অনিকেত নন্দনে
আহাদ আদনান
মাঝরাত, ঘুমিয়ে আছি মরার মত। জন্মদিনের সারাটা সন্ধ্যা হৈচৈ শেষে গা এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়। হঠাৎ গন্ধে ঘুম ভেঙে যায়। একটা ফুলের গন্ধ। নাকি কোন পারফিউম? কেও ঢুকেছে ঘরে? খুব মিহি আর মিষ্টি, কিন্তু একেবারে অপরিচিত গন্ধটা আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে। ঘরে নানা রকম উপহার। সবচেয়ে সুন্দর উপহার ছিল কিছু শোপিস। শুধুমাত্র কাগজের তৈরি শোপিস। পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা ছেলেটার হাতে বানানো শোপিস। কাগজের ফুল থেকে আসা গন্ধ ঘুম থেকে জাগিয়ে সারারাত ঘোরের মধ্যে একটা ভালোলাগা অনুভূতি জড়িয়ে অবাক করে দিতে পারে, আগে বুঝিনি।
‘এই, আপনার কাগজে কোন পারফিউম ব্যাবহার করেন’?
‘নাহ। কেন বলুনতো, সুমি’?
‘কাগজ দিয়ে এত কিছু বানানো যায় জানতাম না। আমাকে শেখাবেন’?
বিকেল বেলা। ছাদে আমরা দুজন। ছেলেটার হাত ভরতি কাগজ। আমি শ্বাস নিচ্ছি টেনে টেনে। কোন গন্ধতো পাচ্ছি না। আঙ্গুলের কারসাজিতে কাগজ ধীরে ধীরে ফুল হতে থাকে। ফুলটা আমার চেনা মনে হচ্ছেনা। আর তখনই সেই গন্ধ। মিহি, মিষ্টি কিন্তু অচেনা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকে ফুলের দিকে, আঙ্গুলের দিকে। তারপর চোখের দিকে।
‘তুমি গন্ধটা পাচ্ছ না’?
আমি খেয়াল করার আগেই ‘আপনি’ ‘তুমি’ হয়ে গেছে।
ছেলেটা কিছু না বলে মুচকি হেসে উঠে যায়।
‘এই তুমি বললে না, এটা কিসের গন্ধ? এটা কি ফুল’?
‘রডোডেনড্রোন’।
দিন যায়, আর আমি রডোডেনড্রোনের নন্দনে হারাতে থাকি। ঘর, পড়ালেখা, চলাফেরা, ভালোলাগা, অভিমান সেই অবাক গন্ধে ভাসতে থাকে। সেই ফুলগুলো আমার ষষ্ঠ মৌলিক চাহিদা। বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যাবে, এই ফুল ছাড়া।
কয়েকমাস পরের কথা। আমাদের বিয়ে ঠিক, এমন একসময় একটা দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দেয়। ছেলেটা তখন না ফেরার দেশে। আমার ঘুম নেই, খাওয়া দাওয়া নেই। শুকিয়ে আমসত্ত্ব হয়ে গেছি। আমি, অথবা আমরা, গর্ভে আরেকজন নিয়ে তো ‘আমি’ ‘আমরা’ হয়ে গেছি, কি মারা যাচ্ছি?
যখন জ্ঞান আসে দেখি আমি একটা অপারেশন টেবিলে। আমাকে বাঁচানোর জন্য নাকি আমার ভেতরের মৃত আরেকটা আত্মজা বের করতে হচ্ছে। ট্রেতে একটা দলা পাকানো কি যেন রাখলেন চিকিৎসক।
‘মা মনে হয় বেঁচে যাবে। সিস্টার, একটা গন্ধ পাচ্ছেন? ওটি’তে ফুল আনলো কে দেখুনতো’?
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমার চোখে জল এসে যায়। বাকিটা জীবন আমাকে এই রডোডেনড্রোনের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে হবে হয়ত।
মাতুয়াইল, ঢাকা।