নিভে যাওয়া দ্বীপ এবং একজন তাহমিনা
রাকিব ইমতিয়াজ
সন্ধ্যার আলো তখনও পুরোপুরি যায়নি। আবছা-আলো, আবছা-অন্ধকারে চারপাশ নিরবীত। দূরের ওই আকাশে তখন ক্ষাণিকটা লালছে ভাব ধরেছে। আর এই লালছে ভাব হওয়া কোনো এক সন্ধ্যায় শাহিন বলেছিলো, তুমি চাইলে ওই আকাশের সমস্ত লালছে রঙ্গ দিয়ে তোমার কপালে একটা লাল টিপ পড়িয়ে দিবো। এই কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পড়ে যায় তাহমিনার। শাহিন বিদেশ গিয়েছে আজ ৪ বছর। আর চার বছর একেকটা দিন তাহমিনা অপেক্ষা করছে শাহিনের জন্য। শাহিন তাহমিনাদের গাঁয়ের মেম্বার চাচার ছেলে। আর তাহমিনা সেই গাঁয়ের একজন দিন মজুর রহিম আলীর মেয়ে। লেখা পড়াও করেছে কিছুটা, বলা যায় সেই গাঁয়ের একমাত্র বাংলা পড়তে পারা মেয়েই হচ্ছে তাহমিনা। তাহমিনা সারাদিন নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখে মানুষের উপকারে। সারাটা দিন যায় কারো প্রেমিকের কাছে তার প্রেমিকার মনের কথা গুলো চিঠিতে লেখে, আবার কখনও রহমত চাচার বাড়ির দলিলগুলো পড়ে বুঝিয়ে দেওয়া কোনটা কোন ভিটের দলিল। কারন রহমত চাচা প্রায়ই ভুলে যায়, কোনটা তার কোন ভিটের দলিল। এইভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে সারাদিন পার করে তাহমিনা। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই আর কোনো ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে না। শাহিন চলে আসে তার কল্পনায়। অবশ্য সন্ধ্যায় তাহমিনার একটা বিশেষ কাজ হলো শাহিনের জন্য একটা করে রুমাল তৈরি করা। এই পর্যন্ত ১৬০ টা রুমাল তৈরি করা হয়ে গেছে তাহমিনার। আকাশের চাঁদটা যখন ঠিক মাঝখানে চলে আসে, তাহমিনা তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় চলে যায়। শাহিন বিদেশ যাওয়ার আগে একটা র্শাট তাহমিনাকে দিয়ে বলে গিয়েছিলো, তার কথা মনে যেনো এই র্শাট বুকের মাঝে চেপে ধরে রাখে। আর এই ৪ বছর প্রত্যেকটা রাত তাহমিনা শাহিনের র্শাটটাকে বুকে ধরেই বেঁচে ছিলো। সকাল হতেই ডাক পড়লো বাবার ।
-তাহমিনার মা, ও তাহমিনার মা।
-কি হইছে, এই সকাল বেলায় বাড়ি মাথায় তুলতেছো কেন?
-তাহমিনার একটা বিয়ার প্রস্তাব আসছে, খুব ভালা বংশের পোলা।
-কও কি!! এতো খুব ভালা খবর। পোলাডা কে ?
-আরে, আমগো রজিম মিয়ার ভাগিনা। শহরে থাকে। হুনছি শহরে তাঁগো বিরাট কারবার। বিয়ার পর তারা তাহমিনারেও শহরে লইয়া যাইবো। আমার মাইডা খুব সুখে থাকবো।
বাবার মার কথা শেষ, কিন্তু দরজার আড়ালে থেকে কোনো কিছু শুনতে ভুল করেনি তাহমিনা। হঠাৎ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো ।
-বাবা, আমি এই বিয়াতে রাজি নাই।
-কেন রে মা, পোলাডা তো খুব ভালা।
-আমি শাহিনরে ভালোবাসি, ও বলছে ও আমারে বিয়া করবো।
-কোন শাহিনের কতা কস তুঁই?
-মেম্বার চাচার পোলা।
-মারে, ওরা খুব মোটা টাকাওয়ালা, তোর মত গরিবের মাইয়ারে তারা ঘরের বউ করবো না।
-করবো বাবা, তুমি একটু আমারে সময় দাও, শাহিন বিদেশ থেকে আসুক।
-তুঁই আমগো একমাত্র মাইয়া, তোর ইচ্ছার বাইরে আমরা কোন কাজ করুম না।
৪ সপ্তাহ পর। সূর্য মধ্য আকাশে বিদ্যমান। তাহমিনা ঘরের মধ্যে, হঠাৎ ডাক এলো রুনার ।
-তাহমিনা, ও তাহমিনা।
-কিরে রুনা, সই তুই এই ভর দূপুর বেলা।
-তোর শাহিনের কথা শুনছোস।
-কেন? কি হইছে?
-কাল রাতে তো শাহিন বাড়ি আইছে।
ফুলের সুবাশে সুবাশিত একটি বাতাস এসে আলতো ভাবে ছুঁইয়ে গেলো তাহমিনার দেহে। মনের ভিতর হাজারটা সুখের ঢেউ এসে ধাক্কা দিতে লাগলো। ছুঁটতে শুরু করলো। শাহিনের বাড়ি। কিন্তু না পথেই দেখা হয়ে যায় শাহিনের সাথে। কিছু মিষ্টি কথায় শেষ হয়ে যায় তাদের আলাপ। কিছুদিন পর।
শাহিন হয়তো এখন ব্যস্ত। অনেক দিন পর দেশে আসছে, সবার সাথে দেখা করতেছে তাই হয়তো আমার সাথে দেখা করার সময় হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে তাহমিনা থমকে দাঁড়ায়।
-কিরে, রুনা, শাহিনগো বাড়িত কিসের গেইট?
-কেন, তুই হুনছ নাই।
-কি হইছে..
-শাহিনের বিয়া পরশু দিন।
এক মূহুর্তের জন্য সব থেমে যায় তাহমিনার। হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে, নিজের বাড়ির বিছানায়। তার হুঁশ ফিরে আসে কিন্তু তা কয়েক মিনিট পর নয়। পুরো ৩দিন পর, এতটা বছর যাকে নিজের ভিতর ধরে রেখেছিলো, তার বিষয়ে এমন কথা শুনতে হয়তো সব প্রেমিকারই এমন হয়। কিন্তু শাহিনের সাথে আর কথা বলা সম্ভব হয়নি তাহমিনার। কারণ ততক্ষনে সবশেষ, ততদিনে শাহিনের বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে ১ দিন। তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন শেষ। তাহমিনা নিজের স্বপ্নগুলোর ভাগ আর কাউকে দিতে চায় না। মাঝ রাতে নিভে যাওয়া দ্বীপের মত নিজেকেও নিভিয়ে দেয় তাহমিনা। আর কখনো পৃথিবীর আলো তাহমিনা দেখবে না। এই ভাবেই শেষ হয়ে যায় কোনো এক অঁজপাড়া গাঁয়ের সেই দূরন্ত তাহমিনার নিভে যাওয়ার গল্প। এবার একটু গল্পের বাইরের কথা বলি। গল্পের তাহমিনারা এতটাই সহজ-সরল হয় যে চোখ বন্ধ করে কাউকে ভালোবেসে ফেলতে পারে। কিন্তু বাস্তবের তাহমিনারা শুধু চোখের দেখা ভালোবাসায় বিশ্বাসী কিন্তু শত কিলোমিটার দূরের ভালোবাসা কখনো তারা দেখতে পায় না।