অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
গুম
আহাদ আদনান
আলো যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। দিন যখন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, প্রদোষের হাতছানিতে তলানিতে ঠেকে দৈনন্দিন সূর্যটার জ্বালানি, তখনো যদি আলো বাড়তেই থাকে তাহলে ধন্দে পড়ে যেতে হয়। এমন হয় কখনো সখনো। গরুর দল ঘরে ফিরতে যেয়ে দেখে আলো উপচে পড়ছেই আর পড়ছেই। হলুদ আলো নয়, লাল আলো নয়, এমনকি জীবনানন্দের কমলা রঙের রোদও নয়, এ রোদ বর্ণনাতীত। এ রোদ রংতুলি হাতে সুলতানকেও করে দেয় হতবুদ্ধি।
অনেকদিন পর, ঠিক কতদিন জানা নেই, চোখে এমন আলো পড়তেই ভয়ে জড় হতে থাকে অরুণ। সে ভাবেনি কোনোদিন আর সূর্য নক্ষত্রটার চেহারা দেখতে পাবে। নক্ষত্র বিষয়ক কিছু মিথ শুনে শুনে সে বড় হয়েছে। আলোকবর্ষ নামের জটিল কিছু গাণিতিক হিসেব কষে কষে কেটেছে তার দিন। যদিও নক্ষত্রের চেয়ে প্রিয় ছিল উপগ্রহ। চাঁদটা তার কাছে শুধুমাত্র একটা ঘূর্ণায়মান উপগ্রহই ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন।
আলোটা আরও বাড়ছে। বেগুনি একটা আভা ছিল এতক্ষণ। সেটাও কেটে যাচ্ছে। এখন এর একটা রঙ বোঝা যাচ্ছে। কমলা রঙের রোদ। রোদের রঙটা বুঝতেই অরুণের কাঁধে ভর করে জীবন বাবু। একটি মেয়েকে সে চিরদিন ভালোবেসেছিল, অথচ মেয়েটা তার মুখ কোনোদিন দেখেনি। সে মেয়েটা পৃথিবীতে এসেছে কি? এতদিনে জন্ম নেওয়ার কথা। তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
রোদটা আরেকটু মাথাচাড়া দিতেই অরুণ ভয় পেয়ে যায়। দিন কি আসলেই শেষ হচ্ছে, না-কি শুরু হচ্ছে? সূর্যটা ডুবতে গিয়ে আবার উঠছে কি? পশ্চিম দিক থেকে উঠছে? এখন কি কেয়ামত হচ্ছে? পৃথিবীটার আর দেরি নেই বুঝি? অথচ সবাই কত স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কালো গাড়িটা ট্রাকটাকে ওভারটেক করে উঠে গেল মহাসড়কে। ছোট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে শপিং মলে। লুঙ্গি পরা খাটোমত একটা লোক বিড়ি টেনে ভুকভুক করে ধোঁয়া ছেড়ে গেল। অরুণ খুব টান দিয়ে শ্বাস নিল। কোন গন্ধ তার নাকে ঢুকছে না। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে কি এখনো বেঁচে আছে?
আরও কিছুক্ষণ পার হয়ে গেছে। সূর্যটা এখন মাথার উপর। অরুণ নিশ্চিত, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। চিৎকার করে কথাটা সে সবাইকে বলতে থাকে। কেউ শুনতে পায় না তার আহ্বান। তার শব্দের কোনো প্রতিধ্বনি হয় না। সে ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। কারও গায়ে ধাক্কাও লাগে না। চুম্বকের উত্তর মেরু হয়ে ছুটে চলা অরুণ নিজেকে আবিষ্কার করে আরও অৎস্র উত্তর মেরুর জনসমুদ্রে। প্রবল বিকর্ষণে সে সরে যেতে থাকে সবার কাছ থেকে।
অরুণ বুঝতে পারে তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। যদিও শরীর বলছে অন্যকিছু। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। না হলে সে বুঝতে পারত তার ব্যথাগুলো চলে গেছে। কালশিটে পড়া উরুর মাংসগুলো দৃঢ় হচ্ছে। বাহুতে ভর করছে দানবিক শক্তি। টেকো মাথাটার জ্বলজ্বলে ময়দান ক্রমশ ঢাকা পড়ছে। শম্বুকের মত শুরু করা সময়টা যতই পার হচ্ছে, সে ‘ফিরে পাচ্ছে’ চিতার গতি। ফিরে পাওয়া ব্যাপারটা অবশ্য তার জানা নেই। গতকালটাও এখন পূর্বজন্মের মত। অচেনা, অজানা, অনুভবের বাইরে। সবাই কি জাতিস্মর হয়?
সূর্যটা আরেকটু পূবে যেতেই অরুণ পরিবর্তনটা টের পায়। বিশাল একটা দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। এ কে? সদ্য যুবক ছেলেটা কি সে নিজে? ওকে চিনে অরুণ। তখন পৃথিবীতে কোনো চাপ ছিল না। দায়িত্ব, প্রেম, সংসার ছিল না। রাজনীতি ছিল না, শত্রুতা ছিল না। পুলিশ, গ্রেফতার, রিমান্ড ছিল না। গুম ছিল না। এগুলো তার পার হয়ে আসা অতীত। এগুলো দেখেছে সে। রিমান্ডে দাঁত ভেঙে যাওয়া, মলদ্বারে উষ্ণ ডিমের অস্তিত্ব, মরিচ-জ্বলে শিশ্ন-স্নান, অন্তকোষে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মনে পড়ে তার। মনে পড়তেই লুঙিটা খুলে ফেলে সে। এতক্ষণ লুঙ্গি ছিল গায়ে, এটাই তার মনে ছিল না। নগ্ন অরুণ শক্ত হাতে খাবলে ধরে অন্তকোষ। কঠিন তালুতে ঘষে নেয় উন্নত দৃঢ় শিশ্ন। যৌবনের প্রথম প্রহরে ভাবনার কেয়ামতটা উপভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে।
রোদটা মিহি হয়ে এসেছে। উলঙ্গ অরুণের কোনো লজ্জা করছে না। গ্রামের দিকে পুকুরে আরও কয়েকটা আদুল ছোকরার সাথে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরের জলে। আহা, কতদিন পর এই উদ্দাম সাঁতার। পুকুরটা আর শেষ হয় না। তার শক্তিও আর ফুরায় না। সব ছেলেকে পেছনে ফেলে সে দেখে কখন যেন পুকুরটা নদী হয়ে গেছে। কিংবা সমুদ্র, মহাসমুদ্র। এতকিছু ভাবতে বয়ে গেছে তার। এটা ভাবনার বয়স না। এই সময় শুধুই উদযাপনের।
এই লালচে আভাকেই কি সুবহে সাদিক বলে? জল থেকে উঠে অরুণ হাঁটছে মখমলের গালিচায়। এটা মাটি, না মায়ের কোল? ঘুম পাচ্ছে অরুণের। একটু শুয়ে পড়লে কেমন হয়? কে যেন বলছে, ওঠ অরুণ ওঠ। এখন ঘুমুতে নেই। ওঠ। বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখন ঘুমুলে আর উঠতে পারবি না। কে বলছে এসব? মা? বাবা? অন্য কেও? কণ্ঠটা পুরুষ না মহিলা? কিছুই মাথায় আসছে না। মাথায় ঢোকানোর চেষ্টাও করছে না অরুণ।
এখন অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পৃথিবীতে কোনো ঘড়ি কাজ করছে না। সময়, সূর্য, নক্ষত্র, নক্ষত্র বিষয়ক মিথ কিছুর অস্তিত্ব নেই এখন। তন্দ্রা, স্বপ্ন, কল্পনা, কুহক, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা মিলে মিশে একাকার এখানে। ব্যথাটা ফিরে এসেছে আবার। ফেটে যাওয়া খুলিটা থেকে কিছু মগজ বের হয়ে এসেছে। ঝোপের মত একটা কিছুতে পড়ে আছে অরুণ। হাতটা কাজ করলে, ধরতে পারলে সে বুঝতে পারত শিশ্ন, অন্তকোষ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শরীরটা এখন শুধুই থ্যাঁতলানো মাংসপি-। দৃষ্টি ফিকে হয়ে আসছে। শ্রবণশক্তি ভোঁতা হয়ে আসছে। এক দুই তোলা মস্তিষ্কের কোষ কাজ করছে বোধহয়। এই অন্ধকারে আলো দেখছে ওরা। আলোর একটা ধর্ম আছে। যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। এই নিয়ম এখন চলছে না কেন?
‘ওই, অর্ডার আসছে। আর খোঁচাইতে হবে না। গুলি কর। মাথা, মুখ ঝাঁঝরা কইরা দে। দেখলে যাতে চেনা না যায়। তারপর নদীতে ভাসাইয়া দিবি। গুম কইরা দে’।
সূর্যটা এবার সত্যি উঠে গেছে। পূর্ব দিক থেকেই উঠেছে। কেয়ামতের দেরি আছে তাহলে। আলো ছড়াচ্ছে। ছড়াতেই থাকে। এটাই আলোর ধর্ম।
ঝকঝকে আলোতে নদীর জলে খুলিবিহীন নগ্ন একটা লাশ ভাসতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।