কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়!
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
ক’দিন হলো মেয়েটা খুব বায়না ধরেছে- ঘুরতে যাবে। মায়ের হাতে টাকা পয়সা নেই; তাই মা মিতুকে কোথাও নিয়ে যেতে পারেন না। মায়ের প্রতি মিতুর অভিযোগের কোনো শেষ নেই। মিতুর কাছে তার মা পৃথিবীর সবচেয়ে পচা। কিছুই কিনে দেয় না; কোথাও নিয়েও যায় না। ক্লাসের বন্ধুরা কত জায়গায় বেড়াতে যায়। পিকনিক করে। কিন্তু মিতুর শুধু বাসা আর স্কুল-এর বাইরে কোথাও সে যায় না। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকতে তার একটুও ভালো লাগে না।
মিতু খুবই লক্ষ্মী মেয়ে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায়ও খুব ভালো। সে বাসায় একাকি পড়তে বসে, নিজে নিজে লেখে-সব হোমওয়ার্ক করে ফেলে। ছবি আঁকে। তবে শহরের ছবি। বিভিন্নপার্ক, শপিংমল, রাস্তার জ্যাম- তার ছবির বিষয় বস্তু। গ্রাম সে কখনো দেখেনি। তাই তার রংতুলিতে গ্রাম আসে না। বাবার খুব ছোট্ট চাকরি। মাসের বেশিরভাগ সময়ে অন্য শহরে কাজের জন্য থাকতে হয়। তাই সে বাবার দেখা পায়না বললেই চলে। মায়ের কাছেই মিতুর যত আবদার। কখনো কখনো মা বিরক্ত হন। খুব করে বকা দেন। মিতুর যে তখন কি মন খারাপ হয়! না দেখে শুধু লিখে বোঝানো যাবে না।
আজ মিতু মায়ের সাথে যমুনা ফিউচার পার্কে শপিং করতে গিয়েছে। এটাকে ঠিক শপিং বলা যাবে না। তারা বেড়াতে গিয়েছে। এত বড় মার্কেট সে আগে কখনো দেখেনি। আর দেখবেই বা কী করে ? এর আগে যে সে কখনো মার্কেটেই আসেনি। সে মায়ের সাথে দোকানগুলো ঘুরে কত কিছু দেখছে! মা তাকে একটি পুতলের দোকানে নিয়ে গেলেন। কী সুন্দর! এক একটা পুতুল। মিতুর ইচ্ছে হল সবগুলো কিনে নেবে। কিন্তু মা বললেন, একটা পছন্দ কর, তোমাকে কিনে দেব। পুতুল দেখতে দেখতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে বলে উঠল, মা দেখো, দেখো ঐ যে সাকিব, সাকিব আল হাসান। মা বিস্ময়ে সামনে তাকালেন।
নাহ, তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। মার্কেট লোকে লোকারণ্য। একজনের সাথে আরেক জনের ঠেলাঠেলি লাগে; সাবধানে চলতে হয়। তাই মেয়ের কথায় তিনি কান দিলেন না। তবে মিতুর উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই! ‘জানো মা, ক্লাসের মিস বলেছেন, সাকিব মস্ত বড় খেলোয়াড়। সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁর নাম। তাঁর মতো খেলোয়াড় বিশ্বে খুবই কম। বড় হয়ে আমি সাকিবের মতো নামকরা, বিশ্বখ্যাত হতে চাই।’ মা রাগ করতে গিয়েও কেন যেন থেমে গেলেন।
মেয়ে একদিন বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন দেখে ভেবে নিজের মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধ অনুভূত হতে লাগল। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না। মেয়ের কত রকম বায়না। তাদের ছোট্ট সংসার। স্বামী শহরের বাইরে থাকে। মানুষটা সারাদিন খেটেখুটে যা রোজগার করে তাই দিয়ে কোনো রকম দিন চলে। বাড়তি কোনো সঞ্চয় নেই। বিপদে-আপদে অন্যের কাছে হাতপাতা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় থাকে না। এখন কেউ কাউকে আর সাহায্য করেনা, বিপদে দেখে না। মেয়েটাকে নিয়ে তাই মায়ের খুব স্বপ্ন; একদিন সে অনেক বড় হবে। সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশের মানুষ তাকে মাথায় করে রাখবে।
হঠাৎ মেয়ের চিৎকারে মায়ের সংবিৎ ফেরে। মিতু চিৎকার করে বলছে, মা, মা... সামনে, সামনে তাকাও। মা বিস্ময়ে সামনে তাকালেন। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সামনে খুব ভীড়। সবাই কাকে যেন ঘিরে রেখেছে। উৎসুক জনতা। কেউ দামি ফোন বের করে ফটো তুলছে। কেউ বই, খাতা-কলম এমনকি হাত পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা সিগনেসার প্লিজ..। মা এই ভীড়ের মাঝখানে খুব শান্ত চেহারার মৃদু হাসিমাখা একটা মুখ দেখতে পেলেন। তার চোখ যেন আটকে গেলে। ক্রমেই ভীড় বাড়ছে। ‘সত্যি তো এ যে সাকিব আল হাসান!’
মা যেন নড়তে পারছেন না, কে যেন তাকে আটকে রেখেছে। নিজেকে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখের সামনে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। মায়ের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েকে নিয়ে আরও কাছাকাছি যেতে। একটু কথা বলতে। কিন্তু ভীড়ের কারণে সেটা সম্ভব নয়। সবাই যে এখন এই প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করছে। সেখানে মিতুকে কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া বিপদজনক। ভীড়ের মধ্যে যদি জটলা লাগে। দুর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে আসেনা।
মিতু মায়ের সাথে বাসায় ফিরেছে। আজ সাকিবকে দেখতে পেয়ে তার খুব ভালো লেগেছে। মা তাকে একটি পুতুল, বেশ কিছু খেলনা, দুইটি গল্পের বই আর একটি ফটো কিনে দিয়েছেন। ফটোটি অবশ্য মিতু জোর করেই কিনে নিয়েছে। মা প্রথমে না বলে দিয়েছিল। কিন্তু মিতুর মন খারাপ হবে ভেবে, কী বুঝে মা শেষে কিনে দিলে। মিতু সেদিন রাতে বার বার ফটোটি দেখছিল। ফটোটির নিচে ক্যাপসন লেখা,‘ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।’
স্কুলে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করার জন্য প্রতি বছর মেধা উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কোনো না কোনো ইভেন্টে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। মিতু আবৃতি, গান আর ড্রইং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। আজ সমাপনী দিনে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হবে। পুরো স্কুল খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সবাই খুব উৎসুক। আগে থেকেই প্রচার করা হয়েছে আজ বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরষ্কার তুলে দিবেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তাই পুরো ক্যাম্পাস যেন কানায় কানায় পূর্ণ। তবে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। এক শিক্ষার্থী এক অভিভাবক ধরে দাওয়াত কার্ড দেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে।
মিতুর কাছে একটা কার্ড। বাবা অথবা মা যেকোনো একজন প্রবেশ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে বাবাকে একটু ছাড় দিতে হলো। মিতুকে নিয়ে মা ভেতরে প্রবেশ করলেন। আর যারা প্রবেশ করতে পারলেন না গেটের বাইরে তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল। সে কথা না হয় অন্য দিন বলবো।
চারদিকে উৎসবের আমেজ। সাকিব আল হাসানকে কাছ থেকে দেখা আজ সবার কাছে বাড়তি পাওয়া। আর এই সেলিব্রেটির হাত থেকে পুরষ্কার নিতে পারলে তো কথাই নেই। সারা জীবন তা স্মৃতি হয়ে থাকবে। পুরষ্কার বিতরণী শুরু হয়ে গেছে। খেলাধুলা, গল্পলেখা, আবৃত্তি, নাচ, গান এবং ড্রইং এ বিজয়ী প্রতিযোগিদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। মঞ্চ থেকে সামনে পুরো মাঠ শুধু মানুষ আর মানুষ। বিজয়ী শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের উল্লাস চোখে পড়ার মতো।
এক এক করে ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠে বিজয়ীরা সাকিব আল হাসানের হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করছে। সবার কী যে আনন্দ! কিন্তু মিতুর মায়ের মুখ শুকিয়ে গেছে। এখনো কোনো পর্বে মেয়ের নাম ঘোষণা করা হলো না। তবে কী মিতু ঠিক মত পারফর্ম করতে পারেনি। কত কষ্ট করেই না মিতুকে সে তৈরি করেছে। তার বিশ্বাস কোনো না কোনো প্রতিযোগিতায় মিতু ভালো করবেই। আশায় বুক বাধে। আজ মনে হচ্ছে, এই প্রতিযোগিতা শুধু মেয়ের একার নয়। তার নিজেরও। ড্রইং এর ফলাফল তখনো ঘোষণা হয়নি।
হঠাৎ মাইকের শব্দে মায়ের সতর্কতা বাড়ল। ‘এখন ইন্টার স্কুল ড্রইং কম্পিটিশনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তার আগে একটি ঘোষণা দিতে চাই। আমাদের বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহোদয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী ড্রইংয়ে প্রথম পুরষ্কার প্রাপ্ত পেইন্টিংটি উপহার হিসেবে তুলে দেওয়া হবে সাকিব আল হাসানের হাতে। আর বিজয়ী শিক্ষার্থী পুরষ্কারসহ সাকিব আল হাসানের সাথে আজ ডিনার করার সুযোগ পাবে।’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি আর উল্লাসে যেন সবাই ফেটে পড়ল। হাত তালির শব্দ থেমে গেলে উপস্থাপক রুনা ম্যাডাম ঘোষণা দিলেন :
‘সাকিব আল হাসানের ছবি এঁকে এ বছর স্কুল ড্রইং কম্পিটিশনে প্রথম হওয়া সৌভাগ্যবান বিজয়ী ইসরাতুল জান্নাত মিতুসী ওরফে মিতু। মিতুকে মঞ্চে আসার আহবান জানাই।’ মা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মিতু ড্রইংয়ে প্রথম হয়েছে! মায়ের চোখ দিয়ে তখন ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। তবে এ জল আনন্দের। এ কান্না তৃপ্তির। এ উচ্ছ্বাস বিজয়ের!!