সময়ের আলোর ছায়ায় রাত্রির যাত্রী
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
তখন রাত। তারা ভরা আকাশ। চাঁদের রূপ। অন্ধকার পৃথিবী। নিস্তব্ধ প্রকৃতি। সব যেন এলোমেলো। আলোর মাঝে যেন নির্ঘুম অন্ধকার।
মনটা ভালো নেই রাত্রির।
কেন ভালো নেই সে জানে না। কিন্তু বুঝতে পারে কিছু একটা তার সাথে ঘটবে বা ঘটেছে।
ঘটবে মানে ভবিষ্যত আর ঘেেছ মানে অতীত। কে জানে তার সাথে কোনটা হয়েছে। বাইরের বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যায়। হু হু করে অদৃশ্য কিছু একটা ঢুকে পরে। রাত্রির সারা শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠে। এর সাথে মনও।
অদৃশ্য ছায়াটা রাত্রির চারপাশে ঘুরতে থাকে, ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরতে চায় কিন্তু পারে না। রাত্রি বিষয়টা বুঝতে পারে কিন্তু মাথায় ঢুকেনা। কে যেন বাইরে থেকে নিচু স্বরে বলতে থাকে হায়রে ছায়া তোর কপালটাই খারাপ।
আর, মৌমাছিরা ফুলের চারপাশ ঘুরতে ঘুরতে একসময় ফুলের ভিতর ঢুকে মধু টেনে নেয়। ফুল হয় কলংকিত আর মৌমাছিরা আনন্দে নেচে উঠে। কিন্তু কেউ জানেনা এটা কি দুর্ঘটনা নাকি নিজের জীবনকে হারিয়ে ফেলা।
রাত্রির অদৃশ্য ছায়াটাকে চেনা চেনা মনে হয় কিন্তু অচেনায় থেকে যায়। রাত্রির এই অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি আজকের না। অনেকদিনের। এটা কি তবে প্রেম। মানুষের সাথে প্রেম হয় কিন্তু অদৃশ্য ছায়ার কি প্রেমে পড়া যায়। ছায়ার সাথে প্রেম তাও আবার চোখে দেখা মেলে না এমন ছায়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ে রাত্রি। ইতিহাসের পাতার পর পাতা ঘাটে। নিজেকে মনে হয় ইতিহাসের একটা সময়ের ঘড়িতে আটকানো চরিত্র। কিন্তু সেই ইতিহাস তো রাত্রির জানা নেই। ইতিহাসের পাতায় পাতায় নিজের মুখটা দেখতে পায় রাত্রি। মুখোশও দেখে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না।
রাত্রির সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী আলো আর বন্ধু ধ্রুব। ধ্রুবকে সবাই ধ্রুব তারা বলেই ডাকে।
কিন্তু বন্ধুত্বের বাইরে এই তিনজনের কোথায় যেন একটা অদৃশ্য সুতোর টানাপোড়েন আছে। সেটা হয়তো সবাই বুঝে আবার হয়তো বুঝতে পারে না।
রাত্রির অদৃশ্য ছায়াটার প্রতি মনের টান বাড়ে। প্রাণ ব্যাকুল হয়। কিন্তু কোনো পথে খুঁজে পায় না।
এর সাথে ইদানিং আরেকটা বিষয় ঘটছে রাত্রির সাথে। গত মাসে রাত্রি একটা চিত্র প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলো। ওখানে একটা তরুণ ছেলের সাথে তার দেখা। কত বয়স হবে। উনিশ-বিশের মতো। নামটাও খুব সুন্দর। সময়।
সময় যেন সময়ের মতোই চঞ্চল। সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম মানতে সে নারাজ। রাত্রির চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মতো ছোট হবে হয়তো।
প্রতিদিন সময় টাইম ধরে ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে রাত্রিকে ফোন দিবে। শুভ সকাল। বলার পর এটা ওটা নানা কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পর একটা কথা সময় বলবেই। এই লাভ ইউ। রাত্রি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিবে।
রাত্রি সময়কে নিয়েও ভাবে। বাচ্চা পোলাপান মনে হয়। কিন্তু এতো গুছিয়ে, এতটা আবেগ দিয়ে কথা বলে যে রাত্রির মুখ থেকে কথা বের হতে চায় না। লজ্জায় গালগুলো লাল হয়ে যায়। কে জানে ছায়াটার মতো সময়ের প্রেমে হয়তো ডুব দিয়েছে রাত্রি।
খুব অস্থির লাগে রাত্রির। না পারে সইতে না পারে কইতে। মাঝে মাঝে গোলক ধাঁধায় পরে যায়।
ধ্রুব রাত্রিকে কি বলবে বলবে বলছিলো অনেকদিন ধরে। কিন্তু বলতে পারছিলো না। আলোও রাত্রিকে নিরিবিলি কি একটা গোপন কথা বলবে বলে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলো। কি বলতে চায় তারা। রাত্রি জানে না। কিন্তু কি যেন একটা অজানা আতংক ভর করে রাত্রির উপর।
রাত্রি এবার সিদ্ধান্ত নেয়। ধ্রুব আর আলোর সাথে বিষয়গুলো শেয়ার করবে।
রাত্রিদের পাশের বাড়িতে এক মহিলা ডাক্তার থাকেন। মানুষের মনের নাকি চিকিৎসা করেন। রাত্রি অনেকবার ভেবেছে তার কাছে যাবে। কিন্তু ভয়ও পেয়েছে মানুষ যদি ভাবে সে পাগলী হয়ে গেছে। মানুষগুলোও আমাদের যেন কেমন সেই পুরোনো আমলের। শরীরের চিকিৎসার চেয়ে যে মনের চিকিৎসাটা বেশি দরকার এটা তারা বুঝেন না। হয়তো বুঝেও অবুঝ। মনের চিকিৎসা মানে যে পাগলের চিকিৎসা না এটা তাদের কে বোঝাবে। তারপরও দিন তো পাল্টাচ্ছে।
রাত্রি লোকজন এড়িয়ে মহিলা ডাক্তারের বাড়িতে যায়। মনোবিজ্ঞানী ক্যাথরিন। অনেক বছর আগে তিনি ইতালি ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন। মানুষের মনটা উনি খুব ভালো বুঝেন।
রাত্রি ভিতরে ঢুকে। ছিমছাম বাড়ি। অদ্ভুত নীরবতা।
রাত্রি ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যাথরিনের পিছনের সাদা চুল ঝুলানো মাথাটা দেখতে পায়।
পিছন থেকে ক্যাথরিন বলে, রাত্রি আমার সামনের চেয়ারটাতে বসো। ছায়াটাও তো দেখছি তোমার সাথে।
রাত্রি অবাক হয়। এটা কি বাস্তব নাকি স্বপ্ন। সত্য নাকি মায়াবী জাদু। কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে তার ভিতরের সত্তা আরেকজন খুঁজে পেয়েছে হয়তো।
শরীরটা এলিয়ে দিয়ে রাত্রি চেয়ারটাতে বসে। ঘুম ঘুম চোখ। বিস্মিত মুখ।
রাত্রি চোখকে খোলা রাখার যুদ্ধ করে। মুখটাকে স্বাভাবিক অবস্থার ভিতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
হ্যালো ম্যাম। গুড মর্নিং।
ক্যাথরিন বলে, এখন তো রাত। গুড নাইট বলো।
রাত্রি অবাক হয় সে কি রাত দিন কি এটা ভুলে গেছে? রাত্রি বলে, আমার অনেক....।
থামিয়ে দিয়ে ক্যাথরিন বলে, সমস্যা!
ঠিক বলেছেন।
ক্যাথরিন বলে, আমি তো তোমার সমস্যা দেখছি না। বরং তুমি সমস্যা অন্যদের জন্য সমস্যা হয়ে গেছো
অবাক হয় রাত্রি। আমার সমস্যা নেই। আমি অন্যের জন্য সমস্যা হয়েছি। কি বলছেন?
ক্যাথরিন বলে, অনেকদিন ধরে তোমার কারণে কয়েকজন আমার চিকিৎসায় আছে। আমার জন্য, রাত্রি একটু ক্ষোভ নিয়ে বলে। আমি তো এসেছি আমার সমস্যার জন্য। আর আপনি বলছেন ঠিক তার উল্টো।
রাত্রি তোমার অতীত আছে আর ভবিষ্যত আছে। কিন্তু বর্তমান নেই।
ক্যাথরিন বলে, তোমার স্বামীর কথা কি মনে আছে?
তোমার স্বামী ছায়া। রাত্রি আবার অবাক হয় আমার স্বামী ছায়া। আমি তো বিয়েই করিনি।
করোনি মানে? এটা কে?
আমার ছেলে জিসান।
ক্যাথরিন জিজ্ঞেস করে নিজের ছেলে।
আমার নিজের ছেলে।
কিন্তু তুমি যে বলছো বিয়ে করোনি।
না করিনি।
এখনো বলছো করোনি।
না করিনি।
তাহলে তুমি জিসানকে নিজের ছেলে বলছো।
রাত্রি ভাবে আর ভাবে। কি আছে তার মনে যা সে জানে কিন্তু বলতে চায় না।
ক্যাথরিন বলে, জিসান তার বাবার সাথে আজ আমেরিকা চলে যাচ্ছে। আর কখনো ফিরে আসবে না।
রাত্রি কেঁদে উঠে, না এমনটা আমি চাই না। আমি বলছি তো আমি ওর মা।
ক্যাথরিন এবার বলে মা নাকি জিসানের মায়ের হত্যাকারী।
রাত্রি এবার চমকে উঠে।
রাত্রি আর যাত্রী দুই যমজ বোন। অবিকল দেখতে একই রকম। খুব গভীর সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে।
রাত্রি ভালোবাসতো ধ্রুবকে কিন্তু ধ্রুব ভালোবাসতো আলোকে।
যাত্রীর বিয়ে হয় ছায়ার সাথে। খুব সুখের সংসার। কিন্তু সে সংসারের উপর রাত্রির চোখ পরে। যাত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। বোনের সেবাযতœ করবে বলে ছায়ার বাড়িতে জায়গা নেয়। দুইবোনকে নিয়ে ছায়ার মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি হতো। কেন হবে না সব কিছুই যে এক।
যাত্রীর কাল সন্তান হবে। চোখে মুখে আনন্দ আর আনন্দ। যেন পৃথিবীর সব কিছু কাল পেয়ে যাবে যাত্রী।
রাত্রির কেমন যেন হিংসে হয়। রাগ চোখ, মুখ আর কান থেকে গরম বাস্প যেন বের হতে থাকে।
বাইরে কান্নার শব্দ। ছায়া আর যাত্রীর সন্তানের চিৎকার করে পৃথিবীতে আসার কান্না।
রাত্রি ফোন করে ছায়াকে জানায় সে আর দেশে থাকবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে বের হয়ে আসে যাত্রী। কোলে সন্তান।
ছায়া আবেগে আপ্লুত হয়। চাঁদের হাসির বাঁধ যেন ভেঙে যায়। কিন্তু কোথায় যেন ফাঁক, অপূর্ণতা। ছায়া বুঝতে গিয়েও বুঝতে পারে না।
রাত্রি তো চলে গেছে। কিন্তু রাত্রি নামের একজন ধ্রুব ও আলোর সাথে ক্যাম্পাসের খোলা দিকটায় আড্ডায় বসেছে। তবে কি যাত্রী রাত্রির অভিনয় করে যাচ্ছে। কে জানে কেইবা বলতে পারে। সব কিছু ভাসা ভাসা নদীর জলে পদ্মের মতো।
রাত্রি না যাত্রী কে জানে কেইবা বলতে পারে। সব যেন রহস্য। ধ্রুব আর আলোকে জিজ্ঞেস করে, কি বলবি বল।
না মানে....একটু লজ্জা, একটু বিব্রত, একটু অপ্রস্তুত হয়ে ধ্রুব বলে, আমি আর আলো বিয়ে করেছি।
সময় যেন থমকে যায়। দমবন্ধ হয়ে আসে রাত্রি কিংবা যাত্রীর।
ধ্রুব কথাটা বলে উঠে পরে।
এরপর কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে।
ধ্রুব একদিন পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে এসে বলে, আমার আলোকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।
কোথায় আলো আজ সব যেন অন্ধকার?
সময় একদিন ছায়ার বাড়িতে আসে। রাত্রিকে খুঁজে।
ছায়া বলে রাত্রি তো নেই। ওর বোন যাত্রী আছে।
সময় বলে তাহলে যাত্রীকে আপাকে ডাকুন। যাত্রী আসে। যাত্রী তো? সময়ের ফোন কথা বলা রাত্রি নাকি যাত্রী। কে জানে।
সময় বলে, যাত্রী ম্যামের সাথে আমার ফোন কথাবার্তা হতো। উনার জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল। যাত্রী জিজ্ঞেস করে কি?
উনার আমি বিয়ে ঠিক করেছি।
আমার চাচুর সাথে।
যাত্রী চমকে উঠে। যাত্রী তো? ঠিক বোঝা কঠিন।
সময় বলে আমি তো আগে থেকেই একটা মেয়ের সাথে এনগেজ। আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। অপেক্ষা করছি। সময়ের আর স্বপ্নের। কিন্তু আমি আর মেয়েটা রাত্রি আপাকে নিয়ে খুব ফান করেছি। প্রতিদিন আমি রাত্রি ম্যামকে বলতাম, আই লাভ ইউ। মেয়েটাকে মোবাইলে রেকর্ড করে কথাগুলো শুনাতাম।
এখন রাত্রি ম্যামের জন্য কষ্ট হচ্ছে। উনি মনে হয় আমাকে ভালোবেসেই ফেলেছে।
কষ্ট হলো তো। সেজন্য চাচুকে সব কথা বলতে উনি বিয়েতে রাজি।
ছায়া বললো রাত্রি তো চলে গেছে।
দিন গড়ায়।
একদিন সময়ের খোঁজে সময়ের মা-বাবা ছায়াদের বাসায় আসে।
খুঁজে পাচ্ছে না তাকে।
সবাই কি তবে হারিয়ে যাবে কিংবা যাচ্ছে।
ক্যাথরিন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নার ভিতরে রাত্রিকে দেখতে পায়। খুব কুৎসিত একটা মুখ। মুখোশটা খসে পরে।
একটা প্রতিহিংসা পরায়ণ মুখ মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসে।
রাত্রি নিজের বোনকে খুন করে এখন যাত্রী।
রাত্রি নিজের বান্ধবী আলোকে খুন করে ধ্রুবকে পেতে চায়।
রাত্রি সময়কেও ভালোবেসেছিলো কিন্তু সময় তাকে নিয়ে খেলেছে।
এরপর সময়কে হত্যা।
রাত্রি এখন খুনি। কেউ জানে না।
ক্যাথরিন রাত্রির বিবেক।
রাত্রির বিবেক এসে থমকে দাঁড়ায়।
রাত্রি ভাবতে থাকে কি করবে সে।
রাত্রি এখনো ভাবছে।
কিন্তু সে কি রাত্রি না যাত্রী কেউ জানে না। এখন সে প্রকৃতির বিচারের অপেক্ষায় আছে।
তবে আরেকটা রহস্য এখনো অজানা। সেটা হলো বিয়ের রাতে যাত্রী নাকি পালিয়েছিলো।
আর রাত্রির সাথে ছায়ার বিয়ে হয়েছিল।
তবে এখনও পুরো বিষয়টা বুঝে উঠা কঠিন। অপেক্ষা সময়ের, মুখ আর মুখোশের।