প্রিয় শিক্ষক মৃণময় দাস
নূরনবী সোহাগ
নাইন-টেনে পড়া কালীন সময় স্কুলে প্রতিদিন প্রায় আট’টা ক্লাস হতো। টিফিনের আগে পাঁচটা পরে তিনটা। টিফিন পরবর্তী ক্লাসগুলো অনেক সময় করা হতোনা। সোজা বাংলায় টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পালাতাম। আমাদের ক্লাসশুরুর প্রথমদিকে ইংরেজি, গণিত, বাংলা আর গ্রুপের দু একটা ক্লাস হতো। প্রথম পিরিয়ড থেকে প্রত্যেক শিক্ষক ক্লাসে আসতেন। হড়বড় করে পড়াতেন, রোল ডাকতেন, ক্লাস ঘণ্টা পড়লে চলে যেতেন। এরকম করে চতুর্থ পিরিয়ডে আসতেন সুধীর স্যার। তিনি বাংলা পড়াতেন। আমি ধীরে ধীরে খেয়াল করতে শুরু করলাম তিনি নিছক বাংলা গল্প, কবিতা পড়াতে আসতেন না। তিনি পাঠ্য বইকে, পড়াকে, বাংলাকে ভালোবাসাতে আসতেন। তিনি ক্লাসে থাকাকালীন সময় পুরো ক্লাসে ভর করতো সুনসান নিরবতা। সবাই যেন ভুলেই যেতো ক্লাসে পড়ার ফাঁকে কলম দিয়ে খোঁচা দেওয়া, স্কেল ফেলে দেওয়া, হিহি করে হেসে দেওয়া, অকারণে পানি খেতে যাওয়া। কারণ তখন সবাই সত্যি সত্যি ক্লাসের পড়ায়, জানায় মগ্ন হয়ে যেতো। দিন দিন এমন হতে শুরু করলো যে একমাত্র সুধীর স্যারের ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের একটা বাড়তি চাপ পড়তে লাগলো। পচাত্তরজন শিক্ষার্থীর ভেতর যেন একজনও অনুপস্থিত নেই ক্লাসে। নেই কোনো হৈহুল্লোড়, কোনো বাড়তি আওয়াজ। একজন যাদুকর যেন মুখ দিয়ে শব্দের যাদু দেখাচ্ছেন আর সকল দর্শকরা সেই যাদু চোখ কান খোলা রেখে গো-গ্রাসে গিলছে।
কি বিস্ময়কর সে দৃশ্য! ভীষণ মনে পড়ছে স্যারের একটা ক্লাসের কথা। সেদিন ক্লাসে ‘জীবন বিনিময়’ কবিতার শেষ তিন পঙক্তির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। ক্লাসের ঘণ্টা পড়লো। কিন্তু আমরা কেউ তেমন গায়ে মাখলাম না। যে যার মতো মুখটা একটু আড়াল করতে চাইছিলাম সবাই। আমি খেয়াল করলাম কেবল আমার চোখই ভিজে নি। প্রায়জনই চোখ ঢাকছে আঙুল দিয়ে। বোধ করি, সেদিন থেকে আমি কবিতাকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করি। বাংলার প্রতি আরো ভালোবাসা বাড়তে শুরু করে। স্যার বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। একজন শিক্ষকের সফলতাটা এখানে। এত এত বছর পরেও আমি তার কথা মনে রেখেছি। হয়তো অনেকেই রেখেছে। শিক্ষকের গড়পড়তা বৈশিষ্ট্যর মধ্য সুধীর স্যারের কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য ছিল যা বরাবরই অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে তাকে আলাদা করে রাখতো। এমন শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্বে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানি।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলো ২০১৬ তে। আমি স্বভাবত কারণে শিক্ষকদের ভালোবাসি। তিনি শেখান এটুকু পরিচয় জানলেই আমি তার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হই। তবে মনের মতো শিক্ষকদের প্রতি আমার আলাদা রকম দুর্বলতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে মনের মতো শিক্ষকের ক্ষুধায় ভুগছিলাম। সৃষ্টিকর্তা হয়তো তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় বছরের নতুন সেমিস্টারে ক্লাসে এক জোয়ান এসে বসলো শিক্ষকের আসনে। দেখতে একদমই শিক্ষকদের মতো গুরুগম্ভীর নয়। হালকা পাতলা শরীর, বড় বড় চুল বামপাশে সিঁথি করে রাখা, চোখে লাল ফ্রেমের চশমা, হাতে মার্কার। ক্ষাণিক বাদে হঠাৎ অকারণবশত তিনি হাসলেন। হাসলাম পুরো ক্লাস সুদ্ধ সবাই। তিনি বললেন- আমি মৃন্ময় দাস। তার বাকী কথাগুলো মনে হচ্ছিলো অনেক পুরনো কোনো নিয়মে আমি অনবিরতভাবে গিলছি। তার বাচনভঙ্গি, মূকাভিনয় ও পড়ানোর ধরণ আমাকে প্রথম দিনেই প্রবল আকৃষ্ট করলো। পুরো সেমিস্টারে তার ক্লাস আর বাদ দেইনি। কেবল তার বিষয়ে পাশ করতে চাই বলে নয়। তার শেখানোর ভঙ্গিমাটা মিস করতে চাইতাম না। তিনি যেন বুঝতেন ক্লাসের পুরো শিক্ষার্থীর চোখ, মুখ, অন্তর এখন কি বলছে!
কেন বলছে?
আমি দ্বিতীয়বার কোনো শিক্ষকের দিকে বিস্ময় ভরে তাকালাম। কিভাবে তিনি পারেন? কেন অন্যরা নয়?
শিক্ষকতায় যারা আসেন তারা অবশ্যই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই আসেন। তবে কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের শিখতে আগ্রহী করে তুলতে পারেন তবে তার কাজটা আরো বেশি সহজ হয়ে যায়। এই আগ্রহী করতে পারাটা হয়তো শিক্ষকদের একান্ত যোগ্যতা। এর কোনো সার্টিফিকেট হয়না। হয়তো সেই মৌলিক গুন শেখানো হয়না কোনো প্রশিক্ষন কেন্দ্রেও। তারা নিজেরা অর্জন করেন শেখানোর ভিন্ন কৌশল। সুধীর স্যার ও মৃন্ময় দাস স্যারের মতো শিক্ষক দরকার আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। যারা মুখের মধ্য যাদুর শব্দ নিয়ে ক্লাসে ঢুকবেন। আর এক দুই করে তিন তিনটা ঘণ্টা কেটে যাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে।