ব্রডব্যান্ড
শফিক নহোর
আমার মেয়ে দিন-রাত লেখাপড়া করে। কিন্তু ওর পরীক্ষার ফলাফল এত খারাপ কেন আসছে বুঝতে পারছি না। লুবনা, মানে আমার মেয়ে সে কখনো ফেসবুক ব্যবহার করে না, মোবাইলে ও তেমন কারো সঙ্গে কথা বলে না। সে সবসময় লেখাপড়ায় ভালো এবং মেধাবী ছিলো। কলেজে সবাই ওর প্রংশসা করতো; হঠাৎ করে মেয়েটার যে কী হলো! আমার সঙ্গে তেমন কথা বলতে চায়না । সারাক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকে। কেমন যেনো চুপচাপ। রাতে মাঝে মধ্যে ওর রুমে আলো জ্বলতে দেখে আমি ভাবি সে হয়তো রাত জেগে লেখাপড়া করছে। কিন্তু যখন পরীক্ষার ফলাফল আমার কাছে আসে তখন তা দেখে আমার বিশ্বাস করতে কস্ট হয় যে এটা লুবনার রেজাল্ট শীট। ওর রেজাল্ট শীট দেখে আমার মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন জন্ম নিতে থাকে। আসলে ও কি করে? মাঝে মধ্যে রাত জেগে পড়া ছেড়ে আর কি করতে পারে সে?
লুবনার এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখে আমি ওর বাবার সাথে কথা বলি। লুবনার বাবা ঢাকার বাইরে চাকুরী করে। সব শুনে সে অনেক চেষ্টা করেছে ঢাকায় বদলি হয়ে আসতে। কিন্তু পারেনি। মন্ত্রীদের ফোন ছাড়া আজকাল বদলি ও হয়না । মেয়েটি দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । ডাক্তার দেখানোর কথা বললে খুব রেগে ওঠে। প্রচ- জেদি মেয়েটা আমার । এক মেয়ে হবার কারণে, ওর অনেক কথাই আমরা মেনে নিয়েছি অবলীলায়, সব কিছু করেছি ওর পছন্দ মত। তবুও ইদানীং তার মনের ভিতর হাজার টা অভিমানী বাক্য ।
একদিন আমার পাশের বাসার মাইনুল ভাইয়ের সাথে কিছু ব্যাপার শেয়ার করলাম। লুবনার হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়া রেজাল্ট খারাপ করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। তিনি আমাকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি পরামর্শ এরকম ছিলো আমি যেনো খুব সম্ভব ইন্টারনেট ব্যবহার শিখি। আর এটা যদি শিখতে পারি তাহলে হয়তো লুবনার ব্যপারটা আমি ক্লিয়ার হতে পারবো। মইনুল ভাইয়ের ধারণা লুবনা ইন্টারনেট আসক্ত। তাই আমি তার কাছেই শিখে নিয়েছিলাম ইন্টারনেট অধ্যায়।
ইন্টারনেট শেখার সাথে সাথে আমি খুব লক্ষ্য রাখতাম আমার মেয়ের প্রতি। লুবনা, আমার পড়–য়া মেয়ে সত্যিকার অর্থে রাত জেগে কী করে ?
আমার কম্পিউটার সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা ছিলোনা । বাসায় অনেকদিন আগে থেকেই ছিলো ব্রডব্যান্ড লাইন, ওয়াই-ফাই সবকিছু । আমিও ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারের হিস্টোরি গুলো দেখলাম। ছিঃ! ছিঃ!ছিঃ ! আমি তখন খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম নিজেই নিজের কাছে ।
একদিকে চাকরি অন্যদিকে সংসার সব মিলিয়ে মেয়েকে তেমন সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না আমার। তবুও চেষ্টা করি, সেখানেও ফলাফল শূন্য। বুঝতে পেরেছি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে আমার মেয়ে । লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাত জেগে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওয়েব সাইটে পড়ে থাকে। বিভিন্ন দেশি বিদেশী নগ্ন ছবি দেখার নেশায় সে আসক্ত । একটা দিন সে ইন্টারনেট বিহীন থাকতে পারে না। বিভিন্ন ওয়েব সাইটে নিজে নগ্ন হয়ে আপলোড দিয়েছে নিজের ছবি ও ভিডিও । ‘মা’ হিসাবে ব্যর্থতার সারিতে দাঁড় করালাম নিজেকে। যে করেই হোক এ পথ থেকে ফিরে আনতে হবে মেয়েকে । আমার স্বামীকে ভয়ে কিছুই জানালাম না। শুরু করলাম মেয়ের সঙ্গে বন্ধু হিসাবে মিশতে। কিন্তু সে আমাকে সহজে মেনে নিতে পারছিলো না। অবশেষে আমরা ভাল বন্ধু হলাম।
মেয়ে ওয়াদা করলো আমার কাছে, সে কখনো আর এসব সাইট ব্যবহার করবেনা।
ভালোবাসা ও ভাল পরামর্শ দিয়ে ধীরে ধীরে লুবনাকে আমি অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে এনেছি। অবসর সময়ে আমি আর লুবনা ঘুরতে যাই ,ওর কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমরা দু’জন যাই । আমাদের দেখে সবাই অবাক হয়; ‘মা’ মেয়ে এত ভাল বন্ধু হতে পারে ?
মাঝে মাঝে ঘুমন্ত লুবনার নিস্পাপ মুখখানা বুকের ভেতর নিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বলি আমার লক্ষী মামনি, আমার লুবনা সোনা, যদি সঠিক সময়ে তোমার পরিচর্যা করতাম আরো ভালো দেখাশুনা করতাম তাহলে মামণি তোমার এতবড় সর্বনাশ হতোনা। তবুও থ্যাংকস গড, যে সময় মতো তোমাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
আজকের দিনে মা-মেয়ের বন্ধু হওয়া বেশি প্রয়োজন।
আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে ফেলছি নিজেদেরকে সঠিক পথ থেকে । শুধু টাকার মোহে সংসার এর মোহে সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকা ঠিক নয় । আজ মেয়ের একজন ভাল বন্ধু হয়ে সেটা বুঝতে পারছি । আমার মেয়ে হয়তো এর চেয়ে খারাপ পথে যেতে পারতো । হয়তো মিশে যেতে পারতো জঙ্গি বা আইএস এর সদস্য হিসেবে । ছেলে-মেয়েদের সময় দিয়ে বন্ধু হতে হবে , সচেতন হতে হবে পরিবারের লোকজনদের । জানতে হবে আমার খোকা বা খুকি ওরা কখন কি করছে, কার সাথে মিশছে। স্বাভাবিক আচরণে যদি হঠাৎ কোন পরিবর্তন আসে তাহলে অস্থির না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি টেকওভার করতে হবে। তাহলে ওরা বিপথগামী না হয়ে সুপথে থেকেই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তৈরী করবে। আর এটা নিশ্চিত করতে হবে পরিবারকে। আর সেটা হলো স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা আর মমতা। এটার কোন বিকল্প নেই।