লাশের যাপনচিত্র

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


লাশের যাপনচিত্র

মো. আরিফুল হাসান


হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে সে সহজেই পৌঁছুয়। তারপর আবার পেছন ফিরে চায়। ফেলে আসা পথে তার মায়া লেগে থাকে। পথের রোশনাই তার চোখে-মুখে ঝিকিমিকি করে। সে স্তব্ধ হয়ে ক্ষাণিক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর আবার পথ চলতে থাকে। না, থামলে চলবে না। এ যাত্রা তার দূরপরবর্তী যাত্রা। এ যাত্রা তার চোখের বাঁধন।

যেতে যেতে সে কতকিছু তুলে নিতে চায়। কতকিছুতে হাত লাগায়, ছুঁয়ে দেয়। আবার হাত সরিয়েও নেয়। না, এ যাত্রা তার কোনকিছু নেবার নয়। এ যাত্রা তার দেবারও নয়। মন কাঁদে, কত অভাব অভিযোগ দেখে তার চোখ ভিজে আসে। সে নীরবে চোখ মুছে। পথের দূরত্ব তাকে দুঃখবোধের বেদনা হতে নিষ্কৃতি দেয়। সে আবারও পথ চলে। পথ চলতে থাকে এঁকেবেকে তার সাথে।


গ্রামের পরেই মাঠ। সেখান থেকে আরেকটু এগুলে জলা। সেখানে শীত থাকে। আর তার ওপাড়ে আছে বসন্ত। আপাতত মাঠের এই যাপনচিত্রটাকে সে অতিক্রম করে। দুপুরের রোদ তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যায়। এক পশলা সবুজ বাতাস তাকে দোল দিয়ে আবার কোথায় মিলিয়ে যায়! সব মিলে সুন্দর এক যাত্রাপথে তার কেবল গ্রামের কথা ভাসে।

গ্রামে কে আছে তার? মেয়েটির নাম লুৎফা। বড় অভাবী পরিবারের মেয়ে। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে মানুষ। শিক্ষা কি জিনিস সে জানে না। ফলে ভালোবাসার কোনো ছকে বাঁধা সংজ্ঞা তার জানা নেই। তবে যেটুকু আছে, সেটুকু হৃদয় নিংড়ানো উজার করা প্রেম। সেখানে খামখেয়ালি থাকতে পারে, তবে তাতে প্রতারণা নেই। সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে তাতে কপটতা নেই। এ কথাটি জানা। তবু তাকে ফেলে যেতে হয় অনিবার্য কারণে। আর এই ছেড়ে যাওয়া পথটিই দীর্ঘতর হয়ে যায় বিস্তীর্ণ বিষাদের মতো। যে চিত্রটি যাপনের, তখন তা শুধু একটি লাশের শবযাত্রার অনুকূল। 


এখান থেকে পেছনে ফিরলে সে লুৎফাকে হয়তো পেতে পারে। আবার নাও পেতে পারে সে। লুৎফা হতে পারে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, লুৎফা হতে পারে রূপচর্চার প্রসাধনহীন সাধারণ সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর যে ঐশ্বর্য, সেখানে পরাজিত না হয়ে পারা যায় না। আপনি ডুবে যায় তরী। কূল-তীর হারা গহীন গহনে ডুবতে ডুবতে তল পায় না শেষমেশ। তাই লুৎফাকে নিয়ে যত সহজভাবে ভাবার অবকাশ আছে, আছে ততটাই জটিলতা তাকে না পাবার। গ্রামের মন, একবার যদি না করে দেয় তাকে আর হ্যাঁ বলানোর সাধ্য আছে কার? সুতরাং দ্বিধায় পথ দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকে।

পথ ফুরোলো না। রথ ফুরোলো না। দুপুরের সূর্যটা আগের মতোই চলতে থাকে। মাথার উপর ছায়া ফেলে ফেলে চলতে থাকে একটুকরো মেঘ। মেঘটিকে লুৎফা মনে হয়। না হলে এই হেমন্তের নভে, যাপনের মাঠে আসার সঙ্গ কি সে এমনি এমনি দিচ্ছে। মেঘটিকে মনে হয় জ্বরেরঘোরে লুৎফার হাতের জলপট্টি। আর রোদটাকে মনে হয় লুৎফার উষ্ণ আলিঙ্গন। 


পথ অনেক দূরে। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে একসময়। এই তো, অদূরেই তো জলাশয়। কিন্তু অদূরে নয়। যেতে যেতে পথের হিসেব যখন ধূলিকণা হয়, তখন এক কদমেও কয়েকশো প্রয়াস থাকে। বিশেষ করে মন যখন দ্বিধার চলক, তখন তো মন বলে চলো না, দ্বিধা বিভক্ত পাগুলো সরে যায় সামনে অথবা পিছে, বিপরিত গোলার্ধের অন্তরালে। তবু পথ যেতে হবে। এ পথ যে বিশাল। সবে মাত্র যাপনলোকের প্রস্তর শুরু হয়েছে। তারপর আছে মিহিদানার প্রান্তর।

এখানে মিহিদানার প্রান্তরে মানুষ শষ্য চাষ করে। এখনও চাষের কার্যক্রম চলছে। তবে হেমন্তচিত্রটি এখন আর মাঠে নেই। মাঠের হেমন্তের ফসল এখন কৃষকের ঘরে ঘরে জ্বলন্ত আগুনে সুস্বাধু হচ্ছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। অথবা তারা মহাজনের গদিতে জমা হচ্ছে আগত কোনো দুর্ভিক্ষের জন্য। কিংবা এমনিতেই জমা করছে মহাজনা। হয়তো বদমতলব আছে। হয়তো তারা দাম বাড়লে চড়া দামে বিক্রি করবে সেসব। তবে মাঠে যে হেমন্ত শষ্যের কোনো চিহ্ন নেই এ বিষয়টি নিশ্চিত। দুটো হাল দেয়া শুকনো খরখরে মাটিগুলো যুবতীর প্রতিক্ষিত জরায়ুর মতো উন্মুখ হয়ে আছে নতুন বীজ গ্রহণ করতে।


ক্ষেতের আলপথ ঘাসে ঢাকা। ঘাসের চাদরে পথ আটকে যায় পায়ে পায়ে। আলের দু পাশের জমিগুলোতে জৈষ্ঠ্যে যে ধান বুনা হয় তা হেমন্তে আসে। বর্ষার দিনে এ ধানগাছগুলো জলে ডুবে বেঁচে থাকে। জল সাঁতরে ভেসে থাকে। জল ফড়িঙেরা ধান গাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ায়। ইঁদুরেরা বাসা বানায় এসে ধানক্ষেতে। কৃষক জাল পাতে ধান গাছ ফাঁক করে। মেনি, টেংরা পুটি শিং, কখনো কখনো গজারটাও লেগে থাকে জালে। জাল তুলে এনে কৃষকেরা মাছ দেখিয়ে নতুন বৌয়ের হাসিমুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করে। বধুয়ারা মাছ কুটতে বসে যায়। কৃষকেরা জল খাবার খেয়ে আবার ছুটে ক্ষেতে। মাঠের ইঁদুর তাড়াতে হবে। না হলে আমন ধান রক্ষা করা কঠিন।

আমন ধানের চারাগুলো জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। কখনো কখনো দশ ফুট বারো ফুট পর্যন্ত হয়ে যায়। জল চলে গেলে ধানগাছগুলো বিছিয়ে পড়ে থাকে মাটিতে। কিছু দিনের মধ্যেই মোচার মতো শীষ আসে সারামাঠ হেসে। ধানের স্বপ্নে কৃষকের ঘুম চলে যায়। মোচা থেকে ধানফুল ফুটটে থাকে। ফুলগুলো দুধ হয়ে ধানের ভেতরে ঠাঁই নেই। তারপর পাকা ধানের সুবাসে কার্তিক অগ্রহায়ণ হেসে উঠে গোলায় গোলায়। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠে চিরায়ত গ্রামবাংলা।


হেমন্ত উৎসব শেষ। এখন একটি যাপনের ভেতর দিয়ে শীতের ভেতর প্রত্যক্ষণ করা ছাড়া আর গতি নেই। কিন্তু ফিরে যাবারও কোনো জো নেই পেছনের দিকে। যদিও পেছন থেকে লুৎফার হাতছানি। যদিও পেছন থেকে নবান্নের প্রাণের উৎসব, কিন্তু কোনো উপায় নেই। যাপন পথের নিজের ভেরতটাকে দুচালকে রেখে জীবনের কাটা ঘোরানো সম্ভব নয়। এমনি অবশ্যম্ভাবী যাত্রায় যদি মন কাঁদে তবু সে ফিরে আসতে পারে না।

এ লোকটা শেষ হলেই শীতলোক। সেখানে লুৎফার বুনা সুয়েটারের মতো উষ্ণতা দরকার হয়। শীত নিবারণের জন্য চাই এক মালশা আগুন। যা লুৎফা রান্নার পর যতœ করে তুলে রাখে রাতের হীমের বিপরিতে। আরও দরকার হয় পান করার জন্য উষ্ণ পানিয়। যা কেবল লুৎফার কমলার কোয়ার মতো দু ঠোঁটেই পাওয়া যায়। এতকিছু ছেড়েও সে হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে এসে পৌঁছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে আসতে হয়। আসতে বাধ্য করা হয়। লুৎফা যে গরিব ঘরের মেয়ে। কোনো ধনকুবেরের চোখে সে যদি পড়ে তবে আর তাকে তার প্রেমিক কখনো ফিরে পায় কি? লুৎফার বাবা বিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু লুৎফা মন থেকে ভালোবাসাকে মুছে ফেলতে পারে না। প্রস্তাব করে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। শেষদিন, সে পায়ে পড়ে কাঁদে। এই বিরহের চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ জানায়। কিন্তু লুৎফাকে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে লুৎফাও অভিমান করে বিয়েতে রাজি হয়। জানা আছে, আবার যদি সে লুৎফার হাত ধরে, যদি বলে নিতে এসেছি, তাহলে লুৎফা বিবাহবাসর থেকে উঠে চলে আসবে। কিন্তু এ কথা বলতে সায় দেয় না মন। মনে হয়, বড় ঘরে লুৎফা নিশ্চয়ই সুখেই থাকবে।


পথ চলতে চলতে একদিন পথ ফুরায়। যাপন লোকের শেষ সীমানার কাছাকাছি এসে একটি সাপ মুখোমুখি হয় তার। সামনেই জলা। ভেবেছিলো জল থেকে কোনো ঢোঁড়া সাপ হয়তো উঠে এসেছে। কিন্তু ফণা তুলতেই দেখা গেলো তার মস্তকে বিষচক্রের ত্রিশূল। সাপটি ডানে বাঁয়ে দুলতে লাগলো বিপদজনক ভাবে। সামনের দিকে ঝুঁকে ছোবল মারতে থাকলো হিসহিস করতে করতে।

সাপটিকে হয়তো এড়ানো যেতো। কিংবা আঘাতে আঘাতে সাপটিকে হত্যা করা যেতো। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো যে সাপটিকে সে পোষ মানাতে চায়। ঠিক একই রকম মনে হয়েছিলো লুৎফাকে যখন প্রথম দেখেছে সে। লুৎফাও পোষ মেনেছে। বুকের গহীণে লুকিয়ে রয়েছে দুরন্ত সর্পিণী। কিন্তু কখনো তাকে ছোবল মারেনি। একবার মনে হলো, লুৎফা তো মানুষ, রক্তমাংসের গড়া আমারই মতো মানুষ, মানুষকে আদর করে বুকে রাখা যায়। তা বলে সত্যিকারের সাপকে কি পোষ মানানো উচিত? সমস্ত প্রশ্ন এবং দ্বিধার দেয়াল ভেদ করে সে আরেকটু এগিয়ে যায় সাপটির দিকে। কোনোকিছু চিন্তা না করে খপ করে ধরে ফেলে সাপটির ফনা। ফনাবদ্ধ সাপটি তার হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে যায়। বাঁ হাতে প্যাঁচ খুলে সে সাপটিকে ছেড়ে দেয় জামার ভেতরে নিজের বুকের মধ্যে। সমান্তরাল দুটো বিষবিন্দু হৃদপি-ের কাছাকাছি মৃত্যুঘুম ছড়াতে থাকে। ঠিক তখনই বিবাহের আসরে বিষপান করে আত্মহত্যা করে লুৎফা।


কুমিল্লা, বাংলাদেশ



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট