উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’র কবি
লতিফ মাহমুদ
মোহাম্মদ অংকন
ভূমিকা
কবিতা সাহিত্যের প্রধানতম শাখা। যিনি কবিতা লিখেন, তিনি কবি। কবিতা লেখার নানা ধাচ বা ধারারয়েছে। কবিতায় কবিদের নিজস্ব ভাষা থাকে। আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়লেই বুঝতে পারি যে এটা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, আল মাহমুদের কবিতা ইত্যাদি। মাইকেল মধুসূধন দত্তের সনেট পড়লে উপলব্ধি করা যায়, কবিতা ও ভাষার বৈচিত্রতার সম্বনয়ে গঠিত এ যেন ভিন্নমাত্রার কবিতা। এসব কবিতা এখন ‘কবিতার ফরম্যাট’। সকল কবির ‘কবিতার ফরম্যাট’ নেই। গতানুগতিক ধাচের কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন অসংখ্য কবি। প্রচলিত ধাচের বাহিরে কবিতা লেখার কাজ করেছেন,নানা তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন ও নিজস্ব নিয়মে বিশেষ ধরনের কবিতার উদ্ভাবন করেছেন এমনই একজন হলেন চলনবিল অধ্যূষিত এলাকা সিংড়ার লতিফ মাহমুদ।লতিফ মাহমুদ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন বগুড়া ও ঢাকায়। ৫৯ বছর বয়সী লতিফ মাহমুদের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চামারি ইউনিয়নের বিলদহর গ্রামে। তিনি এখন কালীনগর গ্রামে বাস করেন। সংস্কৃতিমনা লতিফ মাহমুদের সংস্কৃতির পথে চলার একটা সময় খেয়াল হল, কবিতার নতুন ধারা তৈরি করার। কবি হিসাবে পরিচিত লতিফ মাহমুদ নিজস্ব ভাবনায় আবিষ্কার করলেন এক বিশেষ ধারার কবিতা। নামকরণ করলেন,‘বর্ণালীকবিতা’। তিনি দাবি করেন, এই উদ্ভাবন বা লেখার ধরন আগে কেউ বের করেননি। সেই হিসেবে তিনি বর্ণালির কতিার ‘জনক’ দাবি করেন।তাঁর প্রত্যাশা, কবিতার এই নতুন ধারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়–ক, ব্যাপক গবেষণা হোক, গ্রন্থাকারে প্রকাশ হোক এবং অন্যান্য কবিরা যেন তা আয়ত্ত্ব করে।
বর্ণালী কবিতা কী?
কবিতা রচনায় প্রথম চরণ থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে চরণ শুরু করে ও প্রথম থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে রচিত কবিতাকে ‘বর্ণালী কবিতা’ বলা হয়। বর্ণমালার প্রকারভেদ হিসেবে বাংলা বর্ণমালা পঞ্চাশটি। বর্ণগুলো দুই ভাগে বিভক্ত।(১) স্বরবর্ণ: এগারটি, (২) ব্যঞ্জনবর্ণ: উনচল্লিশটি।
বর্ণালী কবিতায় বর্ণকে আবার দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) বর্ণালী বান্ধব বর্ণ, (২) উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ। বর্ণালী বান্ধব বর্ণগুলো হল- অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ। অর্থাৎবাংলা বর্ণের এগারটি স্বরবর্ণই ‘বর্ণালী বান্ধব স্বরবর্ণ’। অপরদিকে, ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, স, হ এই ঊনত্রিশটি ব্যঞ্জণবর্ণ হল‘বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’। এগারটি স্বরবর্ণ ও উনত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ, মোট চল্লিশটি বর্ণকে একত্রে‘বর্ণালী বান্ধব’ বর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
‘বর্ণালী বান্ধব’ চল্লিশটি বর্ণ ব্যতিত বাকি দশটি বর্ণকে ‘উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলা ব্যাকরণ মতে, ঙ, ঞ, ণ অনুনাসিক বর্ণ; ড়, ঢ়, দন্তমূলীয় বর্ণ; য় দন্তৌষ্টব্য বর্ণ; ৎ, ং, ঃ, ঁ পরাশ্রয়ী বর্ণ। এই বর্ণগুলোর বৈশিষ্ট্য- এরা কখনও শব্দের প্রথমে বসে না এবং শব্দের প্রথমে আছে এমন শব্দ নেই। আবার এসব বর্ণ ছাড়া শব্দ গঠন করা যায়না অনেক সময়। তাই ঙ, ঞ, ণ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ এই দশটি বর্ণকে ‘উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’ বলা হয়।
বর্ণালী কবিতার প্রকারভেদ
লতিফ মাহমুদ তাঁর উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং নিজস্বভাবে নামকরণ করেছেন। যথা- (১) স্বর্ণা, (২) বর্ণা, (৩) শ্রাবণী। এসব কবিতার রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও লিখন পদ্ধতি।
কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ-অ, আ, ই, ঈ, উ. ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ বর্ণালী বান্ধব স্বরবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে রচিতএগার চরণের কবিতা হল‘স্বর্ণা কবিতা’।কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে উনত্রিশ চরণের কবিতা ‘বর্ণা কবিতা’। কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ- অ, আ, ই, ঈ, উ. ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে শেষ হওয়ার পর প্রথম চরণ থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে চল্লিশ চরণের কবিতা ‘শ্রাবণী কবিতা’।বিষয় আঙ্গিকে সহসাধ্য মনে হলেও এমন মিলবিন্যাস নিয়ে কবিতা লেখা বড়ই কষ্টকর। কষ্টের পথ পরিহার করতে কবিরা এসব পথে হাটেননি বলে হয়ত অদ্যাবধি এভাবে কেউই কবিতা লেখেননি।
‘বর্ণালী কবিতা’র প্রয়োগ
একাদশ চরণের- ‘স্বর্ণা কবিতা’
‘রাজনীতিবিদ’
অ- অল্পে তুষ্ট, কর্মে সুষ্ঠ,
আ-আদর্শ-রাগ, অনুরাগপুষ্ট।
ই- ইতিবৃত্ত মুখস্থ, আম জনতার,
ঈ- ঈশ্বর ভীরু, নয় কারও গুরু,
উ- উগ্রমূর্তি হয়না কভু।
ঊ- উর্বর মস্তিস্ক, বাচ-বিচার সুক্ষ,
ঋ- ঋষিতুল্য স্বভাব, প্রশ্নের জবাব,
এ- একত্বের করে না প্রকাশ বিকাশ।
ঐ- ঐকান্তিক আগ্রহে গণকথা শুনে,
ও- ওষ্ঠের হাসি, মিলায়না ক্ষণে।
ঔ- ঔপপত্তিকভাবে রাজনীতিবিদ গণনে।
ঊনত্রিশ চরণের ‘বর্ণা কবিতা’
‘ফেলে আসা দিনগুলি’
ক- কানাকুয়া ধরতে গেছি, মাকে দিয়ে ফাঁকি,
খ- খুঁজে পায়নি মা আমায়, করেছে ডাকাডাকি।
গ- গরু, ছাগল চড়িয়েছি, কৃষাণ সাজন সেজে,
ঘ- ঘুঘু ধরতে ঘুরেছি, ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে।
চ-চলনবিলে মাছ ধরেছি, জাল, পলো দিয়ে,
ছ-ছোট বড়ো যত মাছ, আনতে পারিনি বয়ে।
জ-জাম পেরেছি গাছে চড়ে, খেয়েছি পেট পুরে,
ঝ-ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে, এনেছি ডালা ভরে।
ট-টক খেয়েছি চটকিয়ে, লবন মরিচ দিয়ে,
ঠ-ঠাট্টা করে বলতো দাদী, খাসনে গপ-গপিয়ে।
ড-ডাক পড়েছে লেখাপড়ার, সকাল সন্ধ্যা বেলা,
ঢ-ঢং ঢং বাজলে ঘন্টা, ইস্কুলের পথে চলা।
ত-তাল পাতাতে লিখেছি, কঞ্চির কলম দিয়ে,
থ-থইথই আনন্দ পেয়েছি, মা-বাবাকে দেখিয়ে।
দ-দুষ্টুমি করেছি কত, হয়না বলে শেষ,
ধ- ধমক দিত পিতামাতা, তবু কাটেনি রেশ।
ন- নাটোরকে লাটোর বলা, তরকারীকে বেসতি,
প- পান খেয়ে মুখ রাঙিয়ে, করেছি কতো ফুর্তি।
ফ- ফন্দিফিকির কাকে বলে, জানিনি তার ধরণ,
ব- বাবার কাছে জানতে চেয়েছি, কিবা তার গড়ন,
ভ- ভূতের ভয় কেন করে, একা থাকি যখন,
ম- মধু খেতে চাক ভেংগেছি, মউয়ালের মতন।
য- যাদু দেখে চেয়েছি হতে, যাদুবিদ্যা জানতা,
র- রাক্ষসের গল্প শুনে, মুখটা হয়েছে নোনতা।
ল- লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখি, গল্প কবিতা পড়ে,
শ- শোভন, সাজন, অলংকরণ, পঞ্চ কবির ঠাঁরে,
ষ- ষড়রিপুর শাসন, বাঁধন, শোক্ত পোক্ত করে।
স- সাংবাদিকতা লেখালেখি, বাবার কাছে হাতেখড়ি,
হ- হাতছানি দেয় অতীত আমায়, বাবাকে মনে করি।
চল্লিশ চরণের ‘শ্রাবণী কবিতা’
চলনবিল
অ- অনাবিল পদ্মার জলে, চলনের চলন,
আ-আয়তনে সমুদ্র, গতি, প্রকৃতিতে নদী,
ই- ইন্দ্রিরা রুপে, বয়ে যায় নিরবধি।
ঈ- ঈশানের আত্রাই-গুড়নই ধারায়,
উ- উত্তর-দক্ষিণে বেড়ে যায় সীমা।
ঊ- র্ঊর্মি মালার নাচন, আছে সারাক্ষণ,
ঋ- ঋষি বলে শস্য ভান্ডার, মৎস আশ্রম।
এ- এঁটেল মাটির গড়া ঘর-বাড়ী,
ঐ- ঐ উদয় অস্ত তারা সারি সারি,
ও- ওখানে বসবাসে, নির্মল নিঃশ্বাস,
ঔ- ঔষধ,পথ্য, চিকিৎসা দুষ্প্রাপ্য।
ক- কৈ, শিং, মাগুড়, পাখি তিলে চলনবিল,
খ- খাবারের প্রয়োজনে, করি, বোরো চাষ,
গ- গুলতি, বন্দুক বিষে, নেই, পাখির নিবাস।
ঘ- ঘাসী দেওয়ানের মাজার, চলনবিলে,
চ-চলে শিরণী-মানত, চৈতি চাঁদে মেলা,
ছ-ছুটে আসে সব বয়সী, ধর্ম, বর্ণ ভুলে।
জ-জলা-জলে জড়াজড়ি, চলনের জীবন,
ঝ-ঝরা, খরা নিত্য সাথী, রাস্তা ছাড়া হাটন,
ট-টুস-ঠাস করে, চোর ডাকাতের চরণ,
ঠ-ঠুটো হয়ে গোনা-গাঁথা চলনীর স্বপন।
ড-ডাস চোষে গরু, মোষ মানুষের রক্ত,
ঢ-ঢেউয়ে ভাংগে ঘরবাড়ী, হই উদ্ববাস্ত,
ত-তেড়ি হয়ে নেড়ী ঝড়, গিলে খেতে ব্যস্ত।
থ-থরথর কাঁপে বুক, বিল পারাপার হতে,
দ-দেউড়িতে দাঁড়িয়ে, প্রিয়জন থাকে চেয়ে,
ন-নয় গাঁয়ে যত চাষী, ধান পেতে মুঠিমুঠি,
প-পানি পেতে বোরো সেচে, ফাল্গুন-চৈত্রে,
ফ-ফেলে মাটি পুঁতে খুটি, দিয়ে বেটন-বেড়া,
ব-বাঁধে বাঁধ গুড়নইএ, চলনের কৃষাণেরা।
ভ-ভরা ক্ষেত ডুবে যায়, আটকায় দম,
ম- মোল্লার রণা, ফকিরপাড়া জলা সাক্ষাৎ যম,
য-যায় ভেসে সেথা দিয়ে, কত পাকা ধান।
র-রক্ষক রক্ষনাবেক্ষণে, চলনের তেল গ্যাস,
ল-লক্ষ্যচ্যুত পেট্রোবাংলা করে না বিশ্বাস,
শ-শহরবাড়ীর স্মৃতি অম্লান, ফেলি নিঃশ্বাস।
ষ-ষোলকলা পূর্ণ করি, কর চলনের উন্নয়ন,
স-সহজ যাতায়াতে পাকা রাস্তা প্রয়োজন,
হ-হর্তাকর্তা-বিধাতা, কর আজি বাস্তবায়ন।
পরিশেষ
কবিতার মিলবিন্যাস হয়ে থাকে শেষ চরণে। লতিফ মাহমুদের পদ্ধতিটি গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্নতর মনে হয়েছে। তার নমুনা কবিতা থেকে আমরা দেখলাম, কবিতাগুলো রচনার ক্ষেত্রে তিনি শেষ চরণে যেমন অন্তমিল রেখেছেন, তেমনি চরণের প্রথমে বর্ণানুক্রমিকতা ধরে রেখেছেন।
লতিফ মাহমুদ প্রায় দুই শত ‘বর্ণালী কবিতা’ লিখেছেন। এ সর্ম্পকিত তার কোনো বই নেই। শুধু লিফলেট আকারে বিভিন্ন সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে বিতরণ করেন। তাদেরকে তার পদ্ধতি মেনে কবিতা লিখতে আহ্বান করেন। আমার এ প্রবন্ধের আলোকে সুসাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান, লতিফ মাহমুদের ‘বর্ণলী কবিতা’ নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, কিংবা এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু প্রগাঢ়, এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। আমি মনে, কবিতা ও কবিদের প্রতি আমাদের অনুধাবনমুলক দৃষ্টিভঙ্গি কাব্যসাহিত্যের জন্য মঙ্গলজনক হবে।