বসন্ত দিনের পোড়া মন
এইচ এম সিরাজ
তখন মাঘ মাস। শীতের বেশি স্থায়িত্ব আর নেই বললেই চলে। ক’দিন পরেই শুরু হবে ঋতুরাজ বসন্তের। এই সময়ে রাজধানীর একটা গ্রুপ অব কোম্পানীতে নতুন চাকরি হয় সুমনের। ভালো বেতন। ফুরফুরে সময় কাটবে।
এই সময়ে মনের কথা শেয়ার করার মতো কারো অভাব বোধ করে সুমন। কিছু দিনের মধ্যে সে অভাবও পূরণ হয় তুলিকে পেয়ে। একসাথে আসা-যাওয়া আর লাঞ্চ করাতে কোম্পানীর অনেকের চোখেই সুমন-তুলি জুটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। তুলি প্রায়ই ফোনে বলত- সুমন, কি লাঞ্চ করা লাগবে না?
লাঞ্চ করার পরে একটা পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল তুলির। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করতে না পারলে তুলির যেন পেটের ভাত হজম হতো না। পান খাওয়া মুখে তুলিকে লাগতও বেশ। তাই লাঞ্চ সেরে দোকান থেকে দু’একটি পানের খিল্লি তুলির হাতে এনে দিলে তুলি বেশ খুশি হতো।
একদিন অরিন্দকে লাঞ্চের বাটি হাতে কারো জন্য অপেক্ষা করতে দেখে সুমন। জিজ্ঞেস করলে অরিন্দম জানায় সে তুলির জন্য অপেক্ষা করছিল। অরিন্দমও তুলির অফিস-কলিগ। তুলির জন্য অপেক্ষা করার কথা শুনে শরীরের ভেতরে ভীষণ একটা তাপ খেলে যায় সুমনের। কয়েক সেকে-ের মধ্যেই সুমনের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে। ঠিক তখনই তুলির কল আসে―কই তুমি? লাঞ্জে যাবে না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমন ভেবেছিল, যাক বাঁচা গেল। তুমি আমারই। তুমি আমাকে ছাড়া আর কারো কাছে যেতে পারো না, তুলি।
তখন ফাগুন মাস চলছে। প্রকৃতির মাঝে চলছে পরিবর্তনের চিরন্তন ক্রিয়া। শিমুলের লাল ফুলে ভরে গেছে শাখা প্রশাখা। গাছের ডালপালা থেকে শুরু করে মানুষের দেহ-মনেও পরিবর্তনের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। শীতের আড়মোড়া ভেঙে কারো মনে এসেছে চঞ্চলতা। কোনো কোনো গাছের ডালে দেখা দিয়েছে নতুন পাতা। বাগানে বাগানে শোনা যাচ্ছে কোকিলের কুহুতান। প্রকৃতি আপন মনে বাউরি বাতাস বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে কখনো-সখনো। ঝরঝর করে উঠছে গাছের পাতা। শুকনো পাতা পড়ে ভরে যাচ্ছে কারো বাগানবাড়ি, গাছের তলা। ভোরবেলা ও স›ধ্যায় এই বাউরি বাতাস গায়ে লাগলে একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগে; ভালো লাগে মনে ও শরীরে।
এমনি পরিবর্তনে মানুষের মনে যেমন পরিবর্তন আসে, ঠিক তেমনি দেহেও নানা রকম রোগের দেখা মেলে। ফাগুনের শেষ দিকে তুলি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বসন্তের এই ক্ষণে তার গায়ে গুটি বসন্ত ওঠে। তিনদিন পরে তুলির ছোটভাইয়ের মুখে ওর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে সুমন দ্রুত ছুটে যায় তুলিকে দেখতে। তার আর তর সয় না। একনজর তুলিকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সুমনের বাসন্তী-মন।
সুমনকে রিসিভ করতে তুলি মেইন-রোডে এসে দাঁড়ায়। তুলির পরনের সবুজ সেলোয়ার-কামিজ আর গায়ে-মাথায় ধবধবে সাদা ওড়নায় সেদিন তুলিকে বড্ড ভালো লাগছিল। তুলির এমন রূপ সুমনের মনে বসন্তের বাউরি বাতাস বইয়ে দেয়।
সুমনকে তুলি তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় তখন তুলির ভাই কিংবা অন্য কোনো লোক ছিল না; একদম নির্জন পরিবেশের একটি বাসা। সুমনের সাথে অনেক সময় ধরে চোখে চোখ রেখে গল্প করেছিল তুলি। সুমনকে পেয়ে তুলির সব অসুখ ভালো হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তুলি সার-পানি দেয়া গাছের মতো সজীব হয়ে উঠেছিল।
এসব কেবলই ধুসর স্মৃতি। কথায় আছে―জীবনের সবদিন সমান যায় না। ঠিক তাই। তুলির সাথে এতো মধুরতা মনে হয় বিধাতাও সইতে পারল না। হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে তুলি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। আবার ফিরে আসবে, ভালোবাসবে, ঘর বাঁধবে বলে কথা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেই কথা, শুধু কথা-ই থেকে যায়। বাড়িতে যাবার পরে তুলির নাম্বারে আজো কোনো সংযোগ পায়নি সুমন।
অবসরে তুলির দেয়া টেক্সটগুলো সুমন নীরবে-নিভৃতে আওড়ায়। ফাগুনের মধুর স্মৃতি বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ায়। বুকটা তার কাছে পাহাড়ের মতো ভারী লাগে। বুকভাঙা নিঃশ্বাস ফেলে বুকের জমিনে। কখনো আকাশের দিকে তাকায়, কখনো বা সেলফোনের দিকে; পথ চলে পাগলের মতো উদাস হয়ে। গায়ে কোনো ভালো জামা-কাপড় পরে না। শরীরের কোনো যতœ নেয় না। ইদানীং পায়ে থাকে ছেঁড়া স্লিপার, গায়ে মলিন টি-শার্ট।
সুমন আজকাল চারপাশের বন্ধুদের সাথেও আড্ডায় গা ভাসায় না। ফাগুন ঘিরে তুলির সাথে তার সব স্মৃতি এখন চুরুটের আগুনের মতো একটু একটু করে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে তার ভেতরের সবকিছু। সার-পানি ছাড়া নেতিয়ে পড়া লাউয়ের ডগার মতো সে এখন। ইদানীং সিগারেটের নিকোটিনে বারবার আহত করছে নিজেকে, ক্ষত-বিক্ষত করছে ভেতরটাকে। গভীর রাতে বাসায় ফেরে। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই; চোখমুখ যেন গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে সুমনের। দেখলে মনে হয় কোনো এক মানসিক সিডরে সে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
সুমন এখন আর চাকুরিতেও যায় না। তুলিহীনতাই তার অস্তিত্বকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার যাবতীয় কার্যক্রম যেন হাতে তুলে নিয়েছে। তুলির বিরহে মাঝে-মাঝে মনটা তার হুহু করে কেঁদে ওঠে। তুলির সাথে আর কোনোদিন কি দেখা হবে না সুমনের?