ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৪



অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
৮.
সত্যিই জায়গাটা মুগ্ধ হবার মতো। বিরাট জলাশয়। তাতে টলটলে জল। জলে তেলাপিয়া মাছ ভেসে থাকে। মানুষের সাড়া পেলে ঝুপ করে শব্দ তুলে একযোগে ডুব দেয়। সেই জলের ওপর রিসোর্ট। ঘরগুলো আলাদা আলাদা, যেন অনেকগুলো নৌকা ভাসছে। ঘরগুলো কাঠের। প্রতিটা ঘর সুন্দর করে সাজানো। ঝকঝকে, তকতকে বিছানা, বালিশ। ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফাসেট, স্যাটেলাইট সংযোগসহ টিভি, সিডি প্লেয়ার এবং রকিং চেয়ার।
চব্বিশ ঘন্টা মানে এক রাত এক দিন। এই সময়টার জন্য তূর্য রুম ভাড়া করে ফেললো। তারা জানে, রাত তারা থাকতে পারবে না। তারপরও এই সময়ের জন্যই ভাড়া করতে হল, কারণ প্যাকেজ টাইম এটাই, এর কম সময়ের জন্য ভাড়া করা যায় না। সে খুব খুশি। বলল, যতক্ষণ থাকব এখানেই কাটাবো, বাইরে কোথাও যাব না।
ঠিক আছে, তাই হবে।
ঘরে বসে দু’জন গল্প করব, বাইরে বেরিয়ে জালের ওপর পাটাতনে হাঁটব, জলে হাত-পা ভিজিয়ে আনন্দ করব, পাখির গান শুনব, তোমার গানও শুনব।
সেই প্রথম সে তূর্যকে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। বলেই সে জিহ্বায় কামড় দিল, হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
তূর্য বলল, ঠিকই তো আছে। আমি এটাই চাচ্ছিলাম।
খাবার খেতেও বাইরে যাব না। অর্ডার করে এখানে খাবার আনাবে।
তুমি যেমন চাও তেমনই হবে।
দুপুরে খাবার আগে দু’জন জলের ওপর পাটাতনে হাঁটছিল। পাটাতনের ওপর বসে গল্প করছিল। গল্প করতে করতে তূর্য গান শোনলো। আবৃত্তি শোনালো। এক পর্যায়ে তাদের মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে মজা করতে লাগলো। মজা করতে করতে সে তূর্যের জামাটা একেবারেই ভিজিয়ে দিল। তূর্যও ছেড়ে কথা বলল না। তাকে একেবারে না ভেজালেও আধভেজা করে দিল।
বাড়তি কাপড় তো কেউই নেয়নি। ঘরে গিয়ে তূর্যের জামাটা সে টেনে খুলে ফেলল। বলল, ভেজা জামা পরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
তূর্য বলল, তোমারও তো ঠান্ডা লাগতে পারে। তোমারও জামা খুলে ফেলা উচিত।
ফাজলামো করবে না বলছি।
দুপুরে খাওয়ার পর তারা পাশাপাশি বসে টিভি দেখছিল। টিভি দেখতে দেখতে খুনসুটি করছিল। টিভিতে চলছিল এইচবিও চ্যানেল। তাতে দেখাচ্ছিল দ্যা পিয়ানো ছবিটি। হার্ভে ক্যাটেল আর হলি হান্টারের দীর্ঘ চুম্বন দৃশ্য তাদের মনকে কাঁপিয়ে দিল, শরীরকে জাগিয়ে দিল। তারা কেউ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। এরকম অবস্থায় বোধহয় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়ও না।
সে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, কিছুতেই ভার্জিনিটি হারাবে না। বলা যায়, নিজের কাছে সে প্রমিজ করে রেখেছিল। কিন্তু নিজের কাছে করা প্রমিজ সে রক্ষা করতে পারল না। আসলে এক পর্যায়ে প্রমিজের কথা তার মনেও থাকে না।
যখন শরীর একেবারে চাহিদা শূন্য-নিস্তেজ তখন সে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ঘরের দরজা খুলে একাকি কাঠের পাটাতন বেয়ে মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে ঠিক লেকের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল, সে ভুল করেছে কি না। কোনো দোষ করেছে কি না। ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল তাদের ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল শান্ত মেয়ে শান্তার কথা। শান্তা বলেছিল, হ্যাঁ হয়েছে, তিনি আমার টিচার। ব্রিলিয়ান্ট পার্সন। সুদর্শন পুরুষ। তার প্রতি আমার আবেগ থাকা অসম্ভব নয়। আমার প্রতিও বিশেষ মুহূর্তে তার আবেগ জাগতে পারে। বিশেষ আবেগময় মুহূর্তে আমরা কাছাকাছি এসেছিলাম। এরকম অবস্থায় যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে চাহিদা শূন্য মানুষ। আমি যা করেছি তাতে কার কী হয়েছে? কার বাপের ঘরে আগুন লেগেছে তাতে? আমি ব্রিলিয়ান্ট গার্ল। ক্লাশে আমি ফার্স্ট। লেখাপড়ার বাইরেও আমার মেধা আছে। এবার বিজ্ঞান মেলায় যে দলের প্রজেক্ট প্রথম হয়েছে আমি সে দলের দলনেতা। এবার আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যে স্কুলদল প্রথম হয়েছে, আমি সে দলের দলনেতা এবং প্রধান বক্তা। আমি আবৃত্তি করতে পারি। ছবি আঁকতে পারি। ছে! আমি কাঁটাহীন-গন্ধবিহীন গোলাপ হতে চাই না। আমি গন্ধ বিলাবো, কিছু কাঁটা থাকতেই পারে। কাঁটাসহই মানুষ আমাকে মাথায় তুলে নেবে। আর গন্ধ না থাকলে কাঁটা আছে কি না আছে সেটা কোনো বিষয় না, মানুষ সে ফুলকে কাছে টেনে নেবে না। ইতিহাস তাই বলে।
শান্তার কথাগুলো মনে করে সে অনেকটা শান্তি ও সান্ত¡না পেল। তবে কিছুটা অশান্তিও জাগল মনে এই ভেবে যে, সে গন্ধ বিলানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শান্তার মত অতোটা না হলেও ক্লাশে তার স্থান দশ জনের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন সে সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারপরই তার চোখে-মুখে অস্বাভাবিক দৃঢ়তা জেগে উঠল। সে নিজের মত বলে উঠল-আমি কি হতে পারি বা না পারি সেটা পরের কথা, আমিও কারও বাপের ঘরে আগুন দেইনি। তাকে আমি ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসার মানেই এই। আমি পারতাম না নিজেকে আগলে রাখতে। যে পারতো সে ভালোবাসা কি তা জানে না।
তূর্যও মনের দিক থেকে কিছুটা দমে গিয়েছিল। সে এমনটা চেয়েছিল না। এমন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েও সে আসেনি। কেমন করে কি হয়ে গেল সে তা বুঝতে পারেনি।
তূর্য তার একা থাকার মুহূর্তে সেখানে গেল না। তাকে সান্ত¡না সূচক কোনো কথাও বলল না। তার মনে কিছুটা অস্বস্তি ভাব।
ফেরার পথে গাড়িতে উঠে সব স্বাভাবিক।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। বাসায় ফিরেই ক্লান্ত শরীরটা সে বিছানায় এলিয়ে দিল। তখন মা এলেন তার ঘরে। বললেন, এত দেরি হল যে?
পরীক্ষা শেষ হবার পর বন্ধুদের সাথে একটু কথা বললাম। চা খেলাম।
পরীক্ষা কেমন হয়েছে ?
ভাল, তবে এখন প্রশ্ন দেখতে চেও না মা। ভেরি টায়ার্ড।
না না, আমি এখন প্রশ্ন দেখব না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর শোও।
না, একটু রেস্ট নিয়ে নেই। এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
ঠিক তখন তার ফোন বেজে উঠল। সে ফোনের দিকে এক পলক তাকিয়েই দেখল তূর্যের ফোন। তখনই বাবা এসে দাঁড়ালেন মায়ের পাশে। সে একবার বাবার মুখে, একবার মায়ের মুখে আর একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে মাকে বলল, আমাদের কোচিং-এর ইংলিশ টিচার ফোন করেছেন। কথা বলবে?
মা কল রিসিভ করে বললেন, হ্যালো।
ঠিকমতো বাসায় পৌছেছো তো ?
আমি সুমাইয়ার মা বলছি।
অ্যা! ও, স্লামালিকুম স্লামালিকুম।
অলাইকুম সালাম। ওর পরীক্ষা কেমন হয়েছে আজ?
পরীক্ষা! ও হ্যাঁ পরীক্ষা। এখনও তো খাতা চেক করিনি। তবে মনে হয় ভালই হয়েছে। আমি খাতা চেক করে পড়ে আপনাকে জানাবো।
ও লেখাপড়া কেমন করছে?
ভালোই তো, ইদানিং ও লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগি।
একটু খেয়াল রাখবেন। আমাদের একটাই সন্তান। ওকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।
সিওর সিওর।
একদিন বাসায় আসুন বেড়াতে-একটু চা খেয়ে যাবেন।
আসবো-আসবো একদিন।
মা ফোন রাখতেই বাবা বললেন, দেখলে, একেই বলে টিচার। আবার ফোন করে খবর নিচ্ছে ছাত্রী ঠিকমতো বাসায় পৌছেছে কি না। সাধেই বলে না-টিচার ইজ দ্যা বিল্ডার অব এ্যা নেশন।
সত্যিই খুব ভাল। কি সুন্দর করে কথা বললো!
আর তুমি তো আছো মেয়েকে চার্জ করার তালে। আজকালকার মা-গুলো স্বৈরাচারীর রূপ পেয়েছে-স্বৈরাচারী হুসাইন মুহাম্মদ এশাদের চেয়েও বেশি। আমাদের সময়ে এরকম ছিল না।
চার্জ করলাম কোথায় ?
শোন, মেয়ে আমার লেখাপড়া করতে করতে ক্লান্ত। এই ক’দিনে মেয়ে কিন্তু অনেক শুকিয়ে গেছে। তুমি ওর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ যতœ নিও।
খেতেই তো চায় না কিছু।
চাইবে না, তারপরও খাওয়াতে হবে। বেশি করে টাকা দিয়ে দিবে যাতে বাইরে ভাল খেতে পারে।
তারপর বাবা তার কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মা, আজ আর পড়ার দরকার নেই। দুইটা পরীক্ষা দিয়ে এসেছো, একটু রেস্ট নাও। তারপর উঠে খাও। তারপর ঘুমাতে যাও। না ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি ফেলে দিয়েছো। শোন, তোমার যা খেতে মনে চায় আমাকে বলবে। আমি ঠিক ঠিক এনে দেব। শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি মনে রাখবো তোমার চাওয়ার কথা।
ঠিক আছে বাবা।

৯.
পরীক্ষা একেবারে নিকটে চলে এসেছে। ঠিক দরজায় টোকা দিচ্ছে। বাবা বলেন, নকিং এ্যাট দ্যা ডোর।
কোচিং ক্লাশ বন্ধ হয়ে গেছে। তূর্যের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেছে। তার ফোন আসাও কমে গেছে। সে নিজে ফোন করলেও অনেক সময় তূর্যের ফোন বন্ধ পায়। 
তবে এ নিয়ে সে শঙ্কিত বা বিরক্ত নয়। মাঝে মাঝে একটু মন খারাপ হয় এই আর কি। এক্সামিনেশন ইজ নকিং এ্যাট দ্যা ডোর। এ সময় তূর্য নিশ্চয় তাকে বিরক্ত করতে চায় না-তার সময় নষ্ট করতে চায় না। সে নিজেও জানে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন একটু মন দিয়ে পড়া উচিত।
সে গিয়েছিল বইয়ের দোকানে। কলম, পেন্সিল, ইরেজার, সার্ফনার, স্কেল এরকম কিছু দরকারি জিনিস কিনতে।
প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রগুলো কেনা শেষ হলে তার মনে হল, কোচিং সেন্টারে একটু ঘুরে আসে। কোচিং সেন্টার বইয়ের দোকানের খুব কাছে। গেলে তূর্যের সাথে দেখা হবে নিশ্চয়। তাদের ক্লাশ বন্ধ হলেও অন্য সবার ক্লাশ তো চলছে। কতদিন তার সাথে দেখা হয় না! পরীক্ষার আগে তো আর দেখা হবেও না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল এরকম। এমন সময় তাকে চমকে দিয়ে কে যেন বলল, তুমি এখানে?
সে সচকিত হয়ে দেখল, পাশেই তূর্য দাঁড়িয়ে। আনন্দে নেচে উঠল তার মন। খুশিতে ঝলমল করে উঠল তার মুখ। এ যে রোদ না চাইতেই সূর্য। ভাত না চাইতেই পোলাও। সে বলল, তোমার সাথে দেখা করতে কোচিং-এ যাব ভাবছিলাম।
আচ্ছা, চলো কোথাও বসি।
না না, এখন বসতে পারবো না।
বসতে পারবে না মানে? কি এত তাড়া তোমার?
প্রশ্ন দু’টির মধ্যে সে কঠিনতার ছোঁয়া পেল। কন্ঠটা কেমন নিরস। সেও কিছুটা কঠিন কন্ঠে বলল, কিসের তাড়া বোঝ না? পরীক্ষার আর ক’দিন আছে?
হয়েছে, ঘোরাঘুরি করতে সময় নষ্ট হয় না। আমি একটু বসতে বললাম আর........।
ঘোরাঘুরি করছি!
সে ঘুরতে বের হয়নি। সত্যিই সে একান্ত দরকারে বের হয়েছে। তূর্যের এরকম আচরণে সে সত্যিই খুব অবাক হল। দুঃখে ভরে গেল তার মন। কিন্তু চরম দুঃখ এল আরও একটু পর। তূর্য বলল, কার জন্য অপেক্ষা করছিলে?
তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
না বোঝার কি আছে? কারও জন্য অপেক্ষা করছিলে নিশ্চয়?
তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
হ্যাঁ করছি, প্রথম থেকেই তোমাকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল।
কেন?
সত্যি বলতে কি, তোমার আচরণ আমার ভাল লাগে না। সন্দেহজনক মনে হয়।
কিন্তু কেন ?
ফয়সালের সাথে তোমার এতটা লদকালদকি আমার ভাল লাগছিল না।
ফয়সালের সাথে.............! সে আমার ক্লাশমেট। জাস্ট ফ্রেন্ড। তুমি ওকে জড়িয়ে আমাকে সন্দেহ করতে? এত ছোট মন তোমার? আমি এত নিচে নেমে যাইনি যে, ক্লাশ টেনের একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে যাব। আর দুই/তিন বছর পরই আমি ইচ্ছে করলে বিয়ে করতে পারি। এ বয়সেও তো অনেক মেয়ের বিয়ে হয় এই দেশে। কিন্তু ফয়সাল তা পারে না। মনটা উচু ছিল বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। হ্যাঁ, আমিও তার প্রেমের কাঙাল ছিলাম তা ঠিক। এখন আমার ভুল ভেঙেছে। ক্লাশ টেনের ছেলে ফয়সালের মন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের চেয়ে অনেক উন্নত। উন্নত এই জন্য যে, সে আমার খুব কাছের বন্ধু হয়েও আমাকে প্রেম প্রস্তাব দেয়নি।
আসলে তোমাকে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তুমি সবার সাথে এত ফ্রিলি কথা বলো যে....।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে বিশ্বাস করো না। আমাকে বিশ্বাস করার জন্য আমি তোমার পায়ে ধরতে যাচ্ছি না।
অতো দেমাগ দেখিও না। কী আছে তোমার?
যা আছে তা তো কুকুরের মতো খুবলে খেয়েছোই। তারপরও আমার কি আছে তা তোমাকে দেখানোর দায় পড়েনি আমার। তুমি কি দেখেছিলে আমার ভেতর সে প্রশ্নও আমি করতে পারি। কিন্তু তা করবো না। চলে যাও আমার সামনে থেকে।
রাগ করো কেন? চলো কোথাও বসি।
তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। আমি তোমাকে আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারছি না।
যদি না যাই ?
আমি লোক জরো করবো। লোক জরো করে তোমাকে গণধোলাই খাওয়াবো। আমার চোখের সামনে জনগণ তোমার হাড়-মাংস সব এক করে ফেললেও আমার এতটুকু খারাপ লাগবে না।
শোন, শান্ত হও।
তুমি আমার সামনে থেকে চালে যাও বলছি। গেট লস্ট। গেট লস্ট।
ততক্ষণে লোক জমে গেছে। দ’ু/একজন এগিয়ে এসে বলতে শুরু করেছে-কী সমস্য? কী সমস্যা আমাদের বলুন? হ্যালো ভাই, আপনে তার সাথে ঝামেলা করতেছেন ক্যান? রাস্তাঘাটে মাইয়া মাইনসের সাথে ঝামেলা করেন, ব্যাপার   কী ?
সে লোকজনকে নিরস্ত করে বলল, ভাই, এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার।
একজন বলল, পার্সোনাল বুঝলাম। দরকার হইলে ডাইকেন। ব্যাটারে বুঝায়া দিমু কত গমে কত আটা, কত আটায় কত রুটি। কত আখে কত গুড়, কত গুড়ে কত শরবত।
আসলে তেজপাতা আর কাঁঠাল পাতার একটা হিসাব তূর্যের কাছেও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইয়ার নিচের স্বপ্নার সাথে তার কলেজ জীবন থেকে সম্পর্ক। শারীরিক সৌন্দর্যে স্বপ্না তার থেকে কিছুটা পিছিয়ে। কিন্তু এগিয়ে অন্য সব দিকে। স্বপ্নার একাডেমিক রেজাল্ট খুবই ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু থেকেই সে ভাল করছে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সে অন্যদিকেও ভাল। ভাল ছবি আঁকে। আবৃত্তি করে। আর বই পড়া তো তার নেশা। রাজ্যের বই গোগ্রাসে গিলে। বই পড়ার চেয়ে ভাল অভ্যাস পৃথিবীতে আর কি হতে পারে ? ফ্রানৎস কাফকা স্বপ্নার প্রিয় লেখক। আর সে সারা জীবনে কোনোদিন ফ্রানৎস কাফকার নাম জানবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায় স্বপ্নার উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যত আছে। সম্মানজনক ক্যারিয়ার হবে তার।
আর সে? সে পড়াশোনায় যে কোথায় নেমে গেছে তা তো তূর্য খুব ভালোই জানে। যে পাস্ট টেন্স বোঝে না, কী যে তার এস.এস.সি’র রেজাল্ট হবে তা তূর্যের জানা। এই রূপ-সৌন্দর্য কি সারা জীবন থাকবে? তূর্যের মনে পড়ল লাল সালু উপন্যাসের মজিদের একটা কথা-মানুষের রূপ কয় দিনের?
জীবন কোনো পদ্ম পাতার শিশির নয়। জীবন অনেক বড়। জীবন অনেক মূল্যবান। এই দীর্ঘ ও মূল্যবান জীবনে সে এমন একজন পার্টনার চায়, যে তার ক্যারিয়ারকে গড়তে সাহায্য করবে। যার জন্য তার নিজের কিছুই করতে হবে না, কিন্তু পাবে অনেক কিছু। ভবিষ্যত সন্তান-সন্তাদির ব্যাপারও তো আছে। শিক্ষিত মা শিক্ষিত জাতি গঠন করে। উচ্চ শিক্ষিত মা নিশ্চয় উচ্চ শিক্ষিত জাতি গঠন করে। স্বপ্না যে উচ্চ শিক্ষিত মা হবে তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
রাত নয়টা। দরজা ভেজানো। সে খাটের উপর বসেছিল হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে। তার মুখ দেখার উপায় ছিল না। তাই তার মুখের অভিব্যক্তি পড়া যাচ্ছিল না। সেখানে ঘৃণা অথবা ক্রোধ ছিল। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র বলেই সে তূর্যের বশ্যতা স্বীকার করেছিল তা নয়। সে সত্যিকারে প্রেম নিয়েও গিয়েছিল। সেই প্রেমকে তূর্য এইভাবে পায়ে পিষে মারল!
সেলফোনটা পাশে নামানো ছিল। বেজে উঠল তার স্বরে। সে মাথা তুলল। মাথা তুলতেই রেশমি চুলের গুচ্ছ ঢেকে দিল তার মুখ। সে বাঁ হাতে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে তাকাল ফোনের দিকে। বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তার মন। সে ফোন হাতে তুলে নিল না। কল রিসিভ করল না। ফোন বাজতে বাজতে থেমে গেল।
মুহূর্তকাল পরে আবার বেজে উঠল। বাজতে থাকল। তখন মা এলেন দরজার পাশে। বললেন, ফোন বাজছে শুনতে পাচ্ছো না? রিসিভ করছো না কেন?
মা ফোন রিসিভ করলেন। ওপাড় থেকে কন্ঠ ভেসে এল-ফোন ধরছো না কেন?
আমি সুমাইয়ার মা বলছি।
ও স্লামালিকুম-স্লামালিকুম।
অলাইকুমসালাম।
আমি ওর ইংলিশ টিচার তূর্য।
আমি চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন আপনি?
জি ভালো। ও লেখাপড়া কেমন করছে?
করছে তো ভালই।
এখন ও কোথায় ?
কাছেই আছে, দিচ্ছি।
মা তার হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে চলে গেলেন। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে এসে পূর্বের স্থানে বসল। তূর্য বলল, ফোন ধরছো না কেন?
প্রয়োজন বোধ করছি না তাই।
এত রাগ তোমার ?
আমি চাইনি যে, আপনি আমাকে ফোন করুন।
আমি তা জানি। তাই আর কখনো ফোন করে তোমাকে বিরক্ত করব না। আজই শেষ। একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি।
আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছা আমার নেই।
আমি তাও জানি। তোমার ইচ্ছা না থাকলেও আমি বলবো আমার কথা। অনিচ্ছা নিয়েই তোমাকে শুনতে হবে।
বলুন।
তুমি নিশ্চয় ভাবছো-আমার যা পাওয়ার তা পেয়ে গেছি, তাই চলে যাচ্ছি। স্বার্থ হাসিল করে আমি চলে যাচ্ছি। বাস্তবিক ব্যাপারটা তা নয়। সেদিন যা হয়েছে তা আমাদের অজান্তেই হয়েছে। তুমি চাইলেই স্মরণ করতে পারবে যে, আমি নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। নিজেকে সামলাতে পারোনি তুমি। তুমি হয়ে পড়েছিলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন। তোমার বয়স কম, সে সুযোগ আমি নেইনি। তুমি তোমার শরীরের দাবীর কাছে হেরে গিয়েছিলে।
কারণ আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার সাথেই শরীরের সম্পর্ক। আমি যতটা না শরীরের কাছে হেরে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি হেরে গিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার কাছে। এখন আসুন আমার কাছে, এসে দেখুন শরীরের কি দাবী। থুথু ছাড়া কিছু জুটবে না আপনার কপালে।
তুমি খুব সুন্দর কথা বলেছো। খুব যুক্তিসংগত কথা। তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমিও তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায়না। হয়তো আমি ছিলাম তোমার প্রথম প্রেম। তাই তুমি বেশি আবেগাক্রান্ত ছিলে।
কথাটা ঠিক না, আমি আপনার মোহাক্রান্ত হয়ে সত্যিকারে ভালোবাসাকে ছেড়ে এসেছিলাম। এটাই ছিল আমার ভুল। আমি একজনের সাথে যে ব্যবহার করেছি, আরেকজনের কাছ থেকে সেই ব্যবহার পেয়েছি। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। এর ইংরেজিটা যেন কি?
টিট ফর ট্যাট। আমার প্রিয় কবি ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদ বলেছেন-প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রেম বলে কোনো প্রেম নাই। সব প্রেমই প্রথম প্রেম। প্রতিটা প্রেমই সম্পূর্ণ নতুনত্ব নিয়ে জীবনে হাজির হয়। আমাকে তোমার যতটা ভাল লেগেছিল, তার চেয়ে অধিক ভাল যে আর কাউকে লাগবে না তা নয়। এখন হয়তো সেটা উপলব্ধি করতে পারবে না, যখন আসবে তখন বুঝবে। প্রেম আসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে।
আর কিছু বলার আছে ?
তাই বলছি-আমাকে ক্ষমা করতে না পারলেও ক্ষতি নেই। তুমি নতুন জীবন পথে এগিয়ে যাও।
আমি কারও কাছে উপদেশ চাইনি। গেট লস্ট।
ফোন কেটে দিয়ে সে আবার আগের মত হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে বসে রইল।
বেশ একটু পর আবার বেজে উঠল ফোন। এবার তার বিরক্তি চরমে পৌছুল। প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে ফোনটার দিকে তাকাতেই তার মুখে জেগে উঠল অনেকটা প্রশান্তির ছায়া। সে কল রিসিভ করে বলল, হ্যালো নিলয় ভাই, কেমন আছেন?
এত নরম কন্ঠ!
কেন, আমি বুঝি নরম কন্ঠে কথা বলতে পারি না?
পারো, নরম-মোলায়েম কন্ঠে আমার সঙ্গে অনেক দিন কথা বলেছোও। মাঝখানে বেশ কিছু দিন তো আমার সাথে নরম কন্ঠ ছিল না। আমার ফোন রিসিভ করেই স্যাঁৎ করে উঠতে-আপনি আবার ফোন করেছেন? আপনাকে না বলেছি, আমাকে ফোন করবেন না তারপরেও.......। আপনার একটু লজ্জা থাকা উচিত।
হি-হি-হি।
কত দিন পর তোমার হাসির শব্দ শুনলাম। কিন্তু হাসিটার মধ্যে একটু দুঃখ, কিছুটা রাগ, কিছুটা অপমান মেশানো যেন।
আপনি অনেক বুদ্ধিমান। মানুষের কন্ঠ থেকেই অনেক কিছু ধরে ফেলতে পারেন।
আমি কেমন বাপের ছেলে বোঝ না? সত্যি তোমার আগের হাসি থেকে এই হাসি কিছুটা ভিন্ন। ব্যাপারটা কি বলবে?
তেমন কিছু না।
কেচিং-এর সেই অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট টিচারের সাথে কি সব চুকেবুকে গেছে?
তাকে যা ভেবেছিলাম সে তা নয়।
তুমি যা ভেবেছিলে সে তাই।
মানে?
মানে সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, গুড টিচিার, অওনার অব এক্সট্রা মেরিট, সবই তার আছে।
সে একটা চিটার-প্রতারক-ক্রিমিনাল।
ভেতরের প্যাঁচটা আমি আগেই ধরেছিলাম।
কী ধরেছিলেন নিলয় ভাই ?
তোমার যেমন ত্যাজপাতা আর কাঁঠাল পাতার হিসাব আছে, তারও তেমন আছে নিশ্চয়। তুমি যেমন ত্যাজপাতা ফেলে কাঁঠাল পাতার কাছে গিয়েছিলে, সেও এখন নিশ্চয় আম পাতা, জাম পাতা কিছু একটা পেয়েছে। ঐসব টিচাররা প্রেম করার ব্যাপারে যতটা হ্যাডম, বিয়া করার ব্যাপারে তেমন না। বিয়া করার কথা বললেই ওরা কুঁইচ্যা মুরগীর মতো মোচরাইতে থাকবো।
কুঁইচ্যা মুরগী কি নিলয় ভাই?
এখন কুঁইচ্যা মুরগী চিনা লাভ নাই। আমি যা বলেছি তাই ঠিক।
আপনি সত্যিই খুব ব্রিলিয়ান্ট।
আমার ধারণা ভুল না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বন্ধুবান্ধদের দেখছি না?
বাদ দেন এসব কথা। আপনি ভাল আছেন তো?
এতদিন ভাল ছিলাম না। মনের মধ্যে একটা দুঃখ, পরাজয়ের ব্যথা বয়ে বেড়িয়েছি। এখন তোমার পুরনো কন্ঠ, পুরনো হাসি আমাকে অনেকটা ভাল করে দিল।
আপনি বেড়াতে আসুন না একদিন।
কতদিন পর আবার সেই আহ্বান! এই আহ্বান এড়ানো কঠিন। তবে এখন আসব না। তোমার পরীক্ষা খুবই নিকটে। নকিং এ্যাট দ্যা ডোর। পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর আসব।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে তার পরের দিনই চলে আসবেন। তখন তো আমার একেবারে ফ্রি টাইম। খুব মজা হবে।
আচ্ছা তাই আসব।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট