গহীনে আর্তনাদ



গহীনে আর্তনাদ
মিশির হাবিব 

গেটের সামনে একটা বাইশ বছুরে ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো অতিথি এলে প্রথমত জিজ্ঞেস করে- কে আপনি?
তরু সোজাসাপটা উত্তর দেয়- দারোয়ান। তারপরও অনেকে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে- দারোয়ানের কি নাম নেই!
তরু বলে- তরু। উত্তর শুনে অতিথি রেগে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেও প্রাপ্য ভেবে সে চুপ করে থাকে। পেশায় দারোয়ান হলেও পেশাদার দারোয়ানের মতো খাকি রঙের কোনো পোশাক নেই। বাসার মালিকের নির্দেশ, প্রচলিত দারোয়ানদের মতো কোনো পোশাক পরা চলবে না। ওর সাহেব দেশের নাম করা ব্যবসায়ী। তার নাম যে শুনেনি, তার ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা কুয়ার ব্যাঙের আকাশ দেখার সাথে তুলনাসই। অসম্ভব বড়লোক মানুষ। দশ বছর ধরে বাড়ি পাহারায় নিয়োজিত থেকেও তার ব্যবসা সম্পর্কে আঁচ করতে পারিনি তরু। জানার কথা নয়। প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো।
তবে মাঝেমধ্যে শহরের বড় বড় গুন্ডারা তার বাসায় আসে। অথিতিকক্ষে বসে খোশ গল্প করে। টাকা চাইলে দুই তিন বান্ডেল অনায়াসে দিয়ে দেন। দানবীর। দানের বেলায় কার্পণ্য নেই । অন্যদিন এসপি সাহেবও আসেন। তখন গুন্ডারা থাকে না। ভিন্ন উপায়ে খোশগল্প হয়। নিষেধ মতো তরু দারোয়ানের পোশাক পরে না। তার সাহেবের সম্মানে আঘাত লাগে। দেশের সবচে’ বড় ব্যবসায়ীর কয়েক কোটি টাকার বাড়ি। সেই বাড়ির দারোয়ান। অন্য সব দারোয়ানের সাথে তুলনা চলে না।

সাহেব একদিন দুপুরে হম্বিতম্বি করে ছুটতে ছুটতে গেটের দিকে আসলেন। দূর থেকে তরুকে দেখেই বললেন- ‘তরু! এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’

তরু দ্রুত পা চালিয়ে গেল বিশ্রামকক্ষের টেবিলে দিকে । কাঁচের গ্লাস ভালো করে সাতবার ধুয়ে পানি ভর্তি করে নিয়ে আসে। সাহেবের হাতে দিলো। তার চোখ টকটকে লাল। কপালের ভাঁজে ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেশ চিন্তিত। মানুষ হিসেবে উনি রগচটা। গ্লাস বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে তরুকে থাপ্পড় দিলেন। তরুর কলিজাটি এক মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে উনাকে পানি এনে দিয়ে পৃথিবীর মহত্তম কাজটি সে করেছে। তার উপহার সক্ষোভ থাপ্পড়। তরু অনুমান করেছে, উনি বেসামাল রাগান্বিত। এই থাপ্পড় অন্য কারো বাজেট ছিল। প্রকৃত প্রাপককে দিতে না পেরে ওর ঘাড়ে চাপালেন। হয়তো অন্যজন তার নাগালের বাইরে ছিল। তরু নাগালের খুব অনুগত । তাই দুর্বলের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে স্বস্তি অনুভব করেছেন। যার যা পাওনা তাকে বুঝিয়ে না দিয়ে অন্য জনের কাছে ঋণী হওয়া আপাত স্বস্তিকর হলেও শান্তিময় হয় না। তরু নির্বাক চোখে থাপ্পড়ের যন্ত্রণা অনুভব করল। মাত্র একটা থাপ্পড়, সসীম। বেদনার গভীরতা অসীম। ওর সমস্ত ভাবনাকে একীভূত করে দিল। মনের ভেতর যেখানে যত আনন্দ, খুঁজে খুঁজে সবটুকুতে শিকড় ছড়িয়ে বেদনা ঘিরে নিল। তাদের  দুজনের বর্তমান অবস্থান হয়তো উল্টো হতে পারতো। একজন মানুষ ওকে আঘাত করে স্বস্তি পেয়েছেন। সামান্য দারোয়ান, তবু সে মানুষের স্বস্তির কারণ- এই ভেবে নিজেকে শান্ত করে নিল । সাহেব এক নি:শ্বাসে পানি শেষ করবেন ভাবল তরু। তা না করে সাহেব বললেন-
‘পানি আনতে দেরি হলো কেন?’
তরু ভাঙাগলায় বলল- ‘ছার, গেলাসটা ভালা কইরা ধুইচি।’
-গ্লাস ধুতে এতো সময় লাগে?
-সাতবার ধুইচি, ছার। আগেরদিন পানি দেওনের সময় গেলাসে ময়লা আছিল। আফনে কইছিলেন, হেরপর থাইকা সাতবার ধুইতে।
-সাতবার না হলে চৌদ্দবার ধুইবি তবু যেন ময়লা না থাকে।
-জি, ছার।

সাহেব পানি খাবেন ভেবে মুখের কাছে নিয়েও গ্লাস ফিরিয়ে আনলেন।
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন-
‘পানিতে কি বিষ আছে? তোদের দিয়ে তো বিশ্বাস নেই, কখন কী করে ফেলিস। তুই হা করে একটু খেয়ে দেখা।’

তরু তার হুকুম মেনে হা করে। উনি প্রায় আধগ্লাস পানি ওর মুখে ঢেলে দিলেন। ঠোঁটে গ্লাসের দেয়াল স্পর্শ করেনি। সে গিলে খেয়ে তার দিকে লজ্জার চোখে তাকিয়ে থাকে। যুব দুটি চোখ হয়তো লজ্জা পেতে গিয়ে লজ্জা দিয়ে ফেলে। তরু মরেনি নিশ্চিত হয়ে সাহেব নিশ্চিন্তে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটানোর চেষ্টা করলেন। আধগ্লাস পানিতে তো দীর্ঘমেয়াদী তৃষ্ণা মেটে না। তরু মনে মনে হাসছিল। সামান্য এক গ্লাস স্বচ্ছ পানির ব্যাপারে যাকে বিশ্বাসের পরীক্ষা দিতে হয়, অথচ তারই কাছে কয়েক শো কোটি টাকার বাড়ি দেখাশুনার দায়িত্ব। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, মালিকের বুদ্ধি কতটুকু কার্যকর?
সাহেব টাই খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করেন-
‘পানি যে খাওয়ালি, কোথা থেকে এনেছিস?’
আরেকটি থাপ্পড় বরাদ্দ হচ্ছে ভেবে ভয়ে ভয়ে তরু বলে-
‘আমার রুম থাইকা।’
-কী! তোর রুম থেকে কেন?
সাহেব হয়তো ভাবেন না, পানি এবং গ্লাসে লেখা থাকে না যে কখন কে কতটুকু খাবে।পানির প্রকৃত মালিকই শুধু তা জানে।
ভাবনা চেপে রেখে তরু বলল-
‘ছার, কাছেপিছে তো পানি পাওন যাইব না। উপরে থাইকা আনতে মেলা সময় লাগব। আফনের তো মেলা তিরাশ। তাই নিয়া আইছি। হেরপর থাইকা উপ্রে থাইকা নিয়া আইব।’

সাহেব কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন।

মধ্যরাতে কী যেন একটা গণ্ডগোলের আওয়াজ পেয়ে তরুর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলিয়ে বালিশের কাছে সুইচ টিপে লাইট চালু করে সে। বাড়িতে লুটেরা ঢুকেছে ভেবে তড়িঘড়ি করে তিন পায়ে দৌড়াতে থাকে। হাতের মধ্যে একটি বন্দুক। লাইসেন্স করা। সাহেব সপ্তম তলায় থাকেন। তেরো তলা বাড়ির সপ্তম তলায় থাকলে উপর-নিচ দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধে হয়। সপ্তম তলার দরজা খোলাই ছিল। তরু সাহেবের শয়নকক্ষে ঢুকে দেখল, অনেক বড় ভীড়। সাহেব তার প্রিয় দামি সোফায় বসে নাকে-মুখে চিৎকার করছেন। কিছু সময় খেয়াল করে তরু ইতোমধ্যে কারণ খুঁজে পায়।
নিচ তলার ভাড়াটিয়া ব্যরিস্টারের সাথে সাহেবের দীর্ঘশত্রুতা। কর ফাঁকির মামলা নিয়ে বহুদিন ধরে তাকে হেনস্থা করে আসছে। আইনের লোক। কম কথা বলে বেশি টাকা নিবে। উনি কেন এত সাধুতা দেখাতে যান! সাহেব অনেক সাত-সত্তর  বুঝিয়েছেন। ব্যরিস্টার যদি বুদ্ধিমান হতেন, তাকে তো অন্যের বাসায় ভাড়াটিয়া বনতে হয় না। নিজেরই ওমন কয়েকটি বাড়ি থাকতো। কোটি কোটি বুঝিয়েও সাহেব ব্যরিস্টারকে টাকায় নাক ডুবিয়ে কাবু করতে পারলেন না। সবশেষে ব্যরিস্টারের ক্লাস থ্রী পড়–য়া মেয়েকে হত্যার হুমকি দিলেন। সেটাও বৃথা গেল। তাই সাহেব তার পালিত বন্দুকবাজদের নির্দেশ দিলেন যে ব্যরিস্টারের মেয়েটিকে ধর্ষন করে শেষ করে দেয়া হোক। তাদের পারিশ্রমিক তের লক্ষ বাংলাদেশি মুদ্রা। মেয়েটি তখন স্কুলে ছিল। টিফিন বিরতিতে মায়ের জন্য ছাউনিতে বসেছিল। খুব খুশি খুশি মন। আজ মা  মেয়ের জন্য পছন্দের ফিরনি রান্না করে নিয়ে আসবে। মা পেশায় উকিল । সপ্তাহে প্রতিদিন মেয়ের আবদার পূরণের সুযোগ হয় না। তাই সে এই দিনটিই বেছে নিলো। কপাল যে মেয়েটির ইদুরের মা কি তা জানতো? জানলে তো বুকের ধন বুকেই আগলে রাখতো। মা স্কুলে পৌঁছার আগেই সন্ত্রাসীরা মেয়েটিকে মুখ বেধে তুলে নিয়ে গেল। পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে। সবাই বড্ড মাতাল। লাল লাল চোখ। শকুনের মতো তীক্ষ্ন দৃষ্টি। মেয়েটিকে যেন ওরা শিকার পেয়েছে। এইটুকু মেয়ে। হতভাগী হয়তো জানেই না কেন ওকে ধরে আনা হয়েছে। সে ভেবেছে এরা হয়তো ওর আংকেল হবে। অনেকগুলো চকলেট দিবে। বাবার মতই মতিন মামার দোকান থেকে একটি রাজা পুতুল আর রানি পুতুল কিনে এনে দিবে। রাতের বেলা বাবা-মা ঘুমোলে সে রাজা রানির বিয়ে দিবে। দিনে স্কুল থাকে। আম্মু বকে। কিন্তু তা হয়নি। অবুঝ প্রাণিটি কল্পনাও করতে পারছে না, কী ঘটবে তার সাথে। মাতালদের একজন পরনের প্যান্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলল। মেয়েটি ‘মা মা’ বলে চিৎকার শুরু করল। মুখ বাঁধা। ‘মা মা’ ধ্বনি শুধু ‘আ আ’ হয়ে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাতালটি মেয়েটিকে ধাক্বা মেরে কংক্রিটের ছাদের ওপর ধপাশ শব্দে চিৎ করে ফেলে দিলো। যে মেয়েকে জন্মদাত্রী মাও কোনোদিন এইটুকু চড় মারেনি, কতটা অসহ্য এই পাথর-আঘাত, শুধু সেই জানে। মেয়েটির চোখ থেকে একনাগারে স্বচ্ছ অশ্রু বের হয়ে আসে।
চারজন মাতাল ওর চার হাত-পা ছাদের সাথে শক্ত করে আটকে ধরে। মেয়েটির শরীর শক্ত করে জড়িয়ে নেয় দলনেতা। শুরু হয় ক্রমাগত পাশবিক নির্যাতন। এরপর পালাক্রমে বাকী চারজন। অথচ এই অবুঝ মেয়েটি বুঝতেই পারছে না, তার সাথে কী হচ্ছে এসব! সে হয়তো জানে না, এর নাম ধর্ষন। কী নাম আছে বিশেষ অঙ্গের। এই পাশবিক নির্যাতনের জন্য ওর কী অপরাধ, কোনোদিন হয়তো জানা হবে না ওর। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সে চিৎকার করতে চাইছে। মুখে বন্ধন। পারছে না। যন্ত্রণা চেপে রাখার যন্ত্রণা কত যে বিষাদময় তা শুধু এই শিশুটিই বুঝতে পারছে। তার গহীনে আবদ্ধ উৎশৃঙ্খল আর্তনাদ। মেয়েটির মধ্যে যে প্রাণপাখি ছিল, সেটি গলাকাটা বাচ্চা মুরগীর মতো তড়পাতে তড়পাতে পৃথিবী ত্যাগ করল। ছাদের ওপর অশ্রু আর নতুন রক্ত শুষে নিতে ছাদেরও কষ্ট হচ্ছিল বুঝি।
মেয়েটির লাশ ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে খুনিরা কাজ সমাপ্তির প্রমাণ তুলে ধরবে। তাই মেয়েটির থেতলানো ছবি তুলে সাহেবকে দেখাবে। পাওনা বুঝে ভাগাভাগি শেষ করে ঐ মেয়েটির মতই মেয়ের জন্য শখের জিনিস কিনে নিয়ে যাবে। আহা এও সম্ভব!
ঘটনাটি ঘটল তখন, যখন সাহেব ছবি দেখে চিনতে পারলেন, এটা তার ছোট মেয়ে। রেগে মেছো সাপ হয়ে খুনিদের দলনেতাকে টানা পাঁচ মিনিট চড়ালেন। এটাই তার চিৎকারের কারণ ছিল। চিৎকার করে বলতে লাগলেন- ‘বাস্টার্ড! তোরা আমার মেয়েকে চিনতে পারলি না!’
তরুর কিছু বলার ইচ্ছা হয়। বলে না। সাহেব হয়তো জানেন না, ধর্ষিত মেয়ের গায়ে বাবার নাম লেখা থাকে না। একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে তার বাবার নাম যে কারো নাম হতে পারে। ব্যরিস্টার খবর শুনে পুলিশে জানালেন। খুনি পাঁচজন গ্রেফতার হলো। সাহেব অস্থির অস্থির করছেন।
তরুকে পানি আনতে বললেন। তরু দ্রুততম সময়ে চকচকে একটি গ্লাসে পানি নিয়ে এলো।
এসেই বলল- ‘ছার আমি কি অধ্যেক পানি খাইয়া দ্যাহাব?’
সাহেব ধপ করে এক চড় বসালেন। তরু এবার মন খারাপ করল না। চোখ তুলে জানতে চাইল- ‘ছার, বেক খুনি কি ধরা পড়চে?’
সাহেব চোখ আকাশে তুলে আবার থাপ্পড় ছুঁড়লেন। পর পর তিনটি। তরু আর কথা বলে না। চোখ বড় বড় করে সাহেবের চোখে তাকায় । তরুর চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বের হয়। যেন পুড়িয়ে মারতে পারে হাজার বছরের পুরোনো এই সাহেবদের।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট