সূর্য গ্রহণ নিয়ে গ্রামীণ কুসংস্কার



সূর্য গ্রহণ নিয়ে গ্রামীণ কুসংস্কার
ওবায়দুল মুন্সী

সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে কত যে মিথ ছড়িয়ে আছে তা আমাকে এখনো ভাবায়। আমাদের হাওরাঞ্চলে সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের আঞ্চলিক নাম হচ্ছে ‘গন্না’। অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে এই গন্নার সময় কোনো কাজ বা খাওয়া-দাওয়া করতে নেই। কারণ-এই সময় এসব করলে নাকি অমঙ্গল হয়। গর্ভবতী মহিলাদের গ্রহণকালে সুপারি কাটা, মাছ কাটা একথায় কোনো কাটাকুটি করা যাবে না! এসময় কাটাকুটি করলে, তাদের সন্তানাদিও বিকলাঙ্গ হবে। এরকম কতো যে কুসংস্কার লোকেরা বিশ্বাস করতেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই ছিল না। গ্রহণ বিষয়ক কুসংস্কার সম্পর্কে যতো টুকু জানা যায়- আদি মানুষের কাছে গ্রহণ ব্যাপারটাই ছিল দেবতার অভিশাপ। গ্রহণ চলাকালিন সময়ে খাবার না খাওয়া, বাইরে বের না হওয়া, গর্তবতী মহিলাদের নানা নিয়ম-নীতি মেনে চলা। কিন্তু জানার ব্যাপার হচ্ছে-বিজ্ঞান এই বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ  কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস হিসাবে প্রমাণ করেছে। তবে যেটা হয়- সেটা হলো সমুদ্রে  জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন ঘটে।

চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে খুব ছোট করে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, পৃথিবী যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে তখন পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করে। আর পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে কোন মানুষের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরুপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। আর এই ঘটনাকে চন্দ্রগ্রহণ বলে

অধিকাংশ সময়ই আমাদের দেশের মানুষেরা অত্যন্ত আনন্দ আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহন এবং চন্দ্রগ্রহন প্রত্যক্ষ করে থাকে। অথচ বিষয়টি আনন্দের নয়, ভয় ও ক্ষমাপ্রার্থনার।

সূর্য ও চন্দ্র যখন গ্রহনের সময় হয় তখন আমাদের নবীর (সা.) চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেতো। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে নামাজেরমাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।

আরবীতে সূর্যগ্রহণকে ‘কুসূফ’ বলা হয়। আর সূর্যগ্রহণের নামাজকে ‘নামাজে কুসূফ’ বলা হয়।

দশম হিজরীতে যখন পবিত্র মদীনায় সূর্যগ্রহণ হয়, রাসূল (সা.) ঘোষণা দিয়ে লোকদেরকে নামাজের জন্য সমবেত করেছিলেন। তারপর সম্ভবত তার জীবনের সর্বাধিক দীর্ঘ নামাজের জামাতের ইমামতি করেছিলেন। সেই নামাজের কিয়াম, রুকু, সিজদাহ মোটকথা, প্রত্যেকটি রুকন সাধারণ অভ্যাসের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিলো।


অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা প্রথমে যখন মহানবীর (সা.) এ আমল সম্পর্কে জানতে পারলো, তখন তারা এটা নিয়ে বিদ্রুপ করলো (নাউযুবিল্লাহ)। তারা বললো, এ সময় এটা করার কি যৌক্তিকতা আছে?

সূর্যগ্রহণের সময় চন্দ্রটি পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে বলে সূর্যগ্রহণ হয়। ব্যাস এতটুকুই! এখানে কান্নাকাটি করার কি আছে? মজার বিষয় হল, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন এ বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হলো, তখন মহানবীর (সা.) এই আমলের তাৎপর্য বেরিয়ে আসলো।
আধুনিক সৌর বিজ্ঞানীদের মতে, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ দু’টি কক্ষপথের মধ্যবলয়ে রয়েছে এস্টিরয়ে (অংঃবৎড়রফ), মিটিওরিট (গবঃবড়ৎরঃব) ও উল্কাপিন্ড প্রভৃতি ভাসমান পাথরের এক সুবিশাল বেল্ট, এগুলোকে এককথায় গ্রহানুপুঞ্জ বলা হয়।

গ্রহানুপুঞ্জের এইবেল্ট (ইবষঃ) আবিষ্কৃত হয় ১৮০১ সালে। এক একটা ঝুলন্ত পাথরের ব্যাস ১২০ মাইল থেকে ৪৫০ মাইল। বিজ্ঞানীরা আজ পাথরের এই ঝুলন্ত বেল্ট নিয়ে শঙ্কিত। কখন জানি এ বেল্ট থেকে কোন পাথর নিক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে আঘাত হানে, যা পৃথিবীর জন্য ধ্বংসের কারণ হয় কিনা?

গ্রহানুপুঞ্জের পাথর খন্ডগুলোর মাঝে সংঘর্ষের ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরখন্ড প্রতিনিয়তই পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে জ¦লে ভস্ম হয়ে যায়। কিন্তু বৃহদাকার পাথর খন্ডগুলো যদি পৃথিবীতে আঘাত করে তাহলে কি হবে?

প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এমনই একটি পাথর আঘাত হেনেছিলো। এতে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর তাবৎ উদ্ভিদ লতা গুল্ম সব ধ্বংস হয়ে গিয়ে ছিলো। আপনজনের (অৎরুড়হ) এ যে উল্কাপিন্ড এসে পড়েছিলো তার কারণে পৃথিবীতে যে গর্ত হয়ে ছিলো তার গভীরতা ৬০০ ফুট এবং প্রস্থ ৩৮০০ ফুট।

বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণের সময় ঝুলন্ত পাথরগুলো পৃথিবীতে ছুটে এসে আঘাত হানার আশংকা বেশী থাকে। কারণ হচ্ছে, এসময় সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী একই সমান্তরালে, একই অক্ষ বরাবর থাকে। ফলে তিনটির মধ্যাকর্ষণ শক্তি একত্রিত হয়ে ত্রিশক্তিতে রুপান্তরিত হয়।

এমনি মুহূর্তে যদি কোন পাথর বেল্ট থেকে নিক্ষিপ্ত হয় তখন এই ত্রিশক্তির আকর্ষণের ফলে সেই পাথর প্রচন্ড শক্তিতে, প্রবল বেগে পৃথিবীর দিকে আসবে, এ প্রচন্ড শক্তি নিয়ে আসা পাথরটিকে প্রতিহত করা তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাড়াবে।

ফলে প্রথিবীর একমাত্র পরিণতি হবে ধ্বংস। একজন বিবেকবান মানুষ যদি মহাশূন্যের এ তত্ব জানে, তাহলে তার শঙ্কিত হবারই কথা।

এই দৃষ্টিকোন থেকে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় মহানবীর (সা.) সেজদারত হওয়া এবং সৃষ্টিকূলের জন্য পানাহ চাওয়ার মধ্যে আমরা একটি নিখুঁত বাস্তবতার সম্পর্ক খুঁজে পাই। মহানবীর (সা.) এ আমলটি ছিলো যুক্তিসঙ্গত ও একান্ত বিজ্ঞানসম্মত। তাই এটিকে উৎসব না বানিয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। আর নামাজ আদায় করুন।     

কবি ও প্রাবন্ধিক 
হাছননগর, সুনামগঞ্জ 


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট