যেভাবে খেলার সাথী হারিয়ে গেলো...
সাহেদ বিপ্লব
আজ সুমির কথা বেশ মনে পড়ছে। কি মায়াবী ছোটখাটো মুখটা ছিলো তার! সে ছিল আমার খেলার সাথী। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছে। আমার থেকে পাঁচ ছয় মাসের ছোট। একদিন আমাদের বাসা ভাড়া নিতে আসলেন তার নানা। সে মাকে বলল অনেক খোঁজাখুঁজি করে আপনাদের বাড়িটা আমার ভালো লেগেছে। এই কারণে আপনাদের বাসাটা ভাড়া নিতে চাই। আমার নাতনি আপনাদের বাড়িতে আপনার মেয়েটির সাথে দিব্বি খেলতে পারবে। আমার নাতনিটির এই জগতে আপন বলে কেউ নেই। বাবা নেই মা নেই। কোথা থেকে দানবের মত একটা গাড়ি এসে তাদেরকে কেড়ে নিলো। আমি এখন মেয়েটাকে নিয়ে কি যে করি।
তারপর থেকে সে আমার খেলার সাথী। আমার সুখে দুঃখে। একসাথে ফুলের মালা গাঁথি। এক সাথে পুতুল খেলি। ছোট ছোট নৌকা বানিয়ে বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে দেই। এটা ছিলো আমাদের বৃষ্টির দিনের খেলা।
আমি স্কুলে যেতাম আর সুমি স্কুলে যেতো না। আমার মায়ের সাথে আঠার মত লেগে থাকতো। মার সব কাজ করে দিতো। বলতো কাকিমা আলুটা কেটে দেই। কলপাড় থেকে পানিটা নিয়ে আসি। মরিচটা বেটে দেই। কোনদিন মাকে কাজের আদেশ দিতে দেখিনি। মা কিছু বলার আগেই সব কিছু রেডি।
আমি যখন রাতে পড়ার টেবিলে বসতাম সুমি এসে আমার পাশে বসতো। আমি কীভাবে পড়ি সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো এবং মাঝে মাঝে আমার সাথে পড়ার চেষ্টা করতো।
আমি একদিন জানতে চাই সুমি তুই পড়তে চাস। হ্যাঁ আমি পড়তে চাই। তুমি কি সুন্দর ভাবে মাথা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে পড়ো আমার বেশ ভালো লাগে। আমার মা বাবা বেঁচে থাকলে তোমার মত স্কুলে যেতাম। তোমার মতো পড়তাম বলেই একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে দিলো।
সুমির কথা শুনে আমি খুব কষ্ট পেলাম।
তোকে আমি পড়াবো। তারপর থেকে ও আমার বই পড়তো আমি ওকে পড়াতাম।
কিছু দিনের ভেতর দেখলাম সুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো পড়তে পারে। হঠাৎ একদিন ওর নানা মারা গেলেন। গ্রামের মানুষ এসে সুমির নানাকে গোছল করালো সুমি এক ভাবে নানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো একটুও চোখ সরালো না। যখন গ্রামের মানুষ সুমিকে টেনে সেখান থেকে সরাতে চেয়েছিলো কিন্তু কোনো ভাবেই সরাতে পারছিলো না।
অবশেষে মা এসে বললো সুমি উঠে আয়। পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকে না। সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। তোর নানাকে কবর স্থানে নিয়ে যাবে। মার কথা শুনে সুমি উঠে এসে আমার মায়ের বুকে পড়ে অনেক কাঁদলো আর বললো আমার আপন সবাই চলে গেলো আমার তো আপন বলে কেউ রইলো না।
মা বলল তোর কেউ রইলো না মানে কি? আমি আছি রিবা আছে। আজ থেকে আমি তোর মা। আমাকে একবার মা বলে ডাক।
সুমি মা বলে ডাক দিয়ে মার বুকে জড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। তারপর থেকে দেখিনি মা আমাকে আর সুমিকে আলাদা ভাবে দেখেছে। একদিন সুমিকে স্কুলে ভর্তি করা হলো। সে এখন আমার সাথে স্কুলে যায় আর বাড়ি এসে মায়ের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। মা বলে এখন যা স্কুলের পড়াটা করতে যা। এখন আমি একাই পারবো।
সুমি বলতো আমার বেশি পড়া লাগে না। একটু পড়লেই মনে থাকে। আসলেই তাই হতো আমি এতো পড়া করতাম কিন্তু সুমি একটু এসে বইগুলো নাড়াচারা করলেই সব পড়া হয়ে যেতো। সবার কাছে পরিচয় দিতাম আমার ছোট বোন হিসাবে।
আমরা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করলাম সুমির চেয়ে ভালো রেজাল্ট করবো কিন্তু হলো না। এস.এস.সি তে ভালো রেজাল্ট করলো সুমি আমরা কলেজে ভর্তি হলাম। মাঝে মাঝে আমাদের দুই বোনকে দেখতে আসতো। মা চেয়েছিলেন আমাদের দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচবেন। ছোট বেলা বাবা মারা গেছে। তাই বিয়েটা হলে মা বাঁচে কিন্তু বার বার যারা দেখতে আসতো তারা সুমিকে দেখে পছন্দ করতো কিন্তু মা চাইতো আমাকে বিয়ে দিবে আগে। সুমিও চাইতো আমার বিয়েটা আগে হোক কিন্তু শেষ পযর্ন্ত সুমির বিয়েটা হয়ে গেলো।
ভালো ছেলেটা দুবাই থাকে অনেক টাকা। বিশাল বাসা অনেক করে সাজিয়েছে। সুমি খুব খুশি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসলে সারাক্ষণ সেই বাসার গল্প করতো আর বলতো তোমাদের ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারবো না। তোমাদের জন্য আমার কপালে এতো সুখ। আমি বলি বাদ দে সেসব কথা তোর কপালে ছিলো তাই হয়েছে।
ওর স্বামী বিয়ের ছয় মাস পর দুবাই চলে গেছে। এখন সুমি একাই বাসায় থাকে। সাথে কাজের বুয়া। মাঝে মাঝে ফোন করে টাকাও পাঠায়। একদিন খবর এলো সুমির একটা মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। আমরা খুব খুশি। একদিন আমারও বিয়ে হলো গেলো। আসা যাওয়া অনেক কমে গেছে। আমি আমার সংসার বিয়ে ব্যস্ত আর সুমি তার সংসার নিয়ে। একদিন মা মারা গেলে আমরা দুইবোন অনেক কাঁন্না করে মাকে কবর দিয়ে এলাম।
একদিন আমার সাথে দেখা করে গেলো বললো কাল দুবাই স্বামীর কাছে চলে যাচ্ছি। আমি মন ভরে দোয়া করলাম। মেয়েটাকে অনেক আদর করলাম। বললাম দেখতে তোর মতো হয়েছে। সুমি হাসলো। এর পর কয়েক বছর দেখা নেই। বলা চলে যোগাযোগ নেই।
হঠাৎ একদিন পাঁচ ছয় বছরের একটি মেয়ে নিয়ে একটি বৃদ্ধ লোক আমার ঠিকানায় এসে হাজির। বৃদ্ধ জানালো দুবাইতে সুমির বাসায় পাশের রুমে থাকেন। তারপর একটু থেমে আবার বললো তোমার নাম কি রিবা?
জি¦ হ্যাঁ।
সুমি তোমাকে এই চিঠিটা দিয়েছে।
আমি চিঠিটা খুলতেই চোখ পড়লো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। এই লেখা আমার অনেক বছরের পরিচিত।
প্রিয় বোন,
আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমরা আমাকে সুখি করতে জীবন ধরে চেষ্টা করেছ কিন্তু আমার কপালে সুখ সইলো না। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল সে ভালো না। বাংলাদেশ থেকে এই ভাবে বিয়ে করে কিছু দিন ঘর করে তারপর দুবাইতে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। আমাকে বার বার বিক্রি করে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমি মেয়ের দোহাই দিয়ে এত দিন থেকেছি আর বলেছি পাঁচ ছয় বছর মেয়েটির বয়স হলে কোথাও কারো কাছে পাঠিয়ে দিবো তারপর তুমি আমাকে বিক্রি করে দিও। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো। যাতে আমার মেয়ে জানতে না পারে তার মা একজন পতিতা। তাই তোমার কাছে আমার মেয়েকে পাঠালাম। আমার মেয়েকে তোমার পরিচয়ে মানুষ করবে।
ইতি
সুমি।
চিঠি পড়া শেষ করে সুমির মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আমি অনেকক্ষণ কাদলাম এবং বৃদ্ধর কাছে জানতে চাইলাম সুমি এখন কেমন আছে? বৃদ্ধ কেঁদে দিয়ে বলল সুমি তো নেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই কথা শুনে মাথা ঘুড়তে লাগলো তারপর কি হলো বলতে পারবো না। এক সময় ভালো লাগছে তারপর চোখ মেলে দেখি অনেকগুলো মানুষ আমার আশে পাশে চুলগুলো ভিজা। মনে হলো জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেছিলাম। তারপর সুমির মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললাম আজ থেকে আমি তোর মা।