আমার প্রিয় বাবা



আমার প্রিয় বাবা
আহমদ মেহেদী 

-বাবা, কালকে ঢাকা যাইবা?
-হ্যাঁ যাবতো।
-বাবা, আমার জন্য একটি ফুটবল আনবা কিন্তু ।
-ঠিক আছে আনব, বড় না ছোট ?
- মাঝারিটা আইন্নো কেমন।


বাবার সাথে ঘুমানের আগে আমার এসব নিত্যনতুন বায়না-বিলাস বলা যায়। আমার আরেকটা ফুটবল আছে , এটা নাকি গুঁইসাপের চামড়া দিয়ে বানানো তাই খেলার সময় পায়ে ব্যাথা পাই। ব্যাথা নিরাময়ের জন্য চিন্তা করতে করতে একদিন বিকালে হিজল গাছের নিচে আমি আর আমার জ্যাঠাত ভাই ইব্রাহিম মিলে বলটাকে ইচ্ছেমতো কুপিয়ে জখম করে মনে কি যে আনন্দ - ঊল্লাস তা বলে শেষ করা যাবেনা। ইব্রাহিম একবার বলতে চেষ্টা করেছিল বলটা কেটে ফেলবি ? কে শুনে কার কথা ! আমাদের হৃদয়-রাজ্যে তখন বিজয়ের ঘনঘটা।

বাবা আসতে দেরি হওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে দেখি আমি বাবার বুকে শুয়ে আছি । আর চোখ খুলতেই দেখি আমাদের ঘরের বাঁশের তীরে আমার নতুন ফুটবল ঝুলছে ! আমার ছেলেবেলার আনন্দ-দিনের মধ্যে এটি একটি । আমার বাবা জুতা-ব্যাবসা করতেন । স্কুল ছুটি দিলে প্রায়ই আমাকে তার সাথে দোকানে নিয়ে যেতেন । আর সারাদিন চলত আমার বায়না-বিলাস , আম খাব,জাম খাব এবং আরও কতো কি। বাবা ঢাকা গেলেই আমার জন্য একটি হাফ-শার্ট নিয়ে আসতেন আর এটা দোকানে যেদিন যেতাম সেদিনই আমাকে দিয়ে বলতেন- ‘ তোর মা জিংগাইলে কবি মামা কিন্না দিছে ’ ।
তিনি দোকানে যাওয়ার সময় আমাকে মক্তবে দিয়ে যেতেন আর পকেট থেকে কখনো  দশ টাকা কখনো বিশ টাকা দিয়ে যেতেন  স্কুলে টিফিনের জন্য । আমিও বাবার পকেট থেকে আরো দশ /বিশ টাকা চুরি করতাম । বাবা দেখেও অনেক সময় না দেখার ভান করতেন , শুধু বলতেন –‘তোর মা যেন না দেহে ’। আমি মনে করতাম বাবার পকেট থেকে টাকা নিলে যেহেতু কিছু হয় না ,তাই কাকাদের পকেট থেকেও টাকা চুরি করে এটা কিনি , ওটা কিনি । ক্রিকেট ব্যাট দুইটা আছে আরেকটা কিনা দরকার, ছয়টা স্টাম্প কিনা দরকার আরোও কত শত চিন্তা মাথার মধ্যে। এরজন্য  চাচিদের অনেক কটুকথা শুনতে হয়েছে অবশ্য । তখনও আমি বুঝতে শিখিনি কাকা আর বাবা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি সত্তা এই সংসারের যাপিত জীবনে।

ক্লাশে প্রথম হই বলে বাবা সবার আগে নতুন জামা আর ইংলিশ প্যান্ট বানিয়ে দিতেন ।রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নতুন ক্লাশের নতুন বই নিয়ে আসতেন। নতুন বইয়ের গন্ধে আমার কৈশোরের বান্দ্রামি আরো বেরে যেতো । অন্যায় আবদার করতে গিয়ে অভিমানও করতাম অনেক। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও তার সাথে রেগে যেতাম যা আজ ও ভাবলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় । আমাদের পরিবারের সুখের  জন্য এখনো বাবা নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো আমি বাড়ি থেকে কোথাও বেরোলে বলে বসেন- ‘ ছাতাটা নিয়ে যা , যা রোদ পড়ছে এবার ! চুল-দাড়ি একটু বড় হলেই বাড়িতে গেলে জবাবদিহি করতে হয় , এখনো কাটলাম না কেন? জামাটা ইস্ত্রি করা হয়নি কেন ইত্যাদি ..... ইত্যাদি । তার স্বাস্থের অবস্থা ভাল না কিন্তু আমার কিছু হলে একেবারে দিশেহারা হয়ে যান, বাবার ছেলের প্রতি এই আন্তরিকতা দেখে আমি ফিফটি পারসেন্ট ভাল হয়ে যাই। এখনো খরচের ব্যাগ বয়ে বেড়ান। তার ধারনা তিনিই যেমন থাকেন না কেন তার ছেলে -মেয়েরা টাটকা খাবার খেতে পারে। আমি মাঝে মাঝে বাবাকে ফোন দেই
-‘বাবা, খরচের ব্যাগ আছে আজকে?
-আছেতো, তুই রিকশা করে বাড়িত যা , আমিই নিয়ে যাব। যাবার সময় বাতেনের দোকান থেকে একটা ডাব খেয়ে যাইছ।
আমি ভাবি এই মানুষটি আসলে কি! আমি এখন পর্যন্ত তার কোন দোষ খুজে পাইনি আমার জন্মের পর থেকে।

আমাদের দোকান পুড়ে যাবার পর বাবা আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি কিন্তু বাজারে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই একদিন আমাকে বলল
-‘আমাকে একটি কাজ ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
-কেন বাবা? কি হয়েছে ?
-কিছুনা , আমার বাড়িতে ভাল লাগেনা তাই।
বাবার ভাল লাগা দিয়ে কথা , বাবা যেহেতু জুতা ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিল তাকে আমাদের এক আত্মীয় কথায় কথায় তার  দোকানে বসতে বলেছিল । বাবার সাফ কথা তার ছেলের অনুমতি লাগবে। বাবার মনের অবস্থা চিন্তা করে অনুমতি দিয়ে দিলাম। লোকে যে যাই বলুক-ভাবুক ,আমার বাবা ভাল থাকুক।  সেদিন আমি কষ্টও পেয়েছিলাম খুব । সে দোকানে আমি প্রায়ই যাই বাবার সাথে দেখা করতে। খরচের ব্যাগটা বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই ,তিনি বারন করেন কিন্তু ভাবি বাবা আর কত করবে আমাদের জন্য ! খরচের ব্যাগটা দিলেও বলে দিবেন-‘রিকশা করে যাইছ , হেটে যেতে পারতি না’। একদিন বাবাকে বললাম
-বাবা, তোমার সাথে একটা ছবি তুলব !
-আরে না , ময়লা জামা পড়ে আছি এখন কি ছবি তুলবি ।
-তুমি ক্যাশে বসতো বাবা , কোন সমস্যা নাই।
বাবার সাথের আরেকজনকে বললাম-একটা ছবি তুলেনতো দেখি । তখনই আলামিন কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন।
এখনো বাড়িতে গেলে বাবা প্রথমেই জানতে চান আমি খেয়েছি না , আর না খেলেও কেন খাবনা নানান ধরনের জবাবদিহিতা। বাবা, তোমার মতো এমন বাবা কি আর কারো আছে ? আমার মনে হয় না বাবা । তোমার মতো কি তার ছেলের জ¦র হলে এমন মমতায় পানি ঢেলে দেয় ? কখনো না । বাবা এই পৃথিবিতে শুধু তুমি একজনই বাবা আমার যেকিনা তার ছেলের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে মানুষের কাছে হাত পাততে দ্বিধা করতো না। আল্লাহর কসম বাবা-তুমিই পৃথিবির শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার প্রিয় বাবা। আমিও তোমার মতো বাবা হতে চাই। আমার জন্য, এই ফ্যামিলির জন্য কতোটা কষ্ট করে যাচ্ছ তা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারব তখন। বাবা, একটি কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি-আবার একদিন তোমার বুকে ঘুমাতে চাই, সেদিন শুধু একটি বায়নাই করব-‘তুমি ভাল আছতো বাবা ? এখন থেকে  তোমার নিজের কথা শুধু ভাববে কেমন ’। তোমার এই রাগি ছেলেটা আছে তোমার পাশে ।

নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার , কুমিল্লা

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট