আমার আব্বা



আমার আব্বা
বাসার তাসাউফ

আমার আব্বাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছি না। অনেকেই বলবেন, পিতাকে নিয়ে পুত্র গল্প লিখবে- এ আর কী এমন কঠিন কাজ! পিতা-পুত্রের মাঝে তো অসংখ্য গল্প থাকে। হ্যাঁ, থাকে। আমার আব্বাকে নিয়ে আমি অসংখ্য গল্প লিখতে পারতাম, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন। (ইতিমধ্যে আপনারা অনেকেই হয়তো অবগত হয়েছেন, গত ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত ২ টা ০৫ মিনিটে আমার আব্বা মুত্যুবরণ করেছেন) মৃত পিতাকে নিয়ে লিখতে গেলে একজন পুত্রের কী রকম কষ্ট হয়, তা কেবল পিতাহারা পুত্ররাই জানার কথা। আমার আব্বার মৃত্যুটা ঘটে গেল আকস্মিভাবে। একজন সুস্থ-সবল মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন ১০ মিনিটি পরই খবর পেলাম তিনি রোড এ্যাকসিডেন্ট করে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। তারপর এ্যাম্বুলেন্স, ঢাকা মেডিকেল হলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল, ৫ ব্যাগ এ+ রক্ত সংগ্রহ, অপারেশন, সাইন্স নিয়োরলজি হয়ে আবার ঢাকা মেডিকেল হলেজ, ডাক্তারদের বোর্ডমিটিং, আই.সি.ও তে নেওয়ার পরামর্শ। কিন্তু পরিবারের মুরব্বিদের সিদ্ধান্তে আই.সি.ও তে না দিয়ে বাসায় ফিরে আসা। অতঃপর বাসায় তিন দিন থাকার পর মৃত্যুর কোলো চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া... সহজ ভাষায় এই কথাগুলো লিখতে পারলেও আব্বার মৃত্যুটা সহজভাবে মেনে নেওয়ার মতো প্রস্তুত ছিলাম না আমি বা আমার পরিবারের কেউ। আব্বার মৃত্যুর পর আমাদের কাছে বিশেষত আমার কাছে অনুভূত হয়েছে, মৃত্যু শব্দটি পৃথিবীতে কতটা নিষ্ঠুর একটি শব্দ! নিষ্ঠুর হলেও এটি নশ^র এ পৃথিবীতে সবচেয়ে সত্য ও চিরন্তনও একটি বিষয়। হবেই বা না কেন? জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই ¯্রষ্টাই তো বলেছেন, ‘কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত!’ 

আমাদের এলাকার পাঁচ-দশ গ্রামজুড়ে আব্বা ছিলেন প্রায় সকলেরই প্রিয়ভাজন। শুধু প্রিয়ভাজন বললে আব্বার প্রতি অসম্মান দেখানো হয়। প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা প্রিয়মুখ শব্দ দু’টি যোগ করলেও যথাযথ হয়ে ওঠে না। সেদিন আমাদের মাদরাসা মাঠে আব্বার জানাজায় হাজার হাজার মানুষের চোখের জল শুধু আমাকে এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার আব্বা বেঁচে থাকতে মানুষের কত প্রিয় ছিলেন!

অনন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমার আব্বা। কত বছর আগে সেটা আমরা কেউ জানি না। আমার দাদা কিংবা দাদি আব্বার জন্মতারিখ লিখেন নি কোথাও। এজন্য আব্বার সঠিক বয়স জানা যায় নি। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খাতায় বয়স লেখা হয়েছিল ৭২ বছর। সেই অর্থে আব্বার বয়স ৭২ বছরই ধরে নিতে হয়। আব্বার ডাক নাম ছিল মাজু। পুরো নাম মোহাম্মদ মাজুউদ্দিন ভূঁইয়া। আমাদের গ্রামের অন্য পরিবারগুলোর মতো দাদার পরিবারেও কৃষি কাজ ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, আমার আব্বার বয়স যখন ২১ তখন দাদা মারা যান। সেই সময় থেকে আমার আব্বা সংসার নামের ভাঁড়ারটি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আর সেটা নামানোর আর সুযোগই পেলেন না। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮’তে এসে তিনি কাঁধ থেকে সকল ভাঁড়ার নামিয়ে চিরতরে ভারমুক্ত হলেন।

আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেকদিন মনে হয়েছে, আগামীকাল যখন আমি কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরব, তখন সবাইকে দেখব, ঘরে অনেক মানুষ থাকবে। আমার কাকারা, কাকিরা, ভাইবোনেরা, এমনকি আমার আম্মাও থাকবে। সাধারণত আমি ঘরে ফিরলে আব্বাকে দেখতাম মাগরিব নামায শেষে খাটের ওপর বসে তসবিহ জপছেন। আমাকে দেখে বলতেন, ‘বাসার আইলি?’

          ‘হ, আব্বা আমি আইছি।’

আব্বা একচিলতে হাসতেন। আমিও হেসে নিজের ঘরে চলে যেতাম। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি ঘরে ফিরলেই কাঁদি। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমার আব্বা আর নেই। আব্বা ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে গল্প লেখতে বলেছিলেন, যিনি আমাকে মানুষের কল্যাণ হয় এমন কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। আব্বা বলতেন, ‘সৎ ও ন্যায়ের পথে চললে কেউ ঠকাইতে পারবে না।’

আব্বার সেই কথার পর নিজের মাঝে বিশ^াস জন্মেছিল। এ কারণে আব্বা ছিলেন আমার জীবনের সুপার হিরো। আমার সেই সুপার হিরোকে হারিয়ে যে আঘাত পেয়েছি, যে কষ্ট পেয়েছি, যে দুঃখ পেয়েছি- এখন আর জাগতিক কোনো অপ্রাপ্তী কিংবা হতাশায় কোনো দুঃখ অনুভূত হয় না। শুধু বার বার আমার মরমে স্মরিত হয়, আব্বা আর এই পথিবীতে নেই। শুধু আব্বা যে কক্ষে ঘুমাতেন দেয়ালে টানানো আছে বহুদিন আগের তাঁর একটা ছবি। ছবি দেখে কী হবে?

আব্বা যে চলে গেছেন আজ ষোলো দিন হলো। শুধু ষোলো দিন নয়, ষোলো বছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, যখন আমিও বাবা হব, তখন কি আব্বার কথা মনে করে এভাবে আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না উৎসারিত হবে? নাকি আমার সন্তানেরা আব্বার কথা ভুলিয়ে দেবে? আমার সন্তানেরা যখন আমাকে আব্বা বলে ডাকবে তখন কি আমার আব্বাকে আমি ভুলে যাব? সন্তানের মাঝে পিতৃত্বের যে বন্ধন সে তো জাগতিক যে কোনো বিষয় থেকেও অনেক বড় কিছু।

 সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শনিবার রাতটি আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য মনে রাখবে। এই দিনে আমার আব্বা পৃথিবীকে চির দিনের জন্য চলে গেছেন।

এর আগে ১৪ সেপ্টম্বর শুক্রবার সকালে আব্বা দড়িভাষানিয়া গ্রামে আমার ছোটমামার ছেলের সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। দড়িভাষানিয়া গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি (সি.এন.জি) থেকে নামতে গিয়ে পড়েছিলেন দুর্ঘটনায়। রাস্তা পার হতে গিয়ে উল্টো পথে একসঙ্গে তিনটে মাইক্রোবাস তেড়ে এসে প্রথমটি আব্বাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়, পরেরটি পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। দ্ইু পা-ই ভেঙ্গে গিয়েছিল আব্বার। মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন, সবচেয়ে বেশি জখম হয়েছিল বুকের হাঁড়ে। বাম পাঁজরের চারটি হাঁড়ই ভেঙ্গে গিয়েছিল। আব্বার মৃত্যু হয়েছিল মূলত এই পাঁজরগুলো ভাঙ্গার কারণেই। পুরো গ্রাম থমকে গিয়েছিল। জানাজায় আমাদের মাদরাসা মাঠ ছিল লোকজনে পরিপূর্ণ। আব্বাকে বহন করা খাট নিয়ে আমিও আমার বাকি দুই ভাই চলেছি কবরস্থানের দিকে, এই দুঃখ আর বেদনার ভাষা আমি কী করে লেখব!

