ছেলেটি ভালো ছিল
মুনিম রাব্বী
‘আমারে মার, বাচায়ে রাখছস ক্যান ? হাতের বটি খান দিয়ে একটা কোপ মারলেই তো হয়। নয় টাকা দিবি আর নয় কোপ ফেলবি ঘাড়ের উপরে।
সকাল থেকেই সারা বাড়ি মাথায় তুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সুজন। ওর মুখের উপর বিকট শব্দে দরজা আটকে দিল ওর মা। এতক্ষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করছিলেন। কিছুই বলেন নি । কিন্তু এবার তাঁর চিৎকার চ্যাঁচামেচি বাইরে থেকেও শোনা গেল ।
হারামির বাচ্চা, তোরে পেটে ধরছিলাম আমি ! ভাবতেও ঘেন্না লাগে। মরবি, রাস্তা ঘাটে যায়া মর। তরে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখপার চাই না। তারপর কিছুক্ষণ বাঁধন হারা উন্মাদ কান্নার রোনাজারি ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।
সুজনের শরীর কাঁপছে। দরজার উপর উরুম-ধুরুম কয়েকটা লাথি ঘুষি দিয়ে ওখানেই বসে পড়ল। চারপাশ চুপ হয়ে গেছে। ঘরের ভিতর থেকেও আর আওয়াজ আসছে না। সুজন অনেকক্ষণ দরজায় বসে থেকে ফিরে গেল । সে আজ বাসায় ফিরবে না। আজ কেন, সে আর কোন দিনও বাসায় ফিরবে না । সুজনের ভয় হয় আজকাল। এখানে ওর মা আর ছোট বোন ছাড়া আর কেউ নেই ।
চার রাস্তার মুখে ফাঁকা জায়গা। বড় একটা ব্যানারে হাউজ সেলের বিজ্ঞাপন লেখা । এখানে এক সময় টিনের ছাপরা ঘর ছিল । তখন সুজন খুব ছোট। অনেক বছর এখানে থেকেছে । নতুন বিল্ডিং হবে এই জায়গায়। এখানেই বসে আছে মুখ গম্ভীর সুজন। সে আজ বন্ধদের কাছে যাবে না। ফাঁকা পকেটে রোজ রোজ এসব আড্ডায় যাওয়া যায় না। মায়ের উপর রাগারাগিটা বেশী হয়ে যাচ্ছে ইদানীং। সত্যিই তো, মা এতো টাকা কোথায় পাবে ? নাহ, মায়ের সাথে এমন করা উচিৎ না। আর এমন না করেই কি উপায় আছে? ভালো, সুবোধ, ভদ্র ছেলে হয়ে বড় হওয়াটা যে তাঁর হয়নি । এখন কি চাইলেই বদলে যাওয়া যাবে ?
মায়ের সাথে প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি হয়। মাকেও যে এত আজে বাজে ভাষায় গালাগাল করা যায় তা সুজনের মুখের কথা না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। ওর মায়েরও পোড়া কপাল। স্বামী তাঁকে ছেড়ে গেছে অনেক বছর। কত রক্ত পানি করে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এই সংসার গড়ে তুলেছে সে। কত কষ্ট যে নিত্যদিন লুকিয়ে রেখেন শাড়ীর আচলে তা কেউ টের পায় না। সেই সংসারে আজ কোন শুভ লক্ষণ নেই। যেই ছেলেটার সম্বল হয়ে ওঠার কথা ছিল এত দিনে, সে বড় হচ্ছে ভুল পথে, ভুলের সঙ্গে। গত দুদিন সুজনের কোন খোঁজ নেই। সুজনের মায়ের দুশ্চিন্তা হচ্ছে কিছুটা। ছেলের জন্য মায়ের মন সব সময় একরকম থাকে না। তাছাড়া সঙ্গদোষে কোথায় কি করছে তা কে জানে ?
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। বাজার থেকে দুই আটি শাক, গুড়ো মাছ আর কেজি পাঁচেক চাল হাতে নিয়ে ফিরছে সুজন। তাঁর চোখে মুখে কেমন যেন পবিত্র আত্মশুদ্ধির ছাপ। ময়লা মাখা মানুষ যখন ঘষে মেজে গোসল করে তখন তাদের শরীরটা স্বাভাবিকের চেয়েও উজ্জ্বল দেখায়। সুজনের চেহারাতেও তাই।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুজন। আলতো করে দরজায় আঘাত করল। কি অদ্ভুত, এর আগে কোন দিন এত ভদ্র ভাবে দরজায় টোকা দেয়নি সে। দরজার ওপারের মানুষটাও যেন দরজার দিকেই তাকিয়েই ছিল, নয়ত কান পেতে ছিল এতক্ষণ। প্রথম বার শব্দ করে দ্বিতীয় কড়া নাড়বার আগেই দরজা খুলে গেল। মায়ের চোখের জল, তার ভিতরে বিস্ময় জাগানিয়া দুটি কৃষ কালো অক্ষিগোলক স্থির হয়ে আছে। যেন অনেক আঁধার ছাড়িয়ে অনেক দিনে পরে অপ্রত্যাশিত সূর্যটা উদিত হল।
কিছুই বলছে না সুজনের মা। সুজন সম্পর্কে তার এ যাবৎ কালের ধারণা বদলে গেল।
বাপধন, এগুলা কি আইনছো তুমি ?
এর পরেও অনেক প্রশ্ন করাযায় । কিন্তু আপাতত এই উত্তর জানা প্রশ্নেই খুশিতে বুক ফুসে উঠছে। মা, মাফ কোইরে দাও! ভাল হয়ে যাবো আমি। আর টাকা পয়সা লাগবে না আমার। মাঝে মাঝে আমিই তোমারে কিছু টাকা দিবার পারব এহন। ওমা, শান্তার কি খাতা ফুড়ায়ে গেছে ?
মায়ের শূণ্যবুকে, মরুভূমির বিস্তীর্ণ বালুকার স্তূপে, এত দিন জল জমত না। চোখ নিংড়ে যাই ঝরত সেই রাশিরাশি বালুর সমুদ্রে তা বিলীন হয়ে যেত। আজ যেন সেই মরু অঞ্চল ঢেকে গেল সবুজ পত্র পল্লবীতে। মমতার সুঘ্রাণ ফুলের অন্ত হতে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে যেন পুনরায় সজীব হল হারানো সংসার।
বাজান, তোরে কত বইকছি! তুই কিছু মনে রাখিস নে। এভাবে রাগ কোইরে মা-বোনটারে ফেলে কোথাও যাইস নে। তোরে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন !
সুজন মায়ের ওষ্ঠে আঙ্গুল ঠেকিয়ে থামিয়ে দিল। মা, এই স্বপ্নের কথা আর কইবা না। স্বাদ আর স্বপ্নের মইধ্যে ব্যবধান বেশী হোইলে মানুষ পথ হারায়া ফেলে। আগে মানুষ হোই মা। মানুষ না হয়ে মাইনশের স্বপ্ন দেখপার চাইনে।
সুজন বাসের কন্টাক্টরি করে। ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত শহরের এ মাথা ও মাথা ঘুরতে হয়। ইনকাম খারাপ না। যাত্রীদের সাথে টুকটাক ঝাঁই ঝামেলা হয় এই আরকি। ওসব ঝাঁই ঝামেলা মনে থাকে না। কত কত গালাগাল হজম করতে হয় ইদানীং। হজম হয়ে যায়। এক টিপে ঝাইঝামেলা অন্য টিপেই মনে থাকে না। কয়েক দিন হল দেশের অবস্থা ভালো না। কি এক কারণে সব বাস বন্ধ। বাস মালিক সমিতি গোসসা করে বাস বন্ধ করে রেখেছে। তাই আজ তেমন কাজ নেই সুজনের। সারাদিন বাসের সিটে ঘুমিয়ে সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় বাড়ির পথ ধরে সুজন ।
বাড়ির আগে বৌবাজার । সেখান থেকে সাদা দেড় কেজির একটা বয়লার মুরগী কিনে নিয়ে যায় সুজন। বাড়ির আগে রিকশার গ্যারেজ, ভাঙ্গারী মালের দোকান, তারপরে স্টিলের ঝালাই দোকান। তাঁর সামনে একটা আধ মড়া নারকেল গাছ। সেখান থেকে বামে গেলে সুজনদের টিনের ছাপরা ঘর। নারকেল গাছের বাম দিকে যেতেই সুজনের চোখ পড়ল বরাবর রাস্তায়। মা আর শান্তা ধাঁই ধাঁই করে আসছে ওই দিক থেকে। মনে হচ্ছে ওদেরকে পিছন থেকে কেউ ধাওয়া দিয়েছে। সুজনের মা শান্তার হাত শক্ত করে ধরে আছে। শান্তাও যেন তা সামর্থ্যের বাইরে মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটছে, হাটছেনা ঠিক, দৌড়চ্ছে।
সুজন এগিয়ে গেল । মা কি হোইছে ? কিছুনা।
মা ধাঁই ধাঁই করে ঘড়ে ঢুকে গেল। সুজন ঘরে ঢুকে আবার জিজ্ঞেস করল, এমন ভাবে আসলা, কি, কিছু হোইছে ? আরে নাহ ! তুই এত আগেই ফিরলি যে ?
কোন উত্তর না দিয়েই সুজন আবার জিজ্ঞেস করল, মা কি হোইছে । কও না কেন? আরে কিছু না, ভাঙা বিল্ডিঙের ওই হানে কুত্তা বেশি হয়ে গেছে । চেনা মানুষজন ও ধরে ইদানীং।
সুজন জানে, ওই জায়গায় কয়েকটা কুকুর ঘোর পাকিয়ে থাকে। অচেনা মানুষ দেখলেই হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু মা তো অচেনা না। এই পথেই কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টসে কাজে যায় মা। কিন্তু এমন তো কোন দিন হয়নি। সুজন ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। মা, মুরগী ডা রান্না কইরো, আমি একটু বাইরে
গেলাম।
পথের ধারে সেই আধমরা নারকেল গাছটার গোরায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ। কালো মুখের চোখে চরম অস্থিরতা। মধ্যবয়সী চিনচিনে মানুষটার চেহারায় নরকের বীভৎস ছাপ পড়েছে যেন। এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেনি সুজন। সুজন দূরে কোথাও গেল না। যতদূর থেকে লোকটাকে দেখা যায় তত দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
লোকটি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে গেল। জমসেদ দের দোকান থেকে চা খেয়ে বাসায় ফিরে আসল সুজন । অনেক দিন পর মুরগী রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রান্না হলে একসাথে তিন জন খেয়ে নেয়। অনেক কাল পরে ওরা তিন জন একসাথে ভাত খেলো। কাজ না করেও আজ সুজন খুব ক্লান্ত। ভালই হল। কাল ও বাস চলবে না। সুজনেরও এখন লম্বা একটা ঘুম দরকার।
পকেটে টাকা জমে আছে। কয়েকদিন হল সময়ও কাটছে না। তাছাড়াও লোকাল বাসের কন্টাক্টরিতে মনও বসছে না। অচেনা অজানা মানুষের অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে হয়। সুযোগ পেলে কেউ কেউ কলার্ট ও ধরে । প্রত্যেকটা দিন ঐ শালা মতিন ড্রাইভারও কম কথা শুনায় না। গায়ে খেটে এতো বাজে কথা পেটে হজম হয়না ।
সকাল সকাল বের হল সুজন । অনেক দিন পর দেখা হল পুরনো বন্ধুদের সাথে । ওরা ভাঙা বিল্ডিঙের ওইদিকেই যাচ্ছিল। কিরে সুজন, দেখাই যায়না, কেমন আছিস? এইত ভালোই আছি, তোরা কেমন আছিস ? আমরা কি খারাপ থাকি রে !
চল যাই, ভাঙা বিল্ডিঙে সবাই আছে।
নারে, তোরা যা। আমি টার্মিনালে যাব।
টার্মিনালে সারাদিন বসে থেকেও কোন নিশ্চিত তথ্য পেলনা সে। সাত দফা দাবিতে অনড় বাস-মালিক সমিতি। যদিও সুজন এসবের তেমন কিছুই বোঝে না। তবুও থেকে থেকে সুজনের রক্ত আন্দোলিত হয়। রাস্তায় তো মানুষ মরবারই পারে। কেউ কি কাউরে হাউস কইরে মারে ? হা হইয়া আসমানের দিকে চায়া কেউ যদি চাক্কার তলে গর্দান দেয় তার খেশরত কি আমাগো দেয়া লাগবো ? এসব যৌক্তিকতা বেশ ভালই বুঝতে পেরেছে সুজন। এভাবেই ঘুরে ফিরে বেশ সময় গড়িয়ে গেল। টার্মিনালেরে পিছন গেটের টঙ দোকান থেকে পাঁচ টাকার সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির পথ ধরে সুজন।
চ্যাঙরা ছেলেপুলে দুই এক পয়সা রোজগার করলে যা হয়। ইদানীং বেশ একা একা লাগে সুজনের। বিয়ের ভুত মাথায় চেপেছে। কথা বলার একজন মানুষ চাই এখন। মা কেমন যেন চুপচাপ থাকে। যেন বড্ড ক্লান্ত থাকেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস না করলে কোন কথা বলেন না। মাকে বলা উচিত। মা নিশ্চয় না করতে পারবে না। সুজন মাকে জানাবে। যদিও তার পাকাপাকি ওই ভাবে পছন্দেরে কেউ নেই। তবে জমির চাচার মেয়েটা ভালই। গোল গাল সাদা সিদে চেহারা। কিন্তু জমির চাচা কি রাজি হবে ? মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়নি এখনও। রাজি অবশ্য হতেও পারে। জমির চাচার টানা টানির সংসার, তাছাড়া সুজন ও ছেলে হিসেবে একেবারে খারাপ না।
কিছুক্ষণ হল মা ফিরেছেন। মায়ের চোখে মুখে ক্লান্তির চেয়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রোগ নেই, শোক নেই, অভাব ও কমেছে আগের চেয়ে, তবুও মায়ের এত চিন্তা কেন তা জানা নেই সুজনের। মা, তর সাথে কথা আছে। বল শুনতেছি।
জমির চাচার মাইয়ারে তর কেমন লাগে? মা কাজ থামিয়ে সুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তুই কি কইতেচাস? সোজাসুজি বল।
মা, আমি বিয়ে করবার চাই।
সুজনের মা কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু পরক্ষনেই কি যেন ভেবে আর বলল না । মা জানে, সুজনের বয়স বিয়ে করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া যে দুই চার টাকা ইনকাম করে তারও কোন ভবিষ্যৎ নেই। চোখ বন্ধ করে সুজনের এই সিদ্ধান্তে না বলে দেয়া যায়। কিন্তু, সুজনের মা না বললেন না ।
হুম , জমির ভাইয়ের মাইয়াডা খারাপ না ! কিন্তু বাজান, বিয়ে যে করবা, আগে পরে ভাইবে নিছো তো ?
হ, মা । তুমি জমির চাচার সাথে কথা কও ।
পরের দিন শুক্রবার বিকালে সুজনের মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জমির আলির চায়ের দোকানে গেল। চা খাওয়ার ফাকে ফাকে সুজনের মা পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল জমির আলীকে। এই প্রস্তাবে জমির আলী রাজি না নারাজি বোঝা গেলনা তৎক্ষণাৎ। চায়ের কাপ গরম পানি দিয়ে ধুতে ধুতে জমির আলি বলল, মাইয়াডার কি বিয়ার বয়স হোইছে সুজনের মা ? তোমার পোলাডারই বা কি বয়েস ?
তা তো আমিও জানি জমির ভাই । তুমি ভাইবে চিন্তে দেখো কি কোরবা। তোমার মেয়ে তো আর তোমারে ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে না।
জমির আলী গম্ভীর হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। আচ্ছা সুজনের মা। দেখি, বাড়ি যায়ে তোমার ভাবির সাথে আলাপ আলোচনা করে।
খবর আসতে খুব দেড়ি লাগল না। পরের দিন সকালেই কেজি খানেক মিষ্টি নিয়ে সুজনদের বাড়িতে আসল জমির আলী। কি ভেবে যে তার মর্জি হল তা ভেবে পায় না সুজনের মা। তবুও, তার চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত আনন্দের ছাপ। বিয়ে ঠিক হল পরের শুক্রবার।
এই কয়েকদিনে সুজনের চেহারা বেমালুম বদলে গেছে। তার চেহারায় হঠাৎ করে পরিণত পরিণত একটা ভাব এসেছে। সে জানে জীবন মানেই দায়িত্বকে গ্রহণ করা। দায়িত্বকে এড়িয়ে যা কিছু হয় তাকে সেই অর্থে জীবন বলা চলে না। তার কাছে নিশ্চিন্ত জীবনের চেয়ে অনিশ্চয়তাই মধুর।
গরিবের জীর্ণ সংসারে আজ বিয়ের আমেজ। ছোট্ট টিন শেডের ঘড় সাজানো গোছানো এখন। সবই ঠিকঠাক কিন্তু সুজনের মায়ের যেন এ নিয়ে কোন চিন্তা নেই। সে অন্য কোন কিছু নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় আছে।
মায়ের এমন থমকে যাওয়ায় সুজনের ও মন খারাপ। আজ বাদেও কাল বিয়ে অথচ মা মুখ ফুলিয়ে বসে থাকেন। সুজন এই ভাবতে ভাবতে ভাঙা বিল্ডিঙের দিকে হাটতে লাগল। আশে পাশে কোন ল্যাম্পপোস্ট নেই। দূরের কোথাকার কোন আলো এসে পড়েছে । ছোট খাটো অপরাধ গোপন করার মত যথেষ্ট অন্ধকার আছে এখানে । তবুও মায়ের শরীরের চিরচেনা অবয়ব চিনতে পারল সুজন । ওই হলদে ফুলের ছাপার শাড়িটাও সুজন কিনেছিল গত মাসেই । সেকি, ওই সেই কালো দুর্ধ্বষ লোকটা, যে দাঁড়িয়ে ছিল আধ মরা নারকেল গাছটার গোঁড়ায় । সেই লোকটা রক্ত লাল চোখে মাকে শাসিয়ে যাচ্ছে । মায়ের মুখে কোন কথা নাই। মাঝে মাঝে হাত জোড় করছে, মাঝে মাঝে চোখ মুছছে। কিন্তু লোকটার অকথ্য কথা বার্তা মাকে শুনতে হচ্ছে । এমন যেন তাকে শুনতেই হবে।
সুজনের আর আগানো উচিত না। মা বাড়ি ফিরলে না হয় শোনা যাবে। কিন্তু কি হচ্ছে এসব ? রাত পোহালেই বিয়ে অথচ সুজনের মা কি সব ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছে আল্লাহই জানে । কত টাকা ধার দেনা করতেছে আল্লাহই জানে। নাহ, থামাতে হবে । বাড়িতে আসলে বুঝাতে হবে ।
সুজন বাড়িতে ফিরে আসে । ছোট ছোট রঙিন আলোয় কালো আকাশের নিচে রঙিন হয়ে উঠেছে জায়গাটা । সবার ভিতরেই অন্যরকম আনন্দের উচ্ছ্বাস । সাউন্ড বক্সের উন্মাতাল গানের ছন্দে বার বার নেচে নেচে ক্লান্ত হচ্ছে সুজনের ছোট্ট বোন শান্তা। আশে পাশের কয়েকজন বন্ধুরাও এসেছে। সুজনের জীবনে এমন আনন্দের উপলক্ষ এর আগে কোন দিন আসে নি । কিন্তু সেকি, এই আনন্দ কোলাহলে সুজনের মা এখনও নেই। সুজনের রাগ হচ্ছে এবার। এদিকে সুজনের বোনটাও মা মা করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে । সুজন সেই প্রিয় মহুর্তটাকে ফেলে রেখে ছুটে গেল ভাঙা বিল্ডিঙের কাছে । সেখানে তেমনি অন্ধকার । আলোছায়ার অনন্তকালের খেলা । কিন্তু সেই দুটো মানুষের ছায়াও নেই । মা নেই ওখানে । হলুদ ফুলের ছাপার শারীর সেই আঁচলটাও নেই ওখানে। সে নাও থাকতে পারে। মা বাজারের দিকে গিয়েছে হয়ত। কাল বিয়ে। মা কিছু কিনতে হয়ত বাজারে ছুটেছে। তাই ভেবে সুজন ও বাজারের দিকে গেল
সমস্ত বাজার খুঁজল, নাহ মা নেই। বড় রাস্তার বড় শাড়ির দোকানটা, ওখানেও নেই। আশে পাশে কোথাও মা নেই । সুজন বাড়ি ফিরে আসে। ততক্ষণে রাত অনেক। শান্তাও ঘুমিয়ে পড়েছে। সাউন্ড বক্সের উন্মাতাল গান ও থেমে গেছে। বাজারের দোকান পাট ও বন্ধ। সুজন ছড়া অন্যরাও ওর মাকে খুঁজছে। ওই কালো লোকটা, বিচ্ছিরি রকম লোকটা , ওই লোকটার নাম জানে না সুজন। নাম জানবে কোত্থেকে, দেখেছে একবার। ওই লোকটা হয়ত জানে মা কোথায়।
রাত আরও গভীর হল। আশে পাশের সব কিছু জনশূণ্য হয়ে গেছে। এখন আর দুশ্চিন্তা না করে উপায় নেই। সুজনের চোখে পানি জমে। আশে পাশের কেউ কিচ্ছু জানে না। আর কোথাও খোজার বাকি নেই। আচমকা কি হয়ে গেল এসব। দুশ্চিন্তার কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে সুজনের ছোট্ট মুখ। খানিক বাদে পাশের বাড়ী থেকে মধ্য বয়সী এক মহিলা ছুটে আসল। সুজনের মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে । ওই কালো, লম্বা ছিপ ছিপে লোকটাকে সুজনের মা নাকি নিকাহ করছে।