হোম কোয়ারেন্টাইন
কাজী তানভীর
সবার স্নেহভাজন আরাফ। অল্প বয়সী হলেও লিখে দারুণ। লেখনিতে সবার হৃদয়স্পর্শ করার মতো যোগ্যতা আরাফের আছে। প্রায় মানুষ ওকে পিচ্চি কবি বলে ডাকে। মনে হচ্ছে ওর এই ডাক-নামটা চিরকাল বেঁচে থাকবে। বয়োজ্যেষ্ঠ হোক কিংবা মারা যাক, এই নাম বেঁচে থাকবে। ‘পিচ্চি কবি’ নামটি লোকদের মুখে এতো সমাদৃত যে, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের সামনেও সবাই ওকে পিচ্চি কবি বলে ডাকবে হয়ত! আর এতে ও খুব আনন্দ পায়। এমনকি পোষা টিয়েটাকেও ওই নামে ডাকতে শিখিয়েছে আরাফ।
ইদানিং আরাফ সকাল-বিকেল পোষা টিয়েটা নিয়েই পড়ে থাকে। বেলকনিতে টেবিলের একপাশে টিয়ের খাঁচাটা রেখে অন্যপাশে খাতা কলমে বসে বসে গল্প, কবিতা লিখে। টিয়ের সাথে খেলেধুলা করে দিন কাটিয়ে দেয়। টিয়ের মনে হাজারো প্রশ্ন। আরাফের কাছে যে তার উত্তর জানবে তাও সুযোগ নেই। আরাফ যে সাধারণ কবি নয় মহাকবি! সারাদিন ব্যস্ত। কাগজের সাথে কলমের যুদ্ধ তো চলছেই অবিরত।
একদিন দু’দিন নয়, অনেকদিন হলো সে ঘর থেকে বের হয় না। এমনকি নামাজের জন্যে মসজিদেও যায় না। সেটাও ঘরে আদায় করে। সেও বন্দি জীবন কাটাচ্ছে, আমাকে বন্দি করে রেখেছে খাঁচায়। সূর্যের আলো বিছিয়ে পড়া থেকে নিয়ে আলো নিভিয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটাই কাজ, ও লিখবে আর আমি দেখব। কীসব যে লিখে!
বুঝিও না। যেমন তেমন প্রশ্ন করলে রেগে মেগে একাকার হয়ে যাবে। অনুমতি নিয়ে বাহিরের হাল চাল দেখে আসি। তারপর না হয় প্রশ্নোত্তর করব। আগামিকাল সকালে বাহিরে বেরুবার অনুমতি নেবো। পরদিন সকাল হলো, যে মাত্র আরাফ বেলকনিতে এল অমনি টিয়ে অনুমতি চেয়ে বসল ঘুরতে বেরুবার।
-ও পিচ্চি কবি, বাহিরের আলো বাতাস পাইনি বহুদিন, আজ একটু অনুমতি তো দাও। অন্যান্য পাখিরা কত্ত উড়াউড়ি করছে। ঘুরছে ফিরছে।
অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো বেরুতে দাও।
-আরে টিয়ে বন্ধু, অত আক্ষেপ করে কেন বলছ। যাও। প্রত্যেক প্রাণীই নিজ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এটা তার অধিকার। যাও টিয়ে বন্ধু যাও। ঘুরে এসো।
-আচ্ছা যাচ্ছি। শীঘ্রই ফিরব।
এবার টিয়ে পেখম মেলে ঘুরঘুর করে চারোপাশ উড়ছে। এই গাছ থেকে ওই গাছে বসছে। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রামে যাচ্ছে। টিয়ে ভাবছে, আর মনে মনে বলছে,
-কী এক অবস্থা। একজন মানুষও বাহিরে নেই যে! শুধু কিছু পোষাকধারী লাঠিয়াল মানুষ দেখতে পাচ্ছি। মানুষদের সরব ব্যস্ততা কেমন যেন নিরব হয়ে আছে। নেই কোনো জনসমাগম। নেই বাজার হাট। নেই কোলাহল। নেই অস্তিরতা। সব যেন কেমন স্থির নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাটিতে মানুষদের পদাচারণা নেই। আকাশজুড়ে শুধু পাখিদের সরব আনাগোনা ও মাটিতে মানুষ নয় এমন কিছু প্রাণীদের নড়াচড়া।
বিষণœ মনে টিয়ে বাসায় ফিরে এল।
-কিরে টিয়ে বন্ধু এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?
-আচ্ছা কবি বন্ধু, বল তো দেশের এমন বেহাল পরিস্থিতি কেন? দেশের মানুষরা সবাই কি মারা গিয়েছে? না অন্য কোনো ব্যপার আছে!
-না রে বন্ধু। তেমন কিছু না। ব্যপারটা অন্যরকম একটু। একটা মহামারী। যার নাম নোভেল করোনা। উৎপত্তিস্থল হচ্ছে চীন। ক্রমে এসে পড়েছে আমাদের দেশেও। এটা একটি শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সংক্রমণ ব্যধি। জনসমাগম থাকলে হয়ত সংক্রমণে একজনের কাছ থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে যেতে পারে।
তাই সচেতনতামূলক সব মানুষই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করছে। এই হলো মূল কাহিনী।
আর আমার একাএকা ভাল্লাগে না তাই তোমাকে আমার কাছ থেকে সরতে দেই নাই। রাগ করো না টিয়ে বন্ধু।
-আরে কবি বন্ধু কী সব বল! তুমি তো আমার একমাত্র বন্ধু। আমার নিঃসঙ্গের সাথী তুমি, তেমনি তোমার নিঃসঙ্গের সাথী আমিও। আমি তোমার সাথে সবসময় আছি, থাকব।
-অন্তত এমন পরিস্থতিতে আমাকে সঙ্গ দাও। হয়ত তোমার কষ্ট হবে। আমার যে একা একা ভাল লাগে না তার জন্যে বলছি টিয়ে বন্ধু।
-চিন্তা করো না কবি বন্ধু এখন তোমার সর্বোত্তম সঙ্গী হচ্ছে তোমার গল্প, কবিতা আর আমি। দুআ করি সৃষ্টিকর্তা মানুষের উপর থেকে এই মহা মুসিবত ওঠিয়ে নিক।
-টিয়ে বন্ধু তোমরা তো নিষ্পাপ তোমাদের দুআ কবুল হবে বেশি। দুআ করো যাতে করে আমরা এমন মুসিবত থেকে পরিত্রাণ পাই।
এভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন কাটাচ্ছে আরাফের মতো কবিরা গল্প কবিতার সাথে। সঙ্গ পাচ্ছে হাজারো মানুষ তাদের পোষা প্রাণীর। মোটামোটি মন ভালো কাটছে অন্তত এভাবে। প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা যাতে আমাদের প্রতি সদয় হয়। আমাদের প্রার্থনা নিষ্ফল হবে না যদি তাতে থাকে বিশ্বাসের দৃঢ়তা। শুভ কামনা বিশ্ববাসীর জন্যে!