স্বপ্নের নীল মেঘের স্বপ্ন
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।
স্বপ্ন খুব অস্থির। ঘরের ভিতর এপাশ ওপাশ পায়চারি করছে। কিন্তু মনটাকে একটা জায়গায় ধরে রাখতে পারছেনা।
এখন তার কাছে মনেহয় স্বপ্ন নামটাই তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্ন স্বপ দেখা শুরু করে।
অনেক স্বপ্ন মনে থাকে আবার অনেক স্বপ্নমন থেকে হারিয়ে যায়।
যে স্বপ্নগুলো মন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সেগুলো হারিয়ে যাওয়া জিনিসের মতো হাতড়াতে থাকে স্বপ্ন। কিন্তু যাজীবন থেকে হারিয়ে যায় তাকি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়। কে জানে?
প্রতিদিনের স্বপ্ন আর গতরাতের স্বপ্ন এক রকম না।
এমন একটা স্বপ্ন যা বিশ্বাস করা যায়না আর অবিশ্বাসেরও সুযোগ নেই।
বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে কমতে এক সময় থেমে যায়। কিন্তু স্বপ্নের অস্থিরতা কমে না।
বাড়ির সামনের টং ঘরের মতো চায়ের দোকানটার ব্রেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে থাকে স্বপ্ন।
পিছন থেকে ধাক্কা দেয় নীল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় স্বপ্ন।
কিরে স্বপ্ন মাথা নিচু করে বসে আছিস। বুড়ো দোকানদারকে ইশারা করে নীল বলে, চাচা গরম গরম দু’টা চা দাওতো।
চা খেতে খেতে নীল জিজ্ঞেস করে, স্বপ্ন, বলতো তোর কি হইছে।”
স্বপ্ন বলে কিছুনা। নীল একটু সিরিয়াস হয়ে বলে কিছু তো একটা হয়েছেই। আমার কাছে কি লুকোতে পারবি?
স্বপ্ন এবার নীলের দিকে তাকায়। স্বপ্নের এই তাকানোটা নীলের কাছে আকাশ ভেঙে মেঘ পড়ার মতো মনে হয়। চোখ দুটো ছলছল।
নীল স্বপ্নের ভিতরের কষ্টটা বুঝতে পারে। আরেকটু কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে নীল বলে, কিরে দোস্ত, বলতো তোর কষ্ট কিসে!
এবার দোকানের সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর সামনেই স্বপ্ন হু হুকরে কেঁদে উঠে। নীলের মনে হয় ভিতরের চাপাকান্নার বিস্ফোরণের মতো ।
দোকানের আশেপাশের লোকজন স্বপ্নকে ঘিরে দাঁড়ায়। সবার একটাই প্রশ্ন কি হয়েছে ওর।
নীল লোকজনকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, আরে ভাই সরেন তো ভাই। এটা আমাদের দুই বন্ধুর বিষয়। এতো কিছু বলার পরও লোকজন সরে না। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে কি একটা গুপ্তধনের রহস্য হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
নীল একটু হালকা হয়। চোখ দুটো উপরে তুলে বলে কি হয়েছে রে বোকা। এই বয়সে মানুষ কাঁদে।
স্বপ্ন এবার চোখের কান্না ছেড়ে মুখ খোলে।
না তেমন কিছুনা। কিন্তু অনেক কিছু। আমার সব স্বপ্নই তো সত্যি হয় জানিস। ভালো মন্দ মিলিয়ে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কাল দেখলাম আমি মরে গেছি। ঘুমোতে গিয়ে আর উঠছিনা। মা, বাবা, তুই সবাই কাঁদছে। এরপর আবার একটু কেঁদে উঠে বিরহীর মতো বলে আমি আর বাঁচবো নারে। আমাকে সবাই মাফ করে দিস।
ঘিরে থাকা লোকজনের মধ্যে লাঠিতে ভর করা বুড়োটা আফসোস করে বলে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখছিস রে বাজান। খুব খারাপ স্বপ্ন। আহাপোলাপানটারে আমি কোলেপিঠে মানুষ করছি। আমার আগে চলে যাবে।
নীল ধমকে বলে, থামেন তো দাদা। কি যে বলেন। স্বপ্ন আবার সত্যি হয়।
হয় হয়। স্বপ্নই তো সত্যি হয়। গেলো মাঘে আমার দাদিটা স্বপ্নে দেখলো উনি আর বাচঁবেন না। কি বলবেন ভাই। এটা বলার দুদিনের মধ্যে মারা গেলো। একটু জোর গলায় কথাটা বললো এলাকার মাস্তান গোছের বড়ভাই।
এবার বুড়ো দোকানদার বললো, স্বপ্নের স্বপ্ন তো কখনো মিথ্যে হতে দেখিনি। যখনই ও স্বপ্নের কথা বলেছে তা সত্যি হয়েছে। কোনোটাই মিস হয় নি।
নীল এবার জোরে ধমক দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বলে, আরে ভাই এখন থেকে সরেন তো। যত্তো সব আজগুবি গপ্পো।
যে যার মতো চলে যায়।
নীলও স্বপ্নকে দুশ্চিন্তা করতে না বলে রাস্তার মোড়টা বেঁকে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়।
নীল কোনোদিন স্বপ্ন দেখেনি। স্বপ্ন কি নীল জানেনা। কিন্তু সে জানে স্বপ্ন যে স্বপ্ন দেখে তা সত্যি হয়।
কি যেন একটা ভেবে নীল মোবাইলে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে আসে। কথা হয়। নীল আর স্বপ্নের কথা।
নীল ঘুমিয়েছিল। নীলের ঘরের দরজায় ধাক্কা। নীল উঠ, বাবা উঠ। মা ডাকে আর দীর্ঘশ্বাস দেয়। আহা মায়ের একমাত্র ধন চলে গেলো রে।
নীল চোখ কচলাতে কচলাতে বলে কি হয়েছে মা। এতো সকাল সকাল ডাকছো। উঠরে তোর বন্ধু স্বপ্ন আর নাই। আহা বাছারে, রাতে খুব হাসি খুশি হয়ে ঘুমাতে গেছিলো। আর ঘুম ভাঙলোনা। পাখিটা উড়াল দিলো।
নীল কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায়, চিৎকার করে কাঁদতে যায় কিন্তু কেন যেন থেমে যায়। যে বন্ধুকে জীবনের চেয়ে ভালোবাসে নীল তার জন্য সে কাঁদছেনা। নিজের কাছেই অবাক লাগে নীলের। নিজেকে নিজেই আজ চিনছেনা নীল। নীলের নীল রঙের কষ্টগুলো যেন মরে গেছে আর মনে মনে সৃষ্টি হয়েছে একটা গোপন আনন্দ। বন্ধুকে হারিয়ে পাবার আনন্দ। কিন্তু সেটা আজ বন্ধুর ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে গেলো। নীল ভেবে কুল কিনারা পায়না। কষ্ট করে মনের খুশিটা চেপে রেখে কাঁদো কাঁদো চেহারাটা করে নীল স্বপ্নদের বাড়িতে ঢুকে। চারদিকে কান্না, কষ্ট আর হাহাকার। কিন্তু নীলনির্বিকার। স্বপ্নের নিথর মৃতদেহটা দেখেও কষ্ট হচ্ছেনা। কান্না পাচ্ছেনা।
শেষবারের মতো সবাই দেখছে স্বপ্নকে। স্বপ্নের মৃত দেহের উপর কপাল চাপড়িয়ে আচ্ছাড়ি বিচ্ছাড়ি খাচ্ছে তার মা। নীল তবুও নির্বাক।
মাটির কবরে স্বপ্ন। সবাই মাটি ফেলছে। নীল দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। কিন্তু কান্না নেই, কষ্ট নেই, হাহাকার নেই, হারানোর বেদনা নেই।
নীল অনেক বেলা হয়েছে উঠ উঠ। আর কতো মরার মতো ঘুমাবি।
নীলের ঘুমন্ত শরীর বিছানা থেকে চোখ মেলে। বাইরের কড়া সূর্যের আলোটা তার চোখকে যেন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
নীল নিজের দিকে তাকায়। এতক্ষন যা দেখেছে সব স্বপ্ন। সত্যি নয়। স্বার্থপর একটা মানুষ সে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। খুব ঘৃণা হয় নিজেরউপর। তার জীবনের প্রথম স্বপ্ন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সে কত বেশি স্বার্থপর।
নীল ভুলটা বুঝতে পারে। কেউ জানেনা নীলের এই স্বার্থপর তারকথা। স্বপ্নও জানে না।
কিন্তু নীলের বিবেক আর মন তো জানে।
নীল নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। অস্থির হয়ে উঠে তার মন। তার মনে যে পাপ ছিল তা থেকে সে মুক্তির পথ খুঁজে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে স্বপ্নদের বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। বিয়ের সানাইয়ের শব্দ কানে ভেসে আসে। স্বপ্ন বন্ধুকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে। স্বপ্ন হাসতে হাসতে বলে নীল তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলে কিছু বলিনি। বউ নিয়েই তোর বাড়িতে আজ যেতাম। আমি মেঘকে বিয়েটা করেই ফেললাম।
কথাটা শুনে কষ্ট হয় নীলের। কষ্ট কেন, কিসের কষ্ট। নীল নিজেকে সামলে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এবার নীলের ভিতরের বিবেক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিবেকটা অদৃশ্য কিন্তু খুব দৃশ্যমান। দমকা হওয়ার মতো ধাক্কা দেয় তাকে। এবার বুঝে নীল, স্বপ্ন যেমন মেঘকে ভালোবেসেছিলো সেও মেঘকে ভালোবেসেছিলো। প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এই জন্য তার মধ্যে নিজের অজান্তে স্বপ্নের প্রতিহিংসা তৈরী হয়েছিল। স্বপ্নকে সে স্বপ্নে মরতে দেখেছিলো। স্বপ্নের কাল্পনিক মৃত্যু তার কাছে মনে হয়েছিল বাস্তব। কিন্তু সে কাঁদেনি কষ্টও পায়নি। নিজের স্বার্থপর মুখটা লজ্জায় ঢাকলো নীল। খুব ছোট মনে হলো নিজেকে। স্বার্থের চেয়ে ত্যাগ যে অনেক আনন্দের সেটা তার বিবেক থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিছুই আর বলা হলো না নীলের। নির্বাক ক্ষমায় নত হলো তার মন। জড়িয়ে ধরলো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু স্বপ্নকে। কেউ কিছু জানবে না কোনোদিন। নীল জেনেছিলো কিন্তু ভুলে যেতে চায়।
আবার মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামে নীল আকাশ থেকে স্বপ্ন দেখবে বলে।
স্বপ্নের মেঘ আর নীলের স্বপ্ন সব কোলাহলের ভিড়ে নতুন জীবনের সন্ধানে নামে। যেখানে মন কি চায় কেউ জানেনা। জানবে না কোনোদিন।