শব্দমালা
সোহেল রানা
আমার সুখ
আমি প্রত্যুষের সূর্যস্নানে, স্নাত চোখে
দু চোখ মেলে সবুজ দিগন্ত দেখি;
ফুলের সৌরভ, পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি
হৃদয়ে মাখি।
শিশিরভেজা দূর্বাদলে, ভিজিয়ে পায়ের গোছা
মিটায় আমার তৃষ্ণা।
কলমিলতা, হেলেঞ্চা, মটরশুঁটির সুমিষ্ট ঘ্রাণে
জুড়ায় আমার প্রাণ।
আমি ভালোবাসি বাংলার মা-মাটি, ধুলোবালি
ঝিলের জলের পাথর কুচি,
মায়ের কোলে শিশুর খুশি।
আমি ভালোবাসি কৃষান-কৃষানির ঘামে ঝরা
সোনা ফলানো হাসি।
ভালোলাগে চাঁদের আলোয়, নদীর জলে হৃদয় রাঙিয়ে
রাখাল মোহন বাঁশির সুর;
মাঝির কন্ঠে জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া আর
পল্লিগাঁয়ের পল্লিগীতি।
আমি ভালোবাসি বাংলা... বাংলা আমার ভাষা--
আমি বাংলায় কথা কই-- স্বপ্ন দেখি বাংলায়
আমি বাংলায় বুনি বীজ।
বাংলা আমার ঘ্রাণ, বাংলা আমার রূপ,
বাংলা'ই আমার সুখ।
ভালোবাসার বিশেষত্ব
১
আবেগ জন্ম দেয় ভালোবাসার,
আর আবেগ যেমন চিরস্থায়ী না
ভালোবাসাও তেমনি চিরস্থায়ী না।
২
আর মানুষ তার প্রয়োজনকেই ভালোবাসে,
প্রয়োজনই হল ভালোবাসার বিশেষত্ব
সেক্ষেত্রে পিতা-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, কিংবা
ঈাড়াপ্রতিবেশীর সম্পর্ক, তা কেউই তার বাহিরে না।
অবশ্য জ্ঞানপ্রাপ্ত বা করুণার আধারে যারা অধিষ্ঠিত
তাদের ব্যাপারটা আলাদা; তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সম্পন্ন বিপরীতমুখী
তাদের থেকে, যারা নাকি নিজের প্রয়োজনকেই মনে করে ভালোবাসা।
৩
ভালোবাসা হল--সৌন্দর্যমণ্ডিত চোখে দেখা
আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করা--
ভালোবাসা হল একটা মোহ,
আর এই মোহ যখন থাকবে না
তখন তোমার কাছে-পৃথিবীর সব স্বাদ
অনর্থক হয়ে যাবে।
রোদ্দুরমাখা দিনগুলি
এইতো মনে হয় সেদিনেরই কথা: শুভ্র সকাল,
পাখির ডানায় পরিভ্রমণ।
শিশুর হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো, তারপর
তার অবাধ বিচরণ।
হরিৎ শস্য প্রান্তরে-
উপরন্তু মায়ের কোলের মমতা,
বাবার স্নেহশীতল বটের ছায়া,
পাড়াপ্রতিবেশীর আদা মেশান, এবং স্বজনদের সাথে
আনন্দঘন দিনগুলি...আর ভালোবাসা-আর- ভালোবাসায়
সিক্ত হয়ে, পথ চলতে শেখা।
আর চলতে চলতে চলতে চলতে
‘জীবননদীর’ অববাহিকায় জীবন নামের
ঘানি, টানতে-টানতে-টানতে
নিষ্পেষিত এ-ই জীবনে! আজ শুধুই মনে পড়ে
সেইসব দিনগুলির কথা: প্রভাতের রবিময়
চকচকে-ঝকঝকে সকালটা,
অথবা দ্বিপ্রহরের কড়কড়ে-মচমচে দুপুরটা,
কিংবা অপরাহ্নের সৌন্দর্যময় ডালিভর্তি বিকেলটা,
নতুবা বৃষ্টিভেজা-শিহরণে-শিহরিত সমস্ত বেলাটা...।
জীবনটা ছিল এক-আনন্দঘন হোলিখেলা:
কলমি-হেলেঞ্চা-মটরশুঁটির লকলকে ডগার দোল,
কলকাকলি মুখরিত পাখির গান, স্নিগ্ধ সকাল!
শুভ্রতা আর পরিশুদ্ধতায় নিঃশ্বাসে-নিশ্বাস
নিয়ে নিয়ে পথ চলা।
অক্লান্ত বহতা পাখির ডানার মতন
এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তর, দূর থেকে দূরান্তর
ছুটে চলা দুপুর: অজস্র কমলা রঙের উজ্জ্বলতায় দিগন্তজোড়া এক সাগর রোদ্দুর;
আর রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে উপভোগ্য শরীর ও মন
হারিয়ে যায় যেন রোদ্দুরে-ই পাখনায় দূর অজানায়...।
সবুজের গাঁয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া
বহমান নদীর হাওয়ায়, উল্লাসিত হৃদয়!
মাঝির কণ্ঠে জারি-সারি, পল্লিগাঁয়ের পল্লিগীতি,
ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি-- আর
প্রজাপতির ডানার মতোই ছিল সেই রঙমাখা বিকেল!
প্রাণের সাথে প্রাণ, সুরের সাথে সুর,
ঝঙ্কারময় ছিল সেইসব ‘রোদ্দুরমাখা’ দিনগুলি।
আজ জীবনবেলার অপরাহ্নের প্রান্তে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়!
শুধুই মনে পড়ে সেইসব দিনগুলি...
রঞ্জিত
পরম্পরা সৌন্দর্যমণ্ডিত কিছু মুহূর্ত:
পড়ন্ত বিকেলে পড়ে গেছে সূর্যের আঁচ
নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে শীতল
হাওয়া
শান্ত শরীর ও মনে ফাগুনের দোলা,
বসন্তের হাওয়ায় করছে খেলা।
গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ, হেমন্ত-শীত-ও-বসন্তের
সমুদয় ভালোলাগা-ভালোবাসার, অনুভূতিগুলো একাকার করেছে যেন আমার!
উড়ন্ত বাতাসে উড়ছে তো উড়ছেই রমনীদের
অবিন্যস্ত চুল-
ওষ্ঠে লেগে আছে প্রেমের আভা,
ষোড়শীদের যুগল চক্ষু থেকে তীর ছুড়ে আসা
প্রেমের আহ্বানে আমি হয়ে গেলাম পাগলপারা!
এখানে নিত্যদিন বসে রমনীদের মেলা-
হেঁটে হেঁটে বেড়ায় একরাশ প্রেম! যেন স্বর্গীয় সুধায়!
তারপর;
গোধূলি আবীরে-- পশ্চিম আকাশের রঙে রঙে রঙিল হলো
সমস্ত নদীর এপার-ওপার-
আর অজস্র- অপার মণিমুক্তারা যেন নদীর তরঙ্গে- তরঙ্গে করছে খেলা!
আহা! কি এক অদ্ভুত রহস্যময় সৌন্দর্যে
হারিয়ে গেলো মন-- ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাতসমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে!
যেন পৃথিবীর সমস্ত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে একীভূত হয়ে গেলাম!
তারপর
হঠাৎ এক আগন্তক--পদ্মা নদীর পরশে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে এসে লাগলো আমার শরীরে,
আমার চোখ চলে গেলো ওই পুব আকাশে-
জীর্ণ বেলের পাতার ফাঁকে যুবতী চাঁদ রয়েছে দাঁড়িয়ে!
যেন ডাকে আমায় হাত বাড়িয়ে
কইবে কথা আমার সাথে
ভরাপূর্ণিমায় নিয়ে যাবে চাঁদের দেশে।
জীবনটা যদি এমন পরম্পরা সৌন্দর্যমণ্ডিত হতো-
গোধূলির রঙে রঙে রাঙিয়ে থাকতো
অথবা ভরাপূর্ণিমার চাঁদের মতো,
কিংবা নদীর মতো।
‘নাই’- কো বা তা-ও নাই হলো--
যদি প্রকৃতির এক টুকরো দূর্বার রঙে-ও রাঙিয়ে থাকতো,
তাহলে থাকতো না আর মানুষজীবনের
না-পাওয়া এ-ই টুকরো টুকরো কষ্ট!