জীবনবোধের সফল চিত্রকল্প
বনলতা সেন
মোস্তফা কামাল
বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত চরিত্রের জনপ্রিয়তা যাচাই করলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বনলতা সেন চরিত্রটি নির্বাচিত হবে বলেই আমার মনে হয়। কবি জীবনানন্দ দাশের চেয়েও বনলতা সেন চরিত্রটি বেশি জনপ্রিয়। বনলতা সেন আসলে একটি স্বপ্ন, একটি গান, একটি নাটকীয় চরিত্র। প্রেমিকের কাছে বনলতা তার প্রেমিকা, প্রেমিকার নিজের কাছে সে নিজেই বনলতা। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩৬ সালে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত তৎকালীন ‘কবি’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশ পায় ১৯৪২ এ বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ কবিতা সিরিজে। এতে জীবনানন্দ খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন কবিতাটির সম্মানজনক একটি স্থান। অবশেষে ১৯৪৪ এ জীবনানন্দের ‘মহাপৃথিবী’ নামে নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়; বনলতা সেন এর স্থান হয় এই কাব্যগ্রন্থটির শুরুতেই। এতেও কবির মনোতুষ্টি হয়নি। কবি হয়তো তখনই অনুমান করতে পেরেছিলেন কবিতাটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে; মর্যাদা সম্পর্কে, এর দীর্ঘায়ু সম্পর্কে। তিনি চেয়েছিলেন নিজের এই সৃজন কর্মটির উচিত মর্যাদা দিতে। সবশেষে ১৯৫২ তে বনলতা সেন নামে তাঁর পূর্ণাঙ্গ একটি কাব্যগ্রন্থই আলোর মুখ দেখে; এবং গ্রন্থটির প্রচ্ছদ আঁকেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পা-ুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, কবিতাটি লেখা হয়েছিলো ১৯৩৪ সালে। সিটি কলেজের সহকারী লেকচারারের চাকরি হারানো সত্ত্বেও কবি জীবনানন্দ কলকাতায় বাস করতেন। তিনি সর্বদা রুল করা খাতায় লিখতেন। কবিতাটি আট নম্বর খাতার (কবি নিজেই সেই খাতাগুলোকে ১, ২, ৩ করে নম্বর দিয়ে রাখতেন) ২৪ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বনলতা সেন কবিতার পা-ুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে ।
কবিতার মূল ভাবটিকে অনেকে ১৮৩১ সালে লেখা এডগার এলেন পোর টু হেলেন কবিতার সাথে তুলনা করেন, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে ভাবতে ভালবাসেন। যারা পো’র নাম শুনেন নি বা ইংরেজি কবিতার প্রতি আগ্রহ কম, তাদের একটি তথ্য জানা প্রয়োজন যে, হলিউডের জনপ্রিয় নায়ক টম হ্যাঙ্কস দি ‘লেডিকিলার’ মুভিতে এই কবিতা কিছু অংশ আবৃত্তি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রভাব কাটিয়ে কল্লোলযুগের পাঁচ কবি যে আধুনিকতার অনুসন্ধান করছিলেন তার যোগ্যতম প্রতিনিধি বনলতা সেন কবিতা। তাই এই কবিতাটি বাংলা কবিতায় একটি নতুন যুগের সন্ধান দেয়। অথচ এই কবিতায় কোনো বিদ্রোহ নেই, সদম্ভ উচ্চারণ নেই, নিজের অনন্যতা ঘোষণা করার কোনো সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও নেই। কবিতাটির বুনোট অত্যন্ত নিবিড়, রোমান্টিকতার মড়োকে কবি পুরো মানবসভ্যতার পরিভ্রমণ আর গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনটি স্তবকের আঠারোটি লাইনের মাধ্যমে। কবিতাটি পাঠে মনোরম, শব্দচয়নে ঐতিহ্যনির্ভর, ভাবে মিলনোন্মুখ। হাজার হাজার বছরের অবিরাম সন্ধান শেষে ‘বনলতা সেন’ রূপী নারী অথবা প্রকৃতির কাছে মানবসভ্যতার স্বস্তিময় আত্মসমর্পণই কবিতার মূলসুর হিসেবে বেশিরভাগ পাঠকের কাছে ধরা পড়ে। কবি বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করেছেন বিদিশা নগরীর আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করেছেন ‘শ্রাবন্তী’র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। ‘বেনলতা’র চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া মধ্যযুগের শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক ‘বিদিশা’র অমোঘ আকর্ষণের মতো। নেশা ধরানো চুল, শ্রাবন্তীর হাজারো স্থাপত্য আর লাখো শিল্পীর সযতœ প্রয়াসে আঁকা মুখচ্ছবির মতো তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, ‘বনলতা’র চোখ তেমনি আশ্রয়।
কবি নির্মিত এই অপার্থিব নারীর অবয়ব নির্মাণে মাটির পৃথিবীর কোন নারী রসদ জুগিয়েছে তার রহস্য অনেকেই জানতে চান।
কেউ কেউ মনে করেন বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে । নামটির দু’টি অংশ হলো- বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই শান্তি খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি বনলতা সেন নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র। আবার, বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে বনলতা সেনের ‘সেন’ উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযোগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট কনভিন্সিং। তাঁর মতে, ‘নাটোর’ শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও এ নামটি ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য নয়, বিখ্যাত ছিলো রূপা জীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। ‘সেন’ শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর ‘বনলতা’ নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গোপন করেছে। ‘দু দ- শান্তি কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রশ্নটি এই হাহাকার প্রকাশ করে যে, কবিতার ‘আমি’ আগে দেখা দিলে, বনলতা রূপাজীবা’র পেশাটি গ্রহণ করতেন না। দুঃসময়ে কেন পাশে ছিলেন না, এই হাহাকার বনলতার বুক জুড়ে। আর এই কবিতায় আরােপিত ‘অন্ধকার’ বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযোগ নেই। ‘অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার’ স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতোই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে সাধারণ নারী।
বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন, তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন। কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন। কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতায়। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি রাখা রয়েছে । সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্ হিসেবে ণ নামে
এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তাঁর নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন ণ= শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের চাচাতো বোন শোভনার প্রতি কবি বেশ দূর্বল ছিলেন। এই শোভনাই হচ্ছেন বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলোতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা। আসলে বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন কবির বিলুপ্ত কিন্তু শাশ্বত জীবনবোধের একটি চমৎকার চিত্রকল্প। আজন্ম বিষন্নতায় ডুবে থেকে কবি দেখেছেন বাংলার ধূসর সবুজ বৃক্ষের ডালে হলুদ পাখি। শুনেছেন ঘুঘুর ডাক। শরতের শুভ্রতায় লীন হওয়া ভোরের আকাশ। বিষন্ন মন অজান্তেই জলময়ুরের নাচ দেখে অতি সন্তর্পণে, নীরবেই ভেসে চলে প্রমোদতরী। স্ফটিকস্বচ্ছ কপালের নিচে মায়বী চোখ খোঁজে রূপালী চাঁদের আলো। দুলে ওঠে স্বপ্নের শাড়ি আর পৃথিবীটা ভরে ওঠে পরাজিতের কবরে। থাকে শুধু অন্ধকার। কবিতা লিখতে এসে জীবনানন্দকে বার বার চরম বঞ্চণা আর হতাশায় নিপতিত হতে হয়েছে; অপমানে নীলকণ্ঠ হয়েছেন অনেকবার। অথচ লোকটি ছিলেন চরম মৃদু, স্বল্প ও মিষ্টভাষী; জীবনের মারপ্যাচ, গলি-ঘুপচি অতোটা বুঝতেন না, বোধকরি বোঝার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। বনলতা সেনই প্রথম এই কবিকে উঁচুতে তুলে ধরেন। এই কবিতাটিই প্রথম পাঠকের কাছ থেকে কবি স্বীকৃতি, জনপ্রিয়তা এনে দেয়; জীবনান্দ সেখান থেকেই কবি হয়ে ওঠেন। এমনকি জীবদ্দশায় তিনি যে একমাত্র স্বীকৃতিটি পান সে ঐ ‘বনলতা সেন’ এর জন্যই। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ‘বনলতা সেন’ ১৯৫২-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যের স্বীকৃতি পান।