চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে
মুহাম্মাদ এমদাদুল্লাহ
ভোরের মৃদু বাতাস বইছে। ঝলমলে সূর্যের সোনালি কিরণ বাতাসের সঙ্গী। সুনসান নীরবতায় দু’পাশের সবুজ মেখে ছুটছে আমাদের গাড়ি।
পিচঢালা রাস্তা দু’ধারে কড়ই গাছের ছাউনি ঢাকা পরিবেশ। হালকা কুয়াশায় মোড়ানো স্বচ্ছ-নির্মল প্রকৃতি। মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক গলে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। যেন গাছের আবডালে লুকোচুরি খেলছে সূর্যশিশু।
গাড়িতে সবাই নীরব। আচ্ছন্নতায় ডুবে আছে সবাই। মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবুজ মায়াঘেরা প্রকৃতি। বাইরে মনলোভা প্রকৃতির হাতছানি ভরে দেয় মন ও মনন। মৃদুমন্দ বাতাসে তাই হারিয়ে যাই ক্ষণিকের জন্য। নিজেকে আবিস্কার করি পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষগুলোর মাঝে। এই সুখ ও সুখের আবহে হয়তো কাটিয়ে দেয়া যাবে কয়েক জনমও। এ যে পরম প্রশান্তির ছোঁয়া!
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গাড়িতে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা। গুলজার মোড় থেকে আমাদের গাড়ি ছেড়েছে। গাড়ি ছাড়ার পর প্রথম কিছু সময় ছিলো সম্পূূর্ণ শান্ত নীরব। কিন্তু কিছুদূর যেতেই শুরু হলো হৈ-হুল্লোড়। পর্যায়ক্রমে সেটা মাত্রা ছাড়ানোর উপক্রম। শেষে হলোও তাই। বিশ্রী একটা অবস্থার সৃষ্টি। কারো দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বিষয়টা অনেককেই বিষিয়ে তোলে। সহ্যই হচ্ছিল না একদম।
পাশে ছিলেন তারিক ভাই। তাকে বললাম, এই পরিবেশের সাথে এসব যায় না। কারণ এখানে প্রিন্সিপাল ম্যামসহ অনেক ডাক্তারগণ রয়েছেন। এসব না করলে...
আরো কিছু বলতে যাচ্ছি, পেছনে বসা এক ভদ্রলোক আমার কথায় চটে গেলেন। বললেন- ‘ভ-তে ভ্রমণ আর ম-তে মাস্তি। সুতরাং ভ্রমণে এগুলো হবেই।’
রাগ সত্ত্বেও হেসে দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। বললাম- দেখেন, এইসবের একটা লিমিট থাকা দরকার। আপনাদের অবস্থায় তো মনে হচ্ছে এটা একটা পাগলাগারদ। সিনিয়র-জুনিয়রের মাঝে একটা রেসপেক্টের ব্যাপার আছে। সেটা তো মনে হয় গুলিয়ে খেয়ে এসেছেন!
ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়লো। আমার কথা উপরে যুক্তি বসাতে চাইলেও পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। অযথা ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার! যা বলেছি, বিবেকবান হলে তাই কাফি।
কিছুদূর যেতেই ভদ্রলোকের যেন বোধোদয় হলো। মাইকের গ্যাঁ গ্যাঁ কতোক্ষণ আর ভালো লাগে! তার কাছেও হৈচৈটা এখন বাজে ঠেকছে মনে হয়। পরে ঠিকই অন্যদের লাফালাফিতে তিক্ত হয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ভদ্রলোক। কথায় আছে না, অতিভোজনে পেট নষ্ট! তার ক্ষিপ্ততায় বেশ মজা নিচ্ছিলাম আমরা দু’জন। ভদ্রলোক আমাদের মজা নিতে দেখে রাগে যেন ফায়ার করবে। চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। সেখান থেকে ঠিঁকরে পড়ছিলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
তারিক ভাই আর আমি একই কলেজের ছাত্র। হাসিমাখা শান্ত স্বভাবের মানুষ। মনটা যেমন সরল তেমনি আন্তরিক। তাঁর সুবাদে অচেনা জায়গাগুলো চেনা আসান হয়েছে আমার। কারণ এসব এলাকা তার খুব ভালো মতো আয়ত্বে আছে।
কর্ণফুলীর পাশঘেঁষে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। তারিক ভাই ইশারা করে করে চিনিয়ে দিচ্ছেন অনেককিছু । বিভিন্ন তথ্য-উপাত্বও জুড়ে দিচ্ছেন ফাঁকে ফাঁকে। কর্ণফুলী নদী, বড় বড় জুতো তৈরির কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, তেলের গোডাউন ইত্যাদি দেখালেন। তেলের গোডাউনের একটা তথ্যে তো আমি অবাক! এখানকার একেকটা গোডাউন এতো বড় আর রিস্কি যে, কোন একটাতে যদি দুর্ঘটনাবশত আগুন ধরে তাহলে কয়েক কিলোমিটার এলাকা সম্পূূর্ণ ভষ্ম হয়ে যাবে।
দেখতে দেখতে বাঁ পাশের জলরেখা হারিয়ে সবুজ গালিচা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আরো কিছুদূর যেতেই গাছ-গাছালী ভরা সবুজ গ্রামের হাতছানি। পথের দু’ধারে মাইলের পর মাইল বৃক্ষসারী। কোথাও কোথাও ঝোঁপ-ঝাঁড়। সামনে যেতেই নদী কূলঘেঁষা আঁকাবাঁকা পথ এসে পুনরায় ধরা দিলো। নদীর ওপার দেখতে পেলাম। যার শেষ প্রান্ত একেবারে দিগন্তরেখা ছুঁইছুঁই। পাশেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি তালগাছ। যেন স্বাগত জানাতে এসেছে আমাদেরকে।
মোবাইল হাতে নিয়ে উইকিপিডিয়া ওপেন করলাম। ম্যাপে দেখছিলাম অবস্থান। আনোয়ারা এলাকায় লালরেখা চিহ্নিত স্থানকে জুম করি। পুরো এলাকা একনজরে চলে আসে। উত্তরে পটিয়া, দক্ষিণে বাঁশখালী, পূর্বে চন্দনাঈশ এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর। বন্দরের সাথেই বঙ্গোপসাগর। আনোয়ারার দেয়াং পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী বনভূমি বেশ বিখ্যাত। কাফকো পাহাড়, কেপিজেট এবং পারকীচর সী বিচও আনোয়ারার দর্শনীয় স্থান।
আনোয়ারা থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৬ সালে। উপকূলীয় এই থানার নামকরণের ইতিহাস সর্বজনবিদিত নয়। জনশ্রুতি আছে আনারা নামে এক মগ রাজা এই থানার কর্তা ছিলেন। পরে কালের আবর্তে উচ্চারণ পরিবর্তনে তা আনোয়ারায় পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে আনোয়ারা থানা উপজেলায় উন্নীত হয়।
কর্ণফুলীর উতলা ঢেউয়ে দোল খেলছে জাহাজগুলো। তাকিয়ে আছি আনমনে। কেমন যেনো ইচ্ছে করছিলো নাবিক হতে। কল্পনায় ভেসে ওঠে আমার নাবিক চেহারা। বিশাল জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সম্মুখে ছুটে চলছি মহা আনন্দে। খেলছি সাগরের অথৈজলে সংগ্রামখেলা। ক্ষণিকের জন্য সমুদ্রের আকুলতা অনুরণন সৃষ্টি করে হৃদয়ের গভীরে।
কতো কী মনে মনে কোণে উঁকি দিতে দিতে আমরা চলে আসি আজকের ভ্রমণস্পট ‘বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির’ সামনে। কলেজের সকল শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় ধীরে ধীরে। ভেতরে প্রবেশ করি। হাঁটতে হাঁটতে এসে থেমে যাই একটি সাইনবোর্ডের সামনে। তাতে লেখা ‘গঅজওঘঊ অঈঅউঊগণ ঞজঅওঘওঘএ খঅকঊ’। ভেতরে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে আয়োজন করে রেখেছে কলেজ কর্তপক্ষ।
বেলা তখন এগোরাটা। আজকের আয়োজনের অন্যতম বিষয় ক্রিড়া প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রতিযোগিতা পর্ব শুরু হয় এগারোটায়। বিভিন্ন খেলার ইভেন্ট ঘোষণা হয়। প্রথম ইভেন্ট ‘মুরগী লড়াই’। মঞ্চ থেকে ঘোষণা এলো যে, ছেলেরা মাঠে নামবে। যাদের খেলার ইচ্ছা নেমে পড়লো। দর্শকের সারিতে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হঠাৎ আমার দিকে কেমন করে যেন তাকালেন ডাঃ জলিল স্যার। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি ‘ফাস্ট ইয়ারের’ ছাত্র না?
বললাম- জ্বী স্যার,
তিনি আমার হাতটা ধরে টেনে নামিয়ে দিলেন মাঠে। আমি তো পুরো ‘থ’ হয়ে গেলাম! এই খেলা কখনো খেলিনি। কী করি কী করি... সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই শুরু হয়ে গেলো লড়াই।
আমি পা ধরে দাঁড়িয়ে আছি এককোণে। প্রচুর ভয় করছে। অন্যদের কাঁধে কাঁধে ধাক্কা-ধাক্কি দেখে ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে গেলাম। পাশে একজন উৎসাহ দিলেন- কারো সাথে ফাইট করার দরকার নেই। যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন। মাঠ তখন পুরো গরম। আমাদের ফাস্ট ইয়ারের তোফাজ্জল ভাই সকলের দৃষ্টি কেড়ে করে নিলেন। কারণ তিনি সবার সাথে সুকৌশলে লড়ছেন। একে একে পড়ে যাচ্ছিলো সবাই। আর বাকি মাত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে আমিও আছি। কিন্তু এভাবে সবার থেকে পাশ কাটিয়ে থাকা আর সম্ভব হয়নি। পেছন থেকে ঠেলে ডাঃ ওমর ফারুক স্যার মাঠের মাঝখানে পাঠিয়ে দিলেন। ভয়ে আমার মনের বাতি নিভু নিভু। কী হবে তা ভাবতে ভাবতে পেছন থেকে এসে দিলো ধাক্কা একজন। পায়ে খেলাম এক মোচড়। অসহায়ভাবে পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত প্রথম হলেন তোফাজ্জল ভাই।
ধাপে ধাপে ইভেন্টের আরো খেলার প্রতিযোগিতা চলে। কলেজের শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। মুরগী লড়াই, পরে শুরু হয় যেমন খুশি তেমন সাজো পর্ব, তারপর মিউজিক্যাল চেয়ার। এরপরে একজন চিকিৎসক রোগী নিয়ে শিক্ষণীয় চরিত্রে অভিনয়। এভাবে অনুষ্ঠান বর্ণিল হয়ে ওঠে। শিক্ষকগণ স্টুডেন্টদের অসাধারণ পারফর্ম দেখে যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনই শিক্ষার্থীদেরও আনন্দে আনন্দে ভরে উঠেছে মন।
যোহরের নামাযান্তে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। ভোজনপর্ব শেষে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কেউ অনুষ্ঠানে বসে আছে, আবার কেউ আশপাশের স্পটগুলোতে ঘুরছে। আমাদের ব্যাচের তারিক ভাই, তোফাজ্জল ভাই ও মুনির ভাইসহ আরো অনেকে গল্প জমেছি গাছতলায়। পুরো জায়গাটি কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি। জমে উঠেছে খোশগল্প। আড্ডায় আড্ডায় একসময় গড়িয়ে আসে বিকেল। বিকেলবেলা পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
আছরের নামায শেষ করে মেরিন একাডেমির দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। সারাটি দিন অনুষ্ঠান আর গল্পে কেটে গিয়েছে। তাই কিছুই দেখা হয়নি। আমাদের সঙ্গী ছিলেন আজিজ ভাই। তার সাথে নৌবাহিনীর বড় বড় গবেষণাকেন্দ্রগুলো দেখি। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে বিভিন্ন ফুলের বাগান, ভাষাশহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। প্রভাতী সূর্যের ন্যায় শহীদ মিনারের জড়িয়ে হাসছে কৃত্রিম একটি সূর্যপ্রতীক।
বিশাল একটি বোর্ড ঝোলানো। সেখানে লেখা হয়েছে মেরিন একাডেমি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। এই একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একমাত্র নৌবাহিনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো এটি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো পাকিস্তান নৌবাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পরে মেরিন একাডেমির পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। সন্ধ্যার আগামনী বার্তা কড়া নাড়ে। গাড়িতে এসে একে একে বসে পড়ি আমরা সবাই। সব ক্লান্তি জড়িয়ে দিলাম সিটে। শুরু হয় ছুটন্ত পাখির স্বীয় নীড়ে ফেরা।