ক্ষণপ্রেম
মোহাম্মদ অংকন
ডিসেম্বরের শুরুতেই আমার সপ্তাহখানেক ছুটির ফুসরত মেলে। ক’দিনের জন্য গ্রামে যাবো কি যাবো না, এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। তাই আর ট্রেনের অগ্রীম টিকেট কাটা হয় না। কিন্তু ছুটি শুরু হলে মন আর শহরে একদম টানে না। শীতের আমেজ ও মায়ের হাতের শীত-পিঠার প্রতি লোভ আমাকে গ্রামে ছুটে যেতে বাধ্য করে। তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে সেদিন সকালে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে চলে যাই। আমি বেশ ভাল করেই জানি, দশ দিন আগে ট্রেনের টিকেট না কিনে রাখলে সীট পাওয়া যায় না। তখন স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটতে হয়। নিরুপায় হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে একটা স্ট্যান্ডিং টিকেট কিনে ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’ ট্রেনের জন্য প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোবাইলে দু’একটা সেলফি তুলছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কমলাপুর হতে ট্রেনটা কখন রওনা করে। বাংলাদেশী ট্রেন! বলা যায় না, কতক্ষণ যে লেট করে তার হদিস নাই। ততক্ষণে মা’কে ফোন করে জানিয়ে দেই, ‘হ্যাঁলো মা, আমি আজ বাড়ি আসছি।..’
মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে পূর্ব দিক হয়ে দাঁড়াতেই দেখি আমার পাশে একজন যুবতী মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমার দিকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ তা সু-নিশ্চিত। আমি লজ্জায় কিছু না বলে মুখ ফেরাতেই সে আমাকে ডেকে বসল।
-আপনি উত্তরবঙ্গের লোক?
-জ্বি। আপনি বুঝলেন কেমন করে?
-একটু আগে আপনি মোবাইলে কথা বলছিলেন। সেসব শুনে আমি নির্ণয় করেছি আপনি উত্তরবঙ্গের মানুষ। আর আমিও উত্তরবঙ্গের..
-বাহ! আপনার স্বজাতিবোধ বেশ প্রসংশনীয়। ভাষা শুনেই চিনতে পেরেছেন। আজকাল তো মানুষজন এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে।.. নীলসাগরে ফিরবেন বুঝি?
-হ্যাঁ। তবে আমি এখন বিপদগ্রস্থ। মিরপুর হতে এখানে আসার পথে আমার পার্সটা হারিয়ে ফেলেছি। যাতে আমার টাকা, টিকেট ও মোবাইল ছিল। আমার পরিবারের কারও নম্বর আপাতত মুখস্থ নাই বলে আমি তাদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি এবং ছাত্রীনিবাসে থাকি। সেখানে ফিরে গিয়েও লাভ হবে না। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে সবাই ইতোমধ্যে বাড়ি চলে গেছে। আপনি যদি যাত্রা পথে আমাকে সামান্য সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তাহলে আমি আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
আমি মেয়েটির কথা-বার্তায় হতবাক না হয়ে পারলামই না। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এমনও হতে পারে! আবার মাঝে মাঝে অবিশ্বাস হচ্ছিল। আমি কি বিপদের মধ্যে পতিত হচ্ছি না? পরিশেষে আমি অতিব বিশ্বাস প্রবণ বলে তার সহযোগিতা প্রার্থনার বিষয়ে আমি সম্মতি প্রদান করে ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিলাম। আমার হ্যাঁবোধক সম্বোধনে মেয়েটির মলিন মুখে একটু হাসির রেশ দেখা গেল। একটু পূর্বের ঘটনাসমূহ যেন সে সব ভুলে গেল। অক্ষত লাগেজটা নিয়ে দিব্যি আমার যাত্রাসঙ্গি হয়ে পাশে দাঁড়ালো। আমি ফেসবুকে চেক ইন দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম, নিরুপায় সুন্দরী মেয়েটা আমার থেকে কি ধরনের সহযোগিতা পেতে পারে? ট্রেনে নাস্তা খাওয়ার জন্য টাকার সহযোগিতা? না। আমার সীটে বসার সুযোগ নেওয়া? ভেবে পাচ্ছি না। আর নিরাপত্তার সুযোগ নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কেননা, যে কি না ঢাকায় পড়াশোনা করে, সে তো অনেক সাহসী, চালাক, সচেতন হবেই। হয়তো কোনো অখেয়ালবশত পার্সটা খোয়া গেছে আজ। এটা নিছক দূর্ঘটনা। সাহসীরাও অনেক সময় দূর্ঘটনার শিকার হয়।
ট্রেন আসছে কি না মেয়েটি প্লাটফর্ম হতে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছিল। আমি মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তার সাথে একটু ইজি হওয়ার প্রচেষ্টা চালালাম। আমি সহজে মেয়েদের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলি না। তবে সেদিনের প্রসঙ্গটা ভিন্ন বলেই আমার কথা বলার আগ্রহবোধ অপরিমেয় ছিল।
-আচ্ছা, আপনি সহযোগিতার কথা বলছিলেন তখন। তবে আমি ভেবে পাচ্ছি না যে আপনাকে আমি কিভাবে সহযোগিতা করব?
-আপনি তো পুরুষ। তাই ট্রেনের সীটটা দখল করতে আপনাকে আমার ভীষণ দরকার হতে পারে।
-আমি বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
-বুঝলেন না তো! দাঁড়ান বলছি। আমি যে টিকেট কিনেছিলাম, তার বগি ও সীট নম্বর আমার বেশ মুখস্থ আছে। তাই ট্রেনে উঠে বলে কয়ে সীটটা উদ্ধার করে দিবেন। জানেন তো, বাঙালীরা কেমন? টিকেট থাকুক বা না থাকুক সীট ফাঁকা থাকলে তারা দখল করে বসে।
আমি সীট উদ্ধার করতে পারব কি না তার নিশ্চয়তা নেই; আমি অন্যকে খুব সহজে বিশ্বাস করলেও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। তারপরও আমি মাথাটা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে দিলাম। কেননা, তার সুললিত কণ্ঠ নিংসৃত প্রতিটি কথাই আমার মাথা পেতে নিতে মন চাচ্ছিল। ক্রমশ আমার মনে ও শরীরে সাহসের সঞ্চারণ হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, রাজধানীতে আমি কোনো দিন বাসের ভাড়া নিয়ে কন্টাক্টারদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করি না। ট্রেন ভ্রমণে কখনও বিনা টিকেটে যাই না। সেই আমি কি না দখলকৃত ট্রেনের সীট উদ্ধার করব! তারপর আবার কোনো প্রমাণ নেই যে সীটটি আমাদের। ট্রেনের ভেতরে হুলস্থুল কা- হয় কি না তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম।
-আর হ্যাঁ, আমি যে বগিতে উঠব, আপনিও সেই বগিতেই উঠবেন। আমার পাশেই আপনি টুল পেতে বসতে পারবেন। আমি কোনো আপত্তি করব না। বরং গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। আমরা তো এখন বেশ পরিচিত।
আমি তার এ কথাটিও অনায়াসে মেনে নিলাম। আর যে কথাটা বলা দরকার, আমি যখন ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটি তখন একটা ফ্লোডিং টুল সঙ্গে করে রওনা করি যাতে সারা সময় দাঁড়িয়ে যাওয়া না লাগে। মেয়েটি আমার ফ্লোডিং টুলটা দেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছে আমি সীটবিহীন টিকেট কিনেছি। বিষয়টি বুঝে ফেলায় আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। যেহেতু সে প্রথম থেকেই আমাকে আবিষ্কার করে চলেছে; তাই আমি তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। সেই বিশ্বাস থেকে আমার ব্যাগপত্র রেখে পানি কিনতে মুদি দোকানে চলে গেলাম।
প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট বিলম্ব হওয়ার পর কাঙ্খিত ট্রেন চলে আসলো। আমরা তাড়াহুড়ো করে ‘ঞ’ নং বগিতে উঠলাম। মেয়েটার সীট নং ছিল ৪২। ভীড় ঠেঁলে সেখানে সরাসরি চলে গেলাম। অবিশ্বাস্য যে সীটখানা দিব্যি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আমি তো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সীটের জন্য কারও সাথে দু’দ- ঝগড়া করতে হল না। বিনা উপকারে একজন অপরিচিতার নজরে আমি ‘পুরুষ’ রুপে প্রতীয়মান হলাম। মেয়েটি ব্যাগপত্র ট্রেনের ডালায় রেখে বসে পড়ল; আমিও ব্যাগপত্র ডালায় রেখে ফ্লোডিং টুল বিছিয়ে নিয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। ততক্ষণে মেয়েটার উৎফুল্লতা কাজ করছিল।
-ভাগ্যিস, পার্স হারালেও ট্রেনের সীটটা হারায় নি।
আমিও তার আবেগপ্রবণতা ও বন্ধুসুলোভ আচরণে বিমোহিত হতে লাগলাম। অতঃপর ট্রেন ছেড়ে দিল। আমাদের দু’জনের গল্পগুজব শুরু হয়ে গেল। যেন আমরা হাজার বছর ধরে একে অপরকে চিনি, জানি। যে আমি মোবাইলে গেম ও ইন্টারনেট ব্রাউজিং বলতে পাগল, সেই আমি এক অপরিচিতার সাথে সখ্যতায় মেতে উঠেছি। মনে হল, বহুকাল পর নিজেকে বদলে নিয়েছি।
ইতোপূর্বে আমি ট্রেনে বহুবার ভ্রমণ করেছি। কিন্তু কখনও এমনটা হয় নি। একাকী বাড়ি গিয়েছি, একাকী শহরে এসেছি। এসব নিয়েই তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প চলছিল। তার সর্ম্পকে আমিও পুরোপুরি জানি নি, সেও আমার সর্ম্পকে পুরোপুরি জানে নি। ব্যাপারখানা বড়ই অদ্ভুত ছিল। তবে তার আর আমার অসংখ্য কথা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এমন হৃদ্যতা হয়েছে যে অন্যান্য যাত্রীরা শতভাগ ধরে নিয়েছে যে আমি আর সে মেয়েটা সদ্য বিবাহিত দম্পতি! কিন্তু প্রসঙ্গটি যে শতভাগ মেকি, তা প্রথম হতে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝার অবকাশ নাই।
সেদিন ট্রেন জার্নিটা আমার কাছে খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হয়েছিল। খুব কম সময়ের ব্যবধানে আমি নাটোরে পৌঁছে যাই। মেয়েটি ট্রেনে থেকে যায়। তার গন্তব্য কোন স্টেশন অবধি, তা আমার জানা হয় না। আমি যখন নাটোর স্টেশনে নামছিলাম, মেয়েটি তখন আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমাদের মাঝে যেন একটা ব্যবচ্ছেদ হচ্ছিল। আমি হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিলাম। হঠাৎ সে আমাকে ডাক দিয়ে বসে।
-এই শোনো, তোমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যাও, প্লিজ।
ততক্ষণে ট্রেনের বাঁশি বেজে ওঠে। আমি পকেট থেকে টিকেট বের করে তার বিপরীত পাশে মোবাইল নম্বরটা লিখে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে দিয়ে আসি। টিকেটটা দিতেই তার কোমল হাতের স্পর্শ আমাকে এক গভীর অনুভূতির জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আমার মধ্যে তারপর থেকে অবিসম্ভাব্য পরিবর্তন আসতে থাকে।
আমি বাড়ি ফিরে যাই। তারপর কয়েকটা দিন কেটে যায়। কিন্তু অপরিচিতার প্রেমময় মানবিক আচরণ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না তার হাসি, তার ছোট ছোট অভিব্যক্তি, খুঁনসুটি। ক্রমশ মনে পড়ে, ট্রেনে বসে তার নিজ হাতের রান্না করা ডিম-খিচুড়ি ভাগাভাগি করে খাওয়ার দারুণ মুহূর্তটা। কতই না স্বাদ মেশানো ছিল খিচুড়ি ও তার স্বচ্ছ হাসিতে। তার টোল পড়া মুখ-অবয়ব কতই না পবিত্র ছিল! আমি গ্রামের দিনগুলো খুব শূণ্যতায় অতিক্রম করতে থাকি। তার কথাগুলো নিরালায়, নির্জনে ভাবতে থাকি। তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। তবে কবিতারা শেষ হয় না। মনে হয়, তার সাথে আমার এক জনমের ভালোবাসার মেলবন্ধন ছিল এবং আছে। কবিতার লাইন শেষ করা মানেই তা যেন অস্বীকার করা! তাকে নিয়ে বিচ্ছিন্ন এমন ভাবনায় আমি নাওয়া, খাওয়া ভুলতে বসি। শরীরের যতœ নেই না। কারও সাথে মিশতে চাই না। আমি যেন বারবার ব্যর্থ হয়ে যাই। আমার মানসিক পরিস্থিতি দেখে মায়ের মনটাও বিচলিত হয়ে ওঠে।
-বাজান, তোমার কি হয়েছে? শহর থেকে আসার পর থেকেই তুমি যেন উদাস মনে আছো? কতগুলো পিঠা বানালাম, একটিও এখনও মুখে তুললে না?
আমি মায়ের কথায় কোনো উত্তর করতে আগ্রহ বোধ করি না। এ কথা যে কাউকে বলা যায় না, মাকে বোঝাব কি করে? বিষন্নতা দূরীকরণের আশ্বাসে নদীর ধারে হাঁটতে চলে যাই। ভাবতে থাকি, সেদিন কত শত কথা হল। তবে কেন আমি তার পরিচয় নিলাম না? নামটাও জানার খেয়াল করতে পারি নি। আমি এত বোকা কেন? অতঃপর হাঁটতে হাঁটতে মনে আশ্বাস জন্মে, সে আমাকে হয়তো একদিন না একদিন কল করবে। কিন্তু ছুটির সপ্তাহ অতিক্রম হলেও তার কোনো সারা-শব্দ না পেয়ে আমি বেসুরে গাইতে থাকি-
এ যে আমার মিছে প্রেম, কি সে আমি আশা করি
শীতল হিমে েেথমে থেমে কেন বারবার প্রেমে পড়ি?
২
ঢাকা হতে গ্রামে ফেরার ১২ দিন অতিক্রম হয়ে যায়। আমার ছুটি ফুরিয়ে আরও পাঁচদিন অতিক্রম হয়ে যায়। শরীরে প্রচ- জ্বর আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। তবুও ঢাকায় ফিরে যেতে উঠে পড়ে লাগি। কিন্তু এবার আর স্ট্যান্ডিং টিকেট নয়, সপ্তাহখানেক আগেই ৩২০ টাকায় টিকেট কিনি। টিকেট হয় ‘ঞ’ বগির এবং সীট হয় ৪২ নং। আমি হতচকিত হয়ে পড়ি। সেই দিনটির কথা ভুলতে েেচয়েও পারি না। জ্বরাক্রান্ত মনে ভাবতে থাকি, যাত্রা পথে যদি তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়? তবে আর ভুল করব না। আমার মনের কথাগুলো তার মনের অগভীরে সযতেœ পৌঁছে দিবো। তারপর শুভ্র-দুপুরে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে রওনা করি।
জ্বরাক্রান্ত শরীরে জানালার পাশে বসে একটি বই পড়তে পড়তে শহরের দিকে যেতে থাকি। ঝকঝক শব্দে ট্রেন চলতে থাকে। আমি বই হতে কি পড়ছি তা আর আমার মনে খেলা করে না। শুধু খেলা করে হারিয়ে ফেলা নেই মেয়েটির নূপুর কিংবা চুড়ির শব্দ। চোখ মিলিয়ে তাকে উপলব্ধি করতে থাকি। আমার মোবাইলে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। ও পাশ থেকে ‘হ্যাঁলো’ বলতেই আমি নির্ণয় করে ফেলি, ও সেই অপরিচিতা!
-ও গো প্রিয়, তুমি কি চিনতে পেরেছো আমায়?
-কেন চিনবো না হে মোর প্রেয়সী? তুমি এখন আমার ভাবনার শীর্ষ বিন্দুতে মিশে আছো, মিশে আছো আমার লেখা শতশত প্রেমের কবিতায়। কবিতাগুলো যখন ব্যর্থ হতে চলেছে, তখন তোমার সম্মোহনে প্রাণ পেতে চলেছে।
-ও আচ্ছা, তাই না! তবে এখন রাখছি। ঢাকায় ফিরে কথা হবে। এখন ট্রেনে আমি। এটা আমার নম্বর।
তার ট্রেনে থাকার কথাটিতে আমি যেন দেহে প্রাণ ফিরে পাই। আমার রক্তের গতিবেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
-কোন ট্রেন?
-দ্রুতযান।
-কোন বগি? কোন সীট?
-‘ক’ বগি, ১০ নং সীট।
তারপর আমি আমার সীটখানা ত্যাগ করে, পাঁচসাতটা বগি ডিঙিয়ে অতিব সন্তপর্ণে তার কাছে ছুটে চলে যাই। তার পুলকিত হাসিমালা আমাকে সাদরে বরণ করে নেয়। তারপর সীটবিহীন আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বিরহের দিনগুলোর কথারাশি ব্যক্ত করতে থাকি। সে আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে আর ছোট ছোট করে ঢোক গেলে। তার অভিব্যক্তিতে আমি আশ্বস্থ হই। সে-ও যেন আমার মতো প্রেম-যাতনায় এতদিন কাতর ছিল। হয়তো নারী মানসের কারণে বুক ফাটলেও তার মুখ ফোঁটে নাই।
তারপর কোন এক সময় পর তার পাশের সীটে বসা ভদ্রলোকটি কোনো এক স্টেশনে নেমে যায়। সীটটা ফাঁকা রয় বিধায় আমি তার পাশাপাশি বসার সুযোগ পাই। তার লম্বা চুলের দুলনি আমার হৃদয়ে অযাচিত দোলা দিয়ে যায়! তার নরম হাতের স্পর্শ আমাকে হিম শীতল আবেস দিয়ে যায়! দখিণা বাতাসে তার বুকের ওড়না আমার মুখের উপর ছুটে আসে। ঘন সাঝে যমুনা সেতু পার হতে হতে সে যমুনার বুকে জলের ঢেউ দেখে আর আমি তার বুকে ভালবাসার ঢেউ অবলোকন করি। লজ্জার মাথা ঠুঁকে ট্রেনের টিমটিম আলোয় ঝাঁপটে ধরি রমনীর কচি দেহ। ও যেন নিমিষে বিছিয়ে পড়ে আমার শরীরে। আমার চুম্বনে ও যেন স্বর্গসুখ পায়। ওর ঠোঁট বেয়ে নেমে আসে অমিত লালা! রঙিন ঠোঁট বিবর্ণ হয়! আমাদের পবিত্র ভালবাসার মিলন যাত্রীরা সুদৃষ্টিতে বিচার করে। তারপর চিরচেনা যান্ত্রিক শহরে দু’জন চলে আসি। এখন অবসরের দিনগুলোতে অপরিচিতার সাথে কফি আড্ডায় কোনো রেস্টুরেন্টে বসি, অথবা কোনো পার্কে যাই। রাত জেগে কথা হয়।..
অতঃপর রাত দশটায় ট্রেন থেকে সবাই নেমে যায়। আমার পাশে বসা লোকটি বলে, ‘ভাই, কমলাপুর এসে গেছি। নামবেন না?’ আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারি না। রাতের আঁধার শহরটাকে ঘিরে নিয়েছে। জানালা ভেদ করে তাকিয়ে দেখি সত্যই এটা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি। হায়! রে আমি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে এসেছি। অতঃপর ডালা থেকে ব্যাগটি নিয়ে প্লাটফর্মে নেমে যাই। একটি শিশু এসে হাত পেতে জানায়, ‘কয়ডা টাহা দেন। ভাত কিন্না খামু। সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।’ তাকে পাঁচটা টাকা দিবো ভেবে পকেটে হাতটা ঢুকাই। কিন্তু ম্যানিব্যাগের কোনো সন্ধান মেলে না। মাথাটা তখন ভীষণ চিনচিন করে। কাঁধের ব্যাগটা প্লাটফর্মে ফেলিয়ে তার ওপর বসে পড়ি। ভাবতে থাকি, এই শহরে আমি সারা মাস কিভাবে চলবো? আমি কিভাবে বাসা ভাড়া দিবো? আমি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি দিবো?
পথশিশুটি আমার ভেঙ্গে পড়ার অভিব্যক্তিতে বলে ওঠে, ‘কি হয়েছে, ভাইয়া?’