সত্তার মাতব্বরের স্বপ্ন
মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির
গতকাল তুলি চলে গেছে বিহঙ্গপুরূ জামাইবাড়ি। বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে তুলি। সবকিছু কেমন নিপুণ কৌশলে চুকে গেল একদম! বলতে গেলে বাংলা ফিল্মের মতনই; সিনেমার প্রথমার্ধে বহু ঝাপতাড়া কাটিয়ে কপোত-কপোতীর পিরিতবাসর। প্রেমখেলার ক’দিনের মাথায় প্রেমিকার বাড়িপক্ষ কর্তৃক জোরাজোরি করে বিয়ের পিরিতে বসানো। শেষমেশ লাগা গ্রামের পয়সাঅলা ব্যাংকার ছেলের হাতে গচ্ছিত রাখা। এইটুকু অবশ্য ঠিক ছিল তুলি আর শমসুর বেলায়ও। কিন্তু তুলির বরটা ব্যাংকারের পরিবর্তে হয়েছিল শিল্পবতী নওজোয়ান শিল্পবতী এটুকুই ফারাক। তার আরেক নতিদীর্ঘ আখ্যান। যাজ্ঞে আমাদের জানার বিষয় হলোতুলির বনিবনা হচ্ছিল না তার শিল্পবতী বরের সঙ্গে। যেভাবে ইন্ডিয়া আর জিম্বাবুয়ের ম্যাচটা পানিপানি হয় এমনই অবস্থা! তবুও সে চাচ্ছিল একপ্রকার সাধনা করেই মানিয়ে নিতে। ভাবছিলো দুনিয়া আর ক’দিনেরই। দেখতে দেখতেই চলে যায়! নাহ তা আর হলো কই! তুলির বরের পঁচাগলা লাশটা যেদিন মসজিদের পুরে ভেসে উঠলো তার পরদিনই তুলির বাবা সত্তার সাহেব তুলিকে ফিরিয়ে আনলেন নিজের দৌলতখানায়।
১.
শমসুর দুঃখবোধ জাগে তুলির জন্য। কুয়াশার আস্তরণের ভেতর অদূরে কোথাও গমগম আওয়াজে ডাকতে থাকে ডাহুক পাখি। ভাবনায় ডুবে দরদর ঘামতে থাকে সে। নৈঃশব্দের দীর্ঘতায় আচ্ছন্ন হয়ে ভাবেতুলি যদি আরেকটু কাজুমাজু করতো তার বাপের সাথে। তাইলে আর আজকের এই দূর্দশার ভার কাঁধে পড়তো না তার। বিয়ে করে সুখেই থাকতো শমসুর সাথে। তবুও সে দোষারোপ করতে চায় না তুলিকে। বছরতিনেকের গড়ে উঠা প্রেমকাব্যে সন্দেহের খাঁদ ঢুকাতে দ্বিধাবোধ করে শমসু। দীর্ঘক্ষণ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছেনাদানের মতো আবারও সে হাজির হবে সত্তার মিয়ার কাছে; একখানা শাদীর জন্য। সেই পুরোনো প্রস্তাব। পুরোনো নারীতুলি। শুধু মাঝখানটার গড়মিল, এটা সে ভুলে যাবে ইহকালের জন্য। জীবনের আর ক’দিনেরই!
২.
সত্তার মিয়া এবার ঠেলা বুঝেন। যদিও প্রতিশোধ বা ঠেলাধাক্কার কোনো কল্পনাই নেই দিলদার শমসুর। বিয়েটা তিনি দিবেন। মেয়েকে রাজি করান। রাজি করানোটা জরুর আসে। কারণ তুলি আর চায় না তারপুরোনো ঘা’তে মলম কিম্বা মরিচের গুঁড়ো ছিটাতে । কতজনই তো একা থাকে; ঘরকোণো হয়ে বা ভবঘুরে বেশে কাটিয়ে দেয় আস্ত একটা জীবন। তারও এই প্রতিজ্ঞা আজকাল। তাই সায় দেয়নি সে। বাবার কুঞ্চিত ললাট আর দিলফাঁড়া উৎকন্ঠার কাছে পরাভূত হয়ে এক পর্যায়ে রাজি হয় তুলি। চোখেমুখে নাটকীয় ঔজ্বল্য ছিটিয়ে রাজি হতে হয় তাকে! যেভাবে রাজি হয়েছিল প্রথম শাদীতে; শিল্পবতী বরের সাথে।
৩.
শমসু বেজায় খুশি। তার মুখ ফসকে উগড়ে যাওয়া কথাটি তাহলে বাস্তবতায় রঙিন হচ্ছে। তার মনে পড়েসে সত্তার সাহেবকে বলেছিল “আমি তুলিকেই বিয়ে করুম, ওরে ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো মেয়েরে ইসপর্শ করুম না আমি! হয়তো ওরে পামু নয়তো আজীবন একলাই থাকুম আমি।”
৪.
আরবি হিশাব অনুযায়ী আজ গত হয়েছে বুধবার রাত। একমাত্র মেয়ের জীবনভিটেয় সুখের প্রত্যাবর্তন দেখে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার এরাদা করেছিলেন সত্তার মাতব্বর। তা হয়নি বটে! ফজরের প্রারম্ভেই বিছানা ত্যাগ করেছেন। ওজু, এস্তেঞ্জা সেরে মসজিদের দিকে রওয়ানা হলে দেখলেন তুলির ঘরের দরজা থেকে একটা কপাট খোলা, হাবিয়া দোজখের দরোজার মতন উদাম । বেশ ভাবলেন না; শীতের আয়ত রাতূ তাকেও জাগতে হয় দু-তিন দফা! শীতের মৌন নির্যাতনে প্র¯্রাবের তাড়ায় নয়তো এমনিতেই ঘুম ভাঙে কখনো কখনো; এতোটা ভাবলেন কেবল। ঘরের গেইট বন্ধ করার জন্য রশিদকে হাঁক দিলে তারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না আজ! শরীর থাকলে তিনি এখন রশিদকে একটা গালি দিতেন “হালার পুত মরার ঘুম ঘুমাইছে” বলে। বয়েসের ভারে তা আর হয়নি বলে তিনি গেইটটা উদলