(গত সংখ্যার পর)
১০.
বেবী আপার বইয়ের প্যাকেট খুলে ভয়ানক আশ্চর্য হয় উর্মিলা। এই বইগুলো পড়তে হবে এবং ভালো করে পড়তে হবে। ছোটদের রাজনীতি থেকে চে গুয়েভারা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নাজিম হিকমতের কবিতা। আনা ফাঙ্কোর ডায়েরি। হো চি মিনের-এর জীবনী ইত্যাকার গ্রন্থসহ জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। ইতোপূর্বে এ বইগুলোর নামও জানত না। মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলে। শুধু জলের সন্তরণ টের পায়। যেন অবিরল বৃষ্টির মগ্ন সঙ্গীত। দীপু ভাই থাকলে ভালো হতো। আকস্মিক দীপু ভাইয়ের শূন্যতা অনুভব করে। না। এতদিন দীপু ভাইয়ের কথা মনে হয়নি।
জিজ্ঞেস করলেই বলত, ‘দেবী, বই সামনে নিয়ে সরস্বতীকে ডাকুন। তিনি ভর করলে তো চিন্তামণি আপনাকে আমু-ু গিলে খাবে।’
দীপু ভাইয়ের সব কিছুতেই হেয়ালি। কী সরল দুঃখী মুখ!
অনেকক্ষণ বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। কোন বই দিয়ে বেবী আপার পাঠ আরম্ভ করবে বোঝে ওঠার আগেই ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ফ্ল্যাপে উর্মিলার চোখ আটকে যায়, ‘তবে তাই হোক হৃদয়কে পাথর করে বুকের গহিনে বহন করা বেদনাকে সংহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়ে তুলে আনি বিন্দু বিন্দু মুক্তো দানার মতো অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস। আবার আমরা ফিরে তাকাই আমাদের চরম শোক ও পরম গৌরবম-িত মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর দিকে। এক মুক্তিযোদ্ধার মাতা, এক সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, এর দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী আমাদের সবার হয়ে সম্পাদন করেছেন এই কাজ। বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহ্বল ফরিয়াদ নয়, তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনকার নিভৃততম দুঃখ অনুভূতি তাঁর ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি। তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর আপনজনের গৌরবগাথা। যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো ধারণার সঙ্গে। রুমী বুঝি কোন অলক্ষ্যে হয়ে যায় আমাদের সকলের আদরের ভাইটি, সজ্জন ব্যক্তিত্ব শরীফ প্রতীক হয়ে পড়েন রাশভারি স্নেহপ্রবণ পিতা। কিছুই আমরা ভুলব না, কাউকে ভুলব না।’
এভাবে এক স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্য দিয়ে রুমীকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে ঘুমুতে যায় উর্মিলা।
ওর মাথার ভেতরে অনেক শব্দের মানে না জানা থাকলেও জাহানারা ইমামের ইস্পাতদৃঢ় দেশপ্রেম মাতৃত্বের প্রতীক হয়ে জেগে থাকে। মনে মনে বেবী আপাকে ধন্যবাদ জানায়। দীপু ভাইকেও। ভাবে, তাইতো। যুগে যুগেই সহিষ্ণু মাতারা জন্ম নেবে। জাহানারা ইমাম থেকে বেবী আপা পর্যন্ত। দেবী দুর্গার দশম হস্তের দরকার নেই। মানবিক একটি চাদর দিগন্তের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বিছিয়ে দিতে হবে। ঘন বর্ষণে ধুয়ে যাবে সব পঙ্কিলতা। সবুজ বৃক্ষলতায় পূর্ণ ক্লোরোফিল গ্রহণ করে নিঃশ্বাস নেবে তার নাম স্বাধীনতা।
রাত এখন এগারোটার কাছাকাছি। রুবী আলোর বিপরীতে মুখ রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কী নিষ্পাপ ওর মুখ। জগতের কোনও কুটিলতা ওকে স্পর্শ করে না। কৃষককন্যার সহস্র চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিযান, আশাভঙ্গের গ্লানি মিশে গেছে দরিদ্রতার মধ্যে। রুবীকে জাগাতে ইচ্ছে করল না। রুবী ঘুমাক। বেবী আপা বলে, ‘এ ঘুমন্ত নারীকুল জেগে উঠলে, সংসারে-রাষ্ট্রে-সমাজের অনেক কুলাঙ্গার পালিয়ে যাবে।’
বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে টাওয়ালে মুখ মুছে দরজা খুলে বাইরে বের হয়। ঢাকার শহরের কেউ ঘুমায়নি। আলোর ঝলকানি গাছ-গাছালি-দালান-কোঠার ফাঁক গলে উপচে পড়তে চায়। আকাশে স্বাতি-র মুখ দেখা যায় না।
নাখালপাড়া নারী মুক্তিকেন্দ্র এ বাড়িটা বেবী আপার স্বামীর। পাঁচ বছর আগে আকস্মিক তার মৃত্যু হয়। এক ছেলে নিয়ে এত বড় বাড়িতে তিনি আর থাকতে চায়নি। কী দরকার! তৌফিক ইকবাল এখন এডিলেডে থাকে। পিএইচডি করছে জীবকোষ নিয়ে। বেবী আপা দু’রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে ফার্মগেট ইন্দিরা রোড থাকেন। ছেলে ফিরবেন কি না তাও জানেন না। আর বাড়িটি হয়ে উঠেছে দুস্থ মানবতার প্রতীক। সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানো বেবী আপার স্বপ্নের নারীকুলের নিরাপদ আশ্রয়। এ বাড়ি থেকেই শুরু করেছিলেন বেবী আপা। এত বছর পর বেবী আপা দেশ-বিদেশে সম্মানিত নারীনেত্রীর নাম। নিচতলার প্রতিটি দেয়ালজুড়ে বেবী আপার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ছবি। দেশে দেশে কীর্তিমান মানুষদের সঙ্গে বেবী আপার সখ্য আছে। তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি মানবিক রাষ্ট্রের।
গ্যারেজ, ড্রাইভারদের থাকার ঘর আলাদা। দু’জন পাহারাদার একজন বুয়া এ বাড়ির বর্তমানে মূল কর্মকর্তা। বাজার-ঘাট দারোয়ান মকীম চাচা করে। বেবী আপার অনেক দিনের দেখভাল কর্মকর্তা। এ সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রুবী-উর্মিলাকে মা জননী বলে ডাকে। দোতলা এ রুমটা বেবী আপা তার অনাথদের জন্য বানিয়েছে। যাতে ওরা দু’জন দখল নিয়েছে। নগরে এমন নিরাপদ আশ্রয় কোথায়?
ভাবতে ভাবতে দরজা আটকে বিছানায় যায় উর্মিলা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ঘুমের আড়ালে হারিয়ে যায়।
সাতদিন পর বেবী আপা ফিরে আসবে। তারও দু’দিন পর উর্মিলার ক্লাস শুরু। বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। শুভপুরের কথা মনে হয়। ইত্যাকার ভাবনার ধোঁয়াশার মধ্যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ বুকের ভিতর আমূল প্রোথিত শিকড় বিস্তার করতে থাকে। বইটি পড়া শেষ করে আর কোনও বই হাতে নিতে ইচ্ছে করেনি। রুমী স্কোয়াডের সব সদস্যই যে উর্মিলার একান্ত আপনজন। আর জননী! বঙ্গমাতার এত সন্তান এক রুমী হারিয়ে গেলে ক্ষতি কী? পাষাণ প্রতিমার মৌনতায় ডুবে থেকে ঔরসজাত সন্তান যুদ্ধের ময়দানের পাঠানোর মতো শক্তি দেশপ্রেমের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে।
দীপু ভাই এলে জিজ্ঞেস করতে হবে! শহীদ জননীর সঙ্গে মুখোমুখি হবার অদম্য ইচ্ছে উর্মিলাকে নীলাক্ত বিষে ব্যথিত করতে থাকে।
‘উর্মিলা দুপুরে তুমি রুবী আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে।’ মিতালী দিদি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল।
‘কেন?’
‘এমনি।’
একটু পর নাজনীন আপা হন্তদন্ত হয়ে উর্মিলার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমি কি আজ দুপুরের খাবার আমার সঙ্গে খাবে?’
‘মিতালী দিদি একটু আগে তার সঙ্গে লাঞ্চ করার কথা বলেছেন।’
‘তাহলে তো আরও ভালো। মিতালীর সঙ্গে টেবিলে আমরা একত্রিত হব।’
‘কী ব্যাপার নাজনীন আপা?’
‘এমনি। তুমি হলে গিয়ে রাবণকুল শিরোমণি। তোমাকে ভোগ তো দিতেই হবে।’
‘আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’ উর্মিলা বেশ হতাশ কণ্ঠে বলে।
‘তোমার বোঝার দরকার নেই।’
নাজনীন আপা দরজার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
উর্মিলার বুক দুরুদুরু করতে থাকে। পূর্বাপর প্রত্যেক ঘটে যাওয়া ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে। না এমন কোনো ব্যাপার নেই যা ওকে অপ্রস্তুত করবে।
মিতালী দিদির টেবিলে পাঁচ প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানি। ওরা চারজন সঙ্গে মঞ্জু রহমান এসে জুটেছেন। মিতালী দিদি কলকল করে কথা বলছে। কথার নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। অফিস থেকে রাজপথ। স্বৈরাচার না তাড়ালে স্বাধীনতা অর্জন ব্যর্থ হবে। ফুঁ দিয়ে তো আর এ দেশটার জন্ম হয়নি। আমরা যারা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায়। উর্মিলার মিতালী দিদির কোনো কথা বোধগম্য হলো না। ক্ষুধার্ত পেট চো চো করছে। তার মধ্যে কাচ্চির ঘ্রাণ উদরের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘মিতু, তুই কি কথা বলবি! না মেহমানদের খেতে বলবি?’ নাজনীন আপা বলে।
‘আরে তাইতো।’
ওর পাঁচজন মিলে গোগ্রাসে খেয়ে নেয়। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে মুখোমুখি বসে। মঞ্জু রহমান নিজ টেবিলে চলে গেছে। দু’দিন পর বেবী আপা আসবে। অফিসিয়াল পেপারগুলো এগিয়ে রাখতে হবে।
পিয়নকে চার কথা বলে রুমের দরজা চাপিয়ে দেয় মিতালী দিদি। চেয়ারে হেলান দিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি জাদুকর নাকি?’
‘কেন দিদি! জাদুকর হতে যাব কেন?’
‘তুমি নিশ্চয় জাদুকর। নইলে আমরা বিগত কয়েক বছরে যা পারিনি তা তুমি অল্প ক’দিনই একেবারে নিপাট করে দিয়েছ।’
উর্মিলা অসহায়ের মতো মিতালীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জি। আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?’
‘এখানে ন্যায়-অন্যায়ের কথা নয়। মিরাকল। নারীমুক্তি কেন্দ্রের ভাষা হাব-ভাব চলন তুমি পাল্টে দিয়েছ।’
‘আমি তো কিছু করিনি।’
‘নিশ্চয়ই করেছো নইলে জাকির সাহেবের মতো বদ লোক এমন হতে পারে না।’ মিতালী দিদি হাসতে থাকে।
‘তাই তো! আমাকে দু’দিন যাবত এমনভাবে কথা বলছে যেন এই মাত্র মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। পৃথিবীর কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করেনি। তা কী করে সম্ভব?’ নাজনীন আপা উৎসাহ নিয়ে বলে।
‘তোমাকে তো গুরু মানতে শুরু করেছি। বেবী আপা আসলে বলব উর্মিলাকে আমার প্রয়োজন। ওকে আমার ডেক্সে দিয়ে দেন।’
উর্মিলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি সত্যিকারে বলো তো কী ঘটেছিল?’ মিতালী দিদি বলে।
[চলবে...]
Very nice story
Reply