ভূতের প্যাঁচালী
রফিকুল নাজিম
০১.
‘কয়দিন ধইরা আবার জিনিসটা ফিরা আইছে। যারে সামনে পায় তারেই নাকি জ্বালাইতাছে।’- চায়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতে করতে কথাগুলো বললো কাসেম আলী। তালতলী বাজারের সবজি পট্টির শেষ মাথায় তার দোকান। সকাল থেকেই বাজারের লোকজন তার দোকানে চা নাস্তা করতে আসে। কথাটা শুনে সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাকি গল্পটুকু শোনার জন্য সবার মন আকুপাকু করছে। পিরিচে ঠোঁট রেখে চায়ে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে ফজর আলী জিজ্ঞেস করলো, কি রে কাসু, আবার কি অইলো? কেডা আইলো? খুইল্লা ক দেহি।’ একমনে কাসেম চুলায় কাঠের টুকরো দিচ্ছে। চুলার আগুনটাকে উস্কে দিয়ে বললো, ‘কেরে? কিছু মনে হয় হুনো নাই, ফজর ভাই? ‘দোকানে সুনসান নিরবতা নেমে আসলো। সবাই কানটা পেতে রাখলো কাসেমের ঠোঁটের দিকে। কথাটা শোনার কৌতূহলে কারো কারো আঙুলেই বিড়ি পুড়ছে, কারো কারো চায়ের কাপে নেমে আসছে হিমালয়ের শীতলতা!
হারাণ মাঝি অধৈর্য্য হয়ে ধমকের স্বরেই বললো,‘কাসু, এইডা তোর বদঅভ্যাস। গল্প শুরু কইরা জিরাইয়া জিরাইয়া কতা কছ। তাড়াতাড়ি ক তো দেহি; কি অইছে? নাইলে আমি ঘাটে যাই।’ এবার বিরক্তি নিয়ে কাসেম হারাণ মাঝির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ধূর মিয়া, বহো। কইতাছি।’ এবার সবাই আড়মোড়া দিয়ে বসলো। ‘গতকাইল রাইতে রমিজ মিয়ারে ভূতে ধরছিলো। ভোর রাইতে আযানের সময় আমি পিশাব করতে বাইর হইছিলাম। করুণ একটা গোঙানির শব্দ হুইন্না ভয় পাইয়া গেছিলাম। দৌঁড়াইয়া কুনুরহম জানডা লইয়া ঘরে গিয়া পড়ছি। তোমগো বউয়ের চিৎকার হুইন্না বাড়ির বেকতে উইঠ্যা পড়লো। পরে সবার সাথে আমিও কুপিবাতিডা লইয়া সামনে গিয়া দেহি ছাইয়ের পাড়াত রমিজ মিয়া চিৎ হইয়া গোঙাইতাছে। কি যে ভয়ংকর দৃশ্য! সারারাইত মনে হয় ধস্তাধস্তি করছে। রমিজ মিয়ার নাকে মুখে দেখি লোল বিজলা বাইর হইয়া গেছে। শইল্লের মইধ্যে লালচা দাগ। আযান না পড়লে মনে লয় মাইরাই ফালাইতো। আল্লায় বড় বাঁচান বাঁচাইছে রমিজরে’ -একটা গভীর নিঃশ্বাসে ফেলে একটু থামে কাসেম।
রাজমিস্ত্রি আবুল বেঞ্চ থেকে পা নামিয়ে বললো,‘গত পোরকা নাকি পুবপাড়ার কলিমুল্লা চাচারেও রাইতে আটকাইছিলো। এক পাও নাকি গাব গাছটার আগায়, আরেক পাও নাকি মাটিত আছিল। কল্লিমুল্লা চাচারে কইছিলো ঠ্যাংয়ের নিচে দিয়া যাইতো। কলিমুল্লাও চাচায় তো কম জানা লোক না! সূরা কিরাত পইড়া ফুঁ দিছে পরে নাকি ছাড়ছে।’
‘হ, গেলো বছর ছনু পাগলা ট্রাক একসিডিন্টে মরার পরেত্তে এই জায়গাডা দূষিত হইয়া গেছে। কবিরের মুরগির ফারোমের পর থেইক্কা ছনু পাগলার কবর পর্যন্ত কি ঘুটঘুইট্টা আন্ধাইর রে বাবা! গাব গাছের তলাটা আরো ভয়ংকর। দিনের বেলায়ও যাইতে গাও কাঁটা দিয়া উঠে। হুনছি একসিডিন্টে মানুষ মরলে নাকি ভূত হইয়া আহে। ছনু মিয়া তাইলে হাচাঐ ভূত হইয়া গেছে’- হারাণ মাঝিও গল্পে শরিক হয়। এবার ফজর আলী সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় এবং রমিজ মিয়ার সর্বশেষ খবর জানতে চায়। এমন সময় কাসেমের দোকানে আসে মেম্বার সাহেব। চেয়ার টেনে বসতে বসতে তিনি বললেন, রমিজ মিয়ার অবস্তা খুব একটা ভালা না। রমিজরে পানিতে বড়ইপাতা, নিমপাতা দিয়া গরম কইরা গোছল করাইছে। দাওয়ের আগাত নুন লইয়াও খাওইছে। তবুও তার রাইতের ব্যাপারটা যাইতাছে না। খালি কয় পাঁচটা পোলা নাকি তারে মারছে। ছায়ার মতোন নাকি পোলাগুলা আইয়া খুব জোরে জোরে মারছে! কওতো দেহি বেকতে কয় তারে ভূতে ধরছে। হারাণ মাঝি গলাটা একটু উঁচু করে বললো, ‘মেম্বার সাব, গতকাইল রাইতে তো রমিজ মিয়ারে আমি নদী পাড় করছি। মাউরা বাইত মনে হয় খুব বেশি মাল খাইছিল্। হাতেও এক বোতল আছিল্।’
০২.
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে রমিজ মিয়ার বাড়িতে। তিন বন্ধু; বিটুল, তমাল, শরীফও বড় মসজিদের হুজুরকে সাথে নিয়ে এলাকার বিখ্যাত ঘুষখোর বিচারক রমিজ মিয়াকে দেখতে যায়। মওলানা সাহেব পড়াপানি দিয়েছে। রমিজ মিয়ার বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে তিনি কিসব পড়ে ফুঁ দিয়েছেন। বিটুলরা অনেকক্ষণ ঐ বাড়িতে ছিলো। বিটুল রমিজের সামনেই লুঙ্গির কোচর থেকে একশো টাকার একখানা নোট বের করে হুজুরের হাতে দিলো আর বললো, ‘হুজুর, যোহরের নামাজের পর রমিজ দাদার লাইগ্গা মিলাদ ও দোয়া পড়াইবেন। আমরা জিলাপি আর আগরবাতি লইয়া আমু নে।’
গতকাল সন্ধ্যায়ও রমিজ মিয়া সালিশ বৈঠকে দুই নাম্বারি করেছে। রহিমের কাছ থেকে পনেরো’শ টাকা খেয়ে তার পক্ষে মিথ্যা রায় দিয়েছে। উপরন্তু নিরাপরাধ করম আলীকেই বর্ব অপমান করলো। করম আলী শিশুর মতো বুকে চাপড় দিয়ে বিলাপ করছিলো! আর দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহ কাছে নালিশ করেছিলো। অন্যায়ের বিচার চেয়েছিলো সে।
গ্রামের সবার মুখে একই কথা, রমিজকে ভূতে ধরছে। একেকজন একেকভাবে গল্পটা রসিয়ে কষিয়ে বলছে। তবে অনেকে খবরটা শুনে মনে মনে খুশিও হয়েছে। বিটুলরা করম আলীর খুপরি ঘরে ঢুকে বললো, ‘দেখছো চাচা, আল্লার মাইর শেষ রাইতে। তুমি নগদে বিচার পাইলা। তমাল, ট্যাহাগুলা আমার কাছে দে। ধরো, এহানে পনেরো’শ ট্যাহা আছে। রাখো। আবার ইস্কুলের সামনে তুমি ঝালমুড়ি বেচবা। আমগোরে মাঝে মাঝে একটু বেশি খাওয়াইয়ো কিন্তু।’ টাকাটা হাতে নিতেই করম আলীর চোখটা ছলছল করে উঠলো। তবে মুহুর্তেই শামুকের মতো কান্নাটা লুকিয়ে করম আলী মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাজানরা, হুনলাম ভূত নাকি পাঁচটা আছিল্? তয় এহন বাকি দুইটা কই?’ শরীফ বুদ্ধিজীবীর মতো উত্তর দিলো, ‘চাচা, রুমেল আর শাহিন ভূতের কথা হুনলে ডরায়....!-কথাটা শেষ হতেই না হতেই সবার হাসির শব্দে করম আলীর খুপরি ঘরটা কেঁপে উঠলো।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।