অভিনয়



অভিনয়
মুহাম্মদ বরকত আলী 

রুমের ভিতর থেকে টেলিভিশনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত স্টার জলসা চ্যানেলে কোনো সিরিয়াল হচ্ছে। এই চ্যানেলের নাটকের আওয়াজ কানে এলেই নিঃসন্দেহে বলা যায় জলসা চলছে। প্রত্যেকটা সিরিয়ালের একই মিউজিক। একটা কথা বলার পর অন্তত কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী কথা শোনার জন্য। একটা সংলাপ বলা মাত্র ক্যামেরায় উপস্থিত সকল অভিনেতাকে দুইবার করে ফস ফস শব্দ মিউজিক দিবে আর দেখাবে। ম্যাডাম একজন শিক্ষিত মার্জিত সচেতন নাগরিক হয়েও এসব সিরিয়াল দেখে তা আমার ধারনা ছিলো না। এরকম কয়েকটা চ্যানেল আছে, যে গুলো দেখলে শুধু পরিবারের কলহ ছাড়া কিছুই শেখা যায় না। আমাদের দেশের নাটক গুলো কত সুন্দর শিক্ষণীয়। বিজ্ঞাপন একটু বেশি দিয়ে থাকে এই আর কী।
ছেলেটা আমার কোলে তুলে দিয়ে বেশ মজা করেই সিরিয়াল দেখা হচ্ছে। একটুও আলগা বসে থাকতে দিবে না। কথায় বলে না, কাজ নেই তো করি কী, ছেড়া কাঁথায় ধাগা দিই। এজন্যই বড় লোকদের আমি দেখতে পারি না। এরা গরিবদের মানুষ বলে মনেই করে না। কিন্তু ওদের পিছনে না ঘুরে উপায় আছে? উপায় না দেখেই এখানে পড়ে থাকা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই। এদিকে চাকুরির বাজার খুব গরম। বাবার অবসরে যাওয়ার আগে স্যারকে তেল মেরে অনেক আকুতি মিনতি করে আমাকে মাস্টাররুলে নিয়োগ দিলেন।
চব্বিশ ঘন্টাই ডিউটি। স্যারের বাড়িতে থাকতে হবে। আরও দুইজন সহকর্মী আছেন। ওরা দুজনই এস এস সি পাশ দিয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ফেলেছে। আমি মাস্টার্স শেষ করে বাবার আদেশে এখন সেবা প্রদান করছি। যাদের আছে তারা আরও চায়। এত টাকার বেতন, তবুও কত সখ। গরু পালন, হাস মুরগি পালন, সজ্বি চাষ, ফুলের বাগান, আরও কত কী। সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতে হয়। গরুর ঘাস কাটা, গোয়াল পরিষ্কার করা, গরুর গোসল করিয়ে দেওয়া, দুধ দহন করা। হাস মুরগি পালন। সব্জির চাষ করার জন্য আমাদেরকেই সব করতে হয়। কোপানো থেকে শুরু করে, নিড়ানি, পানি দেওয়া। নিজের খাওয়ার মত সব্জি করলেও একপ্রকার ভালোই ছিল। বাজারের সব খাবারে বিষ দেওয়া। অতিরিক্ত সার বিষ প্রয়োগে কোনো খাবার আজ নির্দিধায় খাওয়া যায় না। সবগুলো সমস্যা। এযেনো টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাচ্ছি। কিন্তু উপায় নেই গোলাম হোসেন। তাই যতটুকু সম্ভব নিজেই বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করতে হবে। সেই সুত্র ধরে সাহেবও চাষ শুর করেছে। এটা একটু বাড়াবাড়ি যে, নিজের প্রয়োজন মেটাতে যতটুকু চাষ করা দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি চাষ করান আমাদের দিয়ে। অতিরিক্ত সব্জি বাজারে বিক্রিও করতে হবে। ছাত্র বয়সে বাড়ির কোনো কাজে হাত লাগাইনি। বাবা চাকুরি করেন; সেই সুবাদে আমার কাজ ছিল খাওয়া, পড়াশোনা করা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। সেই আমি এখন কখনো রাখাল, কখনো মালি, কখনো চাষি, আবার কখনো কাজের বোয়া। দিন শেষে রাতে তিনজন পালা করে রাত পাহারা দেওয়া। প্রধান গেটে জোয়ান জোয়ান দুতিন জন পুলিশ সারা রাত পাহারা দেয়, তবুও আমাদের পাহারা দিতে হবে। চাকর, এক কথায় কামলা। এই যে এখন বিকেল বেলা তবুও একটু বিরাম নেই। ছেলেটা আমার কোলে দিয়ে উনারা সিরিয়াল দেখছে। সন্তানকে একটু সময় না দিলে মা বাবার প্রতি মোহাব্বত জন্মাবে কীভাবে? সন্তান লালন পালনে করতে  বাবা মাকেও একটু সময় দিতে হয়। সব কিছু চাকার বাকর দিয়ে হয়?  এজন্যইতো এদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কোনো দরদ নেই।
প্রায় ঘন্টা খানেক সময় হয়ে এল ম্যাডামের কোনো খবর নেই। কোল থেকে নামতেও চায় না। পুরুষ মানুষ হয়ে কতক্ষণ এভাবে কোলে নেওয়া যায়? কোনো বাবাকেও দেখিনি এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা তার নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে থাকতে।
এই যে, এবার একটু নিচে নেমে খেলা কর বাবা। চলেন, ঐ পাখিটা ধরতে হবে। কোল থেকে নামাতেই আকড়ে ধরল। না, এভাবে কাজ হবে না। বাবার কৌশলটা প্রয়োগ করতে হবে। বাবাকে বলতে শুনেছি, এক সাহেবের ছেলে বাবাকে খুব পছন্দ করত। বাবার কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে উঠত না। সময় সুযোগ পেলেই বাবার কোলে তুলে দিয়ে ওনারা আরাম আয়েশ করতো। তাই বাবা একটা উপায় বের করেছিল। চিমটি। হ্যা, চিমটি দিয়ে ধরত। তবে মৃদ্য ভাবে। এতেই কেঁদে উঠত  আর ম্যাডাম বাধ্য হয়ে বাবারকে মুক্তি দিতো। বাবাও সস্তির বাতাসে গা ভাসিয়ে বাড়ি ফিরত। উপায় ছিলো না। অফিস শেষে বাবাকে স্যারের পিছনে পিছনে যেত হতো স্যারের বাড়ি।
আমাকেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। দাঁড়া বাবা, তোর মায়ের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তোরও তো বাবা-মায়ের আদর নেওয়ার অধিকার আছে। একটু সহ্য কর। তোর জন্যই করছি। হালকা চিমটি দিতেই কেঁদে উঠল। ম্যাডামকে শোনানোর জন্য রুমের নিকটে নিয়ে গিয়ে আরও একবার দিলাম একটু ভলিউম বাড়িয়ে। চ্যাঁ চ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করল। ম্যাডাম রুম থেকে শুনতে পেয়ে হাঁক ছাড়লেন।
‘কী ব্যাপার, কাঁদছে কেন?’
‘থাকতে চাইছে না ম্যাডাম। কত কিছু দেখাচ্ছি, আদর করছি, তবুও থাকতে চাইছে না।’
স্যার বললেন, ‘অনেক্ষণ তোমাকে দেখিনিতো।’
স্যারের কথায় কথা দিয়ে বললাম, ‘জ্বী স্যার, সঠিক রোগ ধরেছেন।’
ম্যাডাম কোলে নিতেই কাঁন্না থেমে গেল। আপাতত আমার মুক্তি।
আমার সহকর্মীরা বাগানে কাজ করছে। কেউ ফুল গাছে পানি দিচ্ছে, কেউ গরু গুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছে।
স্যারের বড় ছেলে অন্তর। এবার আট ক্লাসে পড়ছে। বড় লোকের ছেলেরা সাধারণত খুব মেধাবী হয়। কেন যে ওরাই মেধাবী হয় এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলা যায় যে, গরিবের ছেলেমেয়েরা নানান অভাবে থাকে। খাদ্যের অভাব, জামাকাপড়ের অভাব, খেলাধূলা করার অভাব, এক কথাই নিজের মত করে কিছুই তারা পায় না। এই এতকিছু অভাবের মধ্যে তাদের কছে লেখাপড়াটা আশা করা খুব কষ্ট সাধ্য। খিদে পেটে লেখাপড়া কেন, কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।
আর বড় লোকের টাকার অভাব নেই। ছেলেমেয়ে কিছু চাওয়ার আগেই পেয়ে যায়। তাই তাদের কাজ বলতে ঐ একটাই, লেখাপড়া।
আমার সহকর্মীরা এস এসসি পাস হলেও আমি কিন্তু মাষ্ট্রার্স শেষ করেছি। বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে এল এল বি করাবেন। দুর্ভাগ্যটা বাবার না আমার তা বলা মুশকিল। বাবার পচ্ছন্দ হলেও আমার ওপেশা একদম পছন্দ না। তাই সরকারি চাকুরির বয়স শেষে এখানে এসে গরুর ঘাষ কাটা আর চাকুরির নামে চাকরের চাকুরির প্রার্থী হয়ে কামলা খাটা। উপায় কী? ঘুষ দিয়ে চাকুরি নেওয়ার পক্ষে বাবা যেমন ঘোর বিরোধী ঠিক তেমনি আমিও। যাই হোক, স্যারের ছেলে অন্তরের কথা না বললেই নয়। অন্তর গণিতে বেশ কাঁচা। বাসায় পড়ানোর জন্য একটা হোম টিচার ঠিক করার দ্বয়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। মসিক কিছু সম্মানি আর একবেলা পেটে খাওয়ার শর্তে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু বি এস সি শিক্ষকের বেশ অভাব। একটু চেষ্টা করলে পাওয়া যেত, কিন্তু অতটা গুরুত্ব দিলাম না। অন্য কেউ এসে স্যারের মন জয় করুক সেটা আমি হতে দিব না। আগ বাড়িয়ে আমিই একদিন গণিত করাতে বসে গেলাম। স্যার বললেন, ‘তুমি প্রতিদিন সময় দিতে পারলে বাইরের শিক্ষকের প্রয়োজন কি? তুমি একটু সময় দিতে পারবে না?’
‘জ্বী স্যার, পারবো। কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। কত প্রাইভেট পড়িয়েছি।’ ম্যাডাম এসে বললেন, ‘সেই বেশ হবে, রাতের বেলা তুমি একটু সময় দিও। তাছাড়া বাইরে থেকে কে আসবে না আসবে। বেতনটা তাকে দেওয়ার চাইতে তোমাকেই দিলাম।’
‘ম্যাডাম, আমার একটা কথা রাখতে হবে। অনুগ্রহ করে টাকার কথা বলবেন না। আমিতো আপনাদের খেদমতে এখানে আছি। তাছাড়া মাস শেষে কিছু পাচ্ছি। বাবুকে পড়ানোর জন্য একটি টাকাও নিবো না।’
স্যার বললেন, ‘আচ্ছা, সে পরে আলাপ হবে। এখন পড়াও।’
মাস্টাররুলে থেকে যা বেতন পাই তাতে অতি নগণ্য। কিন্তু সাহেবের কাছ থেকে টিউশনির বেতন নেওয়া যাবে না। শুনেছি, সাহেবেরা ফাউ ফাউ কারো কাছ থেকে কিছুই নিতে চায় না। যাদি নিয়েও থাকে, তবে তার একটা প্রতিদান দিয়ে যায়। তাহলে এই সুযোগ হাত ছাড়া করি কোন আক্কেলে? এখানে একটা চরম মিথ্যে বলেছি। আমার ছাত্র জীবনে কখনো একটি টিউশনিও করিনি। টিউশনি না করলে কি পড়ানো যায় না? এস এস সিতে বিজ্ঞান শাখার ছাত্র ছিলাম। গণিতে বরাবরি ভালোই ছিলাম। এখনো চোখ বন্ধ করে সব সমাধান করে দিতে পারব। তারপরও একটা কথা থেকে যায়, জে এস সি পরিক্ষা মানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও এই চ্যালেঞ্জ আমাকে নিতে হবে। অন্যান্য কাজের শেষে রাতের বেলা দু’এক ঘন্টা সময় দিলাম। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম গণিত শেখাতে। সারাদিন কাজের শেষে পড়াতে খুব বিরক্ত হলেও নিয়মিত বসতাম। মাস শেষে বেতন দিতে কতই না জোর করল। কত অনুরোধ, তারপর আমার জয় হলো। পড়ানোর মাসিক বেতন না নেওয়াতে ম্যাডাম আমার প্রতি আলাদা একটা ভালো নজর দিলেন। অন্তরেরও প্রিয় হয়ে উঠলাম। আমার অন্য সহকর্মীরা অতিরিক্ত কাজ করতে আলস্য দেখাত। যেহেতু আমি মাস্টারুলে আছি, সেহেতু দিন রাত সব সময় স্যারের বাড়িতেই থাকতে হতো। সকাল দশটার পর সাহেব অফিসে যাওয়ার পর  কিছুটা সময় অবসর পেতাম। কিন্তু চেষ্টে করতাম অবসর সময় না কাটানো। স্যার, ম্যাডাম আর নিষ্পাপ দুটি ছেলের নিকট সবার থেকে আমিই প্রিয় হয়ে উঠলাম। 
সকালবেলা স্যারের গাড়ি ধোয়ামুছা, অন্তরকে স্কুলে পৌছে দেওয়া, ছোট বাবুকে কোলে করে ঘুরে বেড়ানো, হাকডাক পড়তেই সবার আগে উপস্থিত হওয়া, আমার নিত্যকাজ। সব সময় বাবার উপদেশটা অনুসরন করতাম। তিনি কঠর ভাবে বলে দিয়েছেন, সাহেবের মন জয় করতে হবে। যেভাবে পারবি স্যার, ম্যাডামের মন জয় করতে পারলেই তুই তোর সাফল্য আসবে। আমিও সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগলাম। জীবনে যা করেছি সেটাও করলাম, যা কখনো করিনি সেটাও করলাম। মূল উদ্দেশ্য স্যার, ম্যাডামকে খুশি করা। দুজনেই আমার ব্যবহারে খুশি। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে অন্তর আর ছোট বাবুর জন্য নানা জিনিস নিয়ে আসতাম। স্যার, ম্যাডাম টাকা দিলে ভিষণ মন খারাপ করতাম। এভাবেই বছর পার হয়ে গেল। অন্তরের জে এস সি ফলাফল দিলো। অন্তর এপ্লাস পেয়ে উত্তির্ণ হল। গণিতের ফলাফল দেখে সাহেব, ম্যাডাম মহাখুশি। এই এক বছরে সে গণিতে অনেক উন্নতি করেছে।
হঠাৎ স্যারের বদলির চিঠি এল। আগামি সপ্তাহে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। তোড়জোড়ে চলছে আসবাবপত্র গোছানোর কাজ। গরু, হাস মুরগি বিক্রি করা হয়েছে।
আমার মনটা তেমন ভালো নেই। এতকিছু করার পরও কোনো ফলাফল না পেতেই এভাবে হঠাৎ সাহেব চলে যাবেন তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমার জানা ছিল অন্তত চার বছরের আগে কোনো বদলি নাই।
পরের দিন সকালে সারের অফিসে ডাক পড়ল আমার। কিসের জন্য ডেকেছে তা অজানা। সকাল সকাল উপস্থিত হলাম। স্যার চেম্বারে বসে আছেন। আমি ধীর পারে টেবিলের নিকট দাঁড়ালাম। স্যার মৃদু স্বরে বললেন, ‘তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। বসো।’
নিঃশব্দে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম।
স্যার চেয়ারটা একটু দুলুনি দিয়ে শরীরটা সামনে পিছনে করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘সবকিছু গোছানো শেষ হয়েছে?’
‘জ্বী স্যার। মালামাল বহনের জন্য একটা ট্রাক রিজার্ভ করা হয়েছে। আমার এলাকার ড্রাইভার, কোনো সমস্যা হবে না।’
‘আচ্ছা কাজের কথায় আসি। এখানে তোমাকে মূলত ডেকেছি একটা সুসংবাদ দেওয়ার জন্য। যে সুসংবাদটা পাওয়া জন্য লক্ষ লক্ষ বেকার ছাত্ররা অধির অপেক্ষায় থাকে।’
স্যার ঠোটে একচিলতে হাসি নিয়ে একটা কাগজ দেখি বললেন, ‘এটা কি জানো? এটা তোমার নিয়োগ পত্র। তোমার কাজ আর আমার পরিবারের প্রতি তোমার ভালোবাসায় আমার দিল খুশ। একজন এম এল এসকে প্রমোশন দিয়ে একটা পদ খালি করা হয়েছে। তোমাকে মাস্টারুল থেকে এম এল এসে নিয়োগ দেওয়া হয়েবে।,
আমার বুকটা ধক করে উঠল। কোনো কথা খুজে পাচ্ছি না, কথা আটকিয়ে আসছে। স্যারের হাতের কাগজটা নিছক একটা কাগজ হলেও সেটা এখন আমার সৌভাগ্য। এই কাগজটার জন্য কি না করতে হয়েছে আমাকে। যে কাজ আমার বাবা মা করিয়ে নেয়নি কখনো সেই কাজ এখানে করেছি। গোয়াল ঘর থেকে অন্তরের পড়ার ঘর। গরুর ঘাস কাটা থেকে সব্জী চাষ। কুলি কাজ, ধোপার কাজ, সব সব করেছি নির্দিধায়। ইচ্ছের বিরুদ্ধ্যে, দিন রাত হুকুম শুনেছি আর মিথ্যে হাসি হেসেছি স্যার ম্যাডামের সামনে। অন্তরকে ও ছোট বাবুকে ভালোবেসেছি এই একটি দিনের জন্য। সব ছিল অভিনয়। যা করেছি সব ছিলো ইচ্ছের বিরুদ্ধ্যে।
স্যার বললেন, ‘কি ভাবছো? আমাদের চলে যাওয়া নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো? সময় করে ঘুরে এসো ওখানে। এই নাও তোমার নিয়োগ পত্র। এখানে সাক্ষর কর।’
এগিয়ে দিলেন কাগজটা। কাগজটা হাতে নিতেই কানের কাছে কে যেনো বলতে লাগল, ‘তুই বড় অভিনেতা। চাকুরি পাওয়ার লোভে তুই আজ এদের সাথে অভিনয় করেছিস। নিষ্পাপ দুটি ছেলের সাথেও তুই মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করেছিস। তুই পাপ করেছিস। বড় অন্যায় করেছিস।’
ঠিকইত। আমি যেটা করেছি সেটা এই কাগজটার জন্যই করেছি। অভিনয় করেছি, মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয়। মানুষকে ভালোবাসা এতটা সোজা কথা না। নিস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা যে খুব কঠিক কাজ।
স্যারের দিকে এগিয়ে দিলাম কাজটা।
‘স্যার, নিয়োগ পত্রটা রাখেন। আপনি যে আমার উপর খুশি হয়ে এই নিয়োগটা দিচ্ছেন তা ভুল। আমি আপনাদের কাউকেই মন থেকে ভালোবাসতে পারিনি। যা করেছি তা ছিল আমার চরম অভিনয়।’
স্যার, আবারও হাসলেন। বললেন, ‘তুমি অভিনয় কর আর নাই কর, তোমার কাজগুলোতো আর মিথ্যে ছিল না। তোমার কাজ ছিল আমাকে খুশি করা।’
‘না স্যার, আমার কাজ ছিল আমার অবস্থানে থেকে সাধ্যমত আপনাদের সেবা দেওয়া।’
‘তুমিতো সেটাই করেছো।’
‘করেছি, তবে অতিরিক্ত অভিনয়ের সাথে। দ্বায়িত্ব নিয়ে না। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করেছি আর দিন শেষে বিরক্ত হয়েছি।’
‘এরকম তুমি কেন, সবাই করে আসছে।’
‘কিন্তু স্যার, আমি করতে চাই না। এই মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় থেকে আমি মুক্তি চাই।’
‘এরচে বেশি ভালোবাসতে পারবে না। পাগলামো করো না। তোমার ব্যবহার আর আমার স্ত্রী, সন্তানের প্রতি ভালোবাস মিথ্যে হলেও সেটা আমাকে ও আমাদের মন জয় করেছে। তার পুরুষ্কার দেওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করছো কেন?’
আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। আমি আর যোগদান করিনি। পরবর্তীতে আমার সহকর্মীদের মধ্যে একটা পরিক্ষা নিয়ে একজনকে নিয়োগ দিয়ে স্যার বিদায় দিয়েছিলেন। যেদিন স্যার এখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সেদিন কারো সামনে যেতে পারিনি আমি। শুনেছি সেদিন অন্তর আমার জন্য খুব কেঁদেছিল। যাওয়ার পূর্বে ও আমাকে একটা হাত ঘড়ি উপহার দিয়ে গিয়েছিল। একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে ছিল, ‘আপনি আমার গণিতের গুরু, আমি যেদিন চাকুরি পাব সেদিন আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। ঘড়িটা হাতে পরবেন স্যার, এটা স্যারের প্রতি আমার ভালোবাসা। জানি অন্তর, তোর এই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট