প্রত্যেকটি গানের জন্য একটি ‘ইউনিকোড’ থাকে। ফলে দেশে বা বিদেশে যেখানেই ওই গান বাজবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা/প্রতিষ্ঠান ওই গানের যাবতীয় পাওনা/রয়্যালিটি নিশ্চিত করে শিল্পীকে পৌঁছে দিবে। শিল্পী ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন তাঁর যাবতীয় পাওনা। কিন্তু আমাদের এরকম কোন সিস্টেম আদৌ হয়নি বা কোন অজানা কারণে নিশ্চিত করা যায়নি। দেশে এরকম সিস্টেম চালু হওয়া জরুরী। শিল্পীদের প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন/পাইরেসী এ্যাক্ট কার্যকর সময়ের দাবী। তবে সেটা শিল্পীরা দুনিয়াতে বেঁচে থাকতেই হতে হবে। কাউকে মরনোত্তর মুল্যায়ন করলে, সেটা কখনও সঠিক মুল্যায়ন হতে পারে না। সঠিক নীতিমালার অভাবের কারণে বহুশিল্পী তাঁদের শিল্পী সত্তাকে বিকিয়ে দিচ্ছে অকাতরে। গুণী শিল্পীরা অনেকেই মান সম্মানের ভয়ে মুখ না খোলার কারণে প্রকৃত ঘটনা জানাও যায়না।
পরিশেষে কিংবদন্তি ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু’র প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। পাশাপাশি সকল গুণী শিল্পীদের মূল্যায়ন তাঁদের জীবদ্দশায় বা বেঁচে থাকতেই নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মাদকমুক্ত ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে সংগীত ভূমিকা রাখবে। সংগীত সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে এগিয়ে যাবে। দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত গুণীদের নির্বাচিত করে সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে যথাযথ সম্মান জানানো নিশ্চিত হবে, সেই প্রত্যাশায়।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ঊন্নয়ন কর্মী।