আব্বাকে কবরে সমাহিত করার পর আমার বুকের ভেতর কান্না থেমে গিয়েছিল। আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। কে যেন আমাকে ধরে ধরে সদ্য সমাহিত হওয়া আমার আব্বার কাছ থেকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে আমি ভাবছিলাম, আজ থেকে আমি এতিম। আপনি যদি এ লেখাটি পড়ে থাকেন আর আপনার পিতা যদি আগেই মারা গিয়ে থাকে, তাহলে আপনার কাছে বলা বাহুল্য এ দুঃখের, এই কান্নার সীমা-পরিসীমা কতটুকু হয়! কেউ কেউ আমাকে বলছিল, ‘তুমি বাপের শিক্ষিত ছেলে, তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না।’

কেউ বলছিল, ‘দেখো তুমি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো, পরিবারের কেউ আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। তোমার বড়বোন জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তোমার বড়ভাই জহিরুল অজ্ঞান হয়ে আছে। কলসি কলসি পানি ঢেলেও হুশ আসছে না।’

কেউ বা এসে খবর দেয়, ‘এই মাত্র তোমার ছাত্তার কাকাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।’

আবার কেউ এসে বলে, ‘তোমার এভাবে কান্না বন্ধ করতে হবে। তোমাকে শক্ত হতে হবে।  মনে রেখো, কারো বাবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না। তোমাকে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে।’

আল্লাহর ওপর ভরসা করেই তো আমি বেঁচে আছি। তা না হলে মরে যেতাম, সত্যি মরে যেতাম। হ্যাঁ, কারো বাবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না, সেটা আমি জানি। হয়তো একদিন আমিও থাকব না, এটা বুঝি। আমি যখন বাবা হব (যদি বেঁচে থাকি) তখন আমার সন্তান কি আমার কাছ থেকে এমন কিছুু পাবে যা তাদের গর্ব করার মতো? আমি যখন মরে যাব অন্তত আমার আব্বার মতো লোকমুখে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সনদ রেখে যেত পারব তো? আমার আব্বা তো অঢেল ধন-সম্পত্তি রেখে যায় নি। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, আর যাই হোক কারো কাছে হাত পাততে তো হচ্ছে না। আমার আব্বা তো শুধু কৃষি কাজ করতেন। গ্রামের অতিসাধারণ একজন কৃষক হয়ে তিনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, আমাদের তিন ভাইয়ের জীবন যাপনে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া আব্বা আমাদের কী দিয়ে গেলেন, কী দিয়ে গেলেন নাÑ সেই হিসাব-নিকাশে আমি যেতে চাই না। ‘সৎ ও ন্যায়ের পথে চললে কেউ ঠকাইতে পারবে নাÑ!’ আব্বার মুখে জীবনে বহুবার শোনা এই কথাটিই এখন আমার একমাত্র চলার পথের রথ।

কেউ যখন এসে আমাকে কান্না না করতে বলে, ভেঙ্গে না পড়তে বলে, বলে শক্ত হতেÑ আমি তাদের একটি কথাই বলব। তোমার বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই, তুমি আর তোমার বাবার কথা কিংবা হাসির শব্দ শুনতে পাবে না। এমনকি তোমার বাবাকে আর কখনও তুমি দেখতে পাবে না। একবার ভাবো তো, তোমার কেমন লাগবে? বাবাবিহীন বেঁচে থেকে দিন যাপন করতে একজন সন্তানের কী যে কষ্ট হয়, তাদের আমি কেমন করে বোঝাব! কেউ কি সেটা বুঝবে?



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট