বুমেরাং
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে ‘আমেরিকা’ মানে পৃথিবীর স্বর্গভূমি। প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে জীবনে একবার হলেও আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন থাকে। শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের কেন, বলতে গেলে সারা পৃথিবী জুড়ে অগণিত মানুষ উন্নত জীবনযাপনের জন্য আমেরিকাতে আসতে চায়। কেউ বৈধ পথে আসে আবার কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করে। কেউ কেউ ভিজিট ভিসায় এসে অ্যাসাইলাম আবেদন করে থেকে যায়। আমেরিকাতে অবৈধভাবে বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ নগরীর নাম নিউইয়র্ক সিটি। এখানে অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে পুলিশি তৎপরতা অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকাংশেই কম। তাই অবৈধ অভিবাসীরা অনেকটাই নির্বিঘ্নে নিউইয়র্ক নগরী বসবাস করে।
আবুল কাশেম সাহেব আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে ভিজিট ভিসায় আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে আসেন। যখন তিনি এসেছিলেন, তখন তিনি তেত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। এখানে এসেই কাজে লেগে যান কিন্তু কিছুদিন যেতেই ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। তিনিও হয়ে যান এই নগরীর একজন অবৈধ অভিবাসীদের একজন। তখন তিনি একজন আইনজীবীর সহযোগিতা নিয়ে অ্যাসাইলাম আবেদন করেন। আইনজীবীর পরামর্শ মোতাবেক সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবুও বছরের পর বছর যায়, তিনি বৈধ হতে পারছেন না। গ্রিনকার্ড না থাকার কারণে দেশে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে।
আশায় আশায় পনেরোটা বছর কেটে গেল। তবুও স্বপ্নের গ্রিনকার্ড অধরাই থেকে গেল। অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করে বৈধ হওয়ার জন্য কোনো পাত্রী খুঁজে পাননি। নিজেকে খুব অভাগা মনে করতে লাগলেন। ঠিক তখনই উনার মনের আঙিনায় উঁকি দেয় কেইলি নামের কৃষ্ণবর্ণে এক গাইনিজ নারী। কাশেম সাহেব তখনও মরুর বুকে মরীচিকাই দেখছিলেন। তবুও চেষ্টা করে গেলেন। যদি কোনো ভাবে আমেরিকান নাগরিক কেইলিকে পটিয়ে বিয়ে করা যায়, তাহলে গ্রিনকার্ড যেন হাতের মুঠোয়। কেইলি ডিভোর্সি দুই পুত্র সন্তানের জননী। সে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে কাশেম সাহেবের আকুতি অগ্রাহ্য করতে পারেনি।
সুযোগ সন্ধানী কাশেম সাহেব নিয়মিতভাবে কেইলির বাসায় যাতায়াত শুরু করে। কেইলিকে পটানোর কিছুদিন পর তার দুই সন্তানদেরও পটিয়ে ফেলেন। একসময় তারা দুজনেই একসঙ্গে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। কাশেম সাহেব নিজের তল্পিতল্পা গুছিয়ে কেইলির বাসায় গিয়ে উঠেন। তখন তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিলে কেইলি অসম্মতি প্রকাশ করেন। চতুর কাশেম সাহেব তখন আপাতত বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে একসঙ্গে সুন্দর ভাবে বসবাসের ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেন। এভাবে বছরখানেক চলে গেল, আবারও বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কেইলি তখনও অসম্মতি প্রকাশ করে। এভাবে আরও একটা বছর কেটে গেল। তবুও বিয়ের ব্যাপারে কেইলির কোনো আগ্রহ নেই।
এবার বুদ্ধি করে কাশেম সাহেব একটা ফন্দি বের করলেন। তিনি একদিন কেইলিকে খুব ইমোশনাল হয়ে বললেন, ‘আমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি আমার সন্তানের মা হও, তবে এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হবে।’ কেইলি তখন রাজি হয়ে যায়। কিছুদিন যেতেই কেইলির গর্ভে কাশেম সাহেবের সন্তান আসে। দেখতে দেখতে একদিন কেইলির গর্ভে কাশেম সাহেবের একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। যদিও কাশেম সাহেবের মনে ভিন্ন ফন্দি কিন্তু বাইরে থেকে তিনি খুব খুশি দেখালেন। ইতিমধ্যে কাশেম সাহেবের উপর কেইলি অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাই কাশেম সাহেব আবার যখন বিয়ের প্রস্তাব দেন, কেইলি আর না করতে পারেনি।
কেইলিকে বিয়ে করার পর কাশেম সাহেব মাত্র আড়াই বছর তার সঙ্গে ছিলেন। উনার কাগজপত্র সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর গ্রিনকার্ড নিয়ে তিনি দীর্ঘ একুশ বছর পর বাংলাদেশে যান। দেশে প্রায় চার মাস থেকে নিউইয়র্কে ফিরে এসে তিনি কেইলির বাসায় ফিরে না গিয়ে অন্যত্র গিয়ে উঠেন। বাংলাদেশে যাওয়ার পর থেকে কেইলির সাথে তাঁর কোন যোগাযোগ নেই। একদিন তিনি কেইলিকে ফোন করে জানান কেইলির সাথে আর থাকবেন না। এতে কেইলি খুব কষ্ট পায় এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কদিন পরেই তিনি কেইলিকে আইনানুগভাবে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। কাশেম সাহেবের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে কেইলিও সবকিছু মেনে নেয়। একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে তাদের আইনানুগভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। কাশেম সাহেবের ছোট্ট মেয়েটি কেইলির কাছেই থেকে যায়। নিজের ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটির প্রতিও তিনি বিন্দুমাত্র টান অনুভব করেননি। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এবার তিনি মনস্থির করলেন দেশে গিয়ে খুব সুন্দরী এক তরুণীকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পারিবারিকভাবে দেশে পাত্রী দেখা শুরু হয়ে যায়। কাশেম সাহেব আবারও দেশে ফিরে নিজের পছন্দমত পঁচিশ বছর বয়সি এক সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করলেন। তখন কাশেম সাহেবের বয়েস চুয়ান্ন বছর। অল্প বয়সি সুন্দরী বউ পেয়ে তিনি মনের আনন্দে আত্মহারা। নিউইয়র্ক ফিরে এসেই নতুন বউকে নিয়ে আসতে আবেদন করেন। প্রায় সতেরো মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রী ভিসা পেয়ে যান। যদিও এর মধ্যে তিনি দুবার দেশে গিয়ে ছিলেন। ইচ্ছে ছিল সন্তান নেওয়ার কিন্তু তার স্ত্রীর একটাই দাবি, নিউইয়র্কে যাওয়ার পর সন্তান নিবেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তাঁর সুন্দরী স্ত্রীর কথা ফেলতে পারেননি।
প্রবাদে একটি কথা আছে, ‘নিয়তি কাউকে ক্ষমা করে না।’ আসলেই হলো তাই। নিউইয়র্কে আসার মাস ছয়েক পর কাশেম সাহেবের স্ত্রী যেন ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। সে তাঁর কাজে ব্যস্ত এবং সংসার ও কাশেম সাহেবের প্রতি একদম উদাসীন। ফোনে প্রায় সময় ভিজি থাকে। যেকোনো বিষয়ে কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যায়। একদিন কাশেম সাহেব আবিষ্কার করেন, তাঁর স্ত্রী নিউইয়র্কে অ্যাসাইলামে বসবাসরত একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। সেই ছেলেটা তাঁর স্ত্রীর দূর্সম্পকের মামাতো ভাই। মাঝেমধ্যে সে কাশেম সাহেবের বাসায় আসে, যখন কাশেম সাহেব বাসায় থাকে না। যা হোক, এসব নিয়ে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে নিত্য কলহে জড়িয়ে পড়েন। একদিন রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীকে বেদম মারধর করে রক্তাক্ত করে দেন।
তখন তাঁর স্ত্রী ৯১১ নম্বরে কল দিলে পুলিশ এসে কাশেম সাহেবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এবং কাশেম সাহেবের স্ত্রীকে পুলিশ জানায়, তিনি যদি কাশেম সাহেবের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে না করেন, তাহলে আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তারা তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে। কাশেম সাহেব নিউইয়র্কে নতুন বউ নিয়ে মাত্র বছরখানে সংসার করতে পেরেছিলেন। ওই ঘটনার পর কাশেম সাহেবের স্ত্রী পুলিশের সহায়তায় ফ্যামিলি কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের আবেদন করেন। তারপর তিনি তাঁর ওই দূর্সম্পকের মামাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে উঠেন। কাশেম সাহেবের সাথে ডিভোর্স সম্পন্ন হয়ে গেলে তারা দুজনে বিয়ে করে নেন। প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সে কাশেম সাহেব উপলব্ধি করেন, কারো সাথে প্রতারণা করে কখনো নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না। নিয়তি বুমেরাং হয়ে আবার নিজের কাছেই ফিরে আসে।
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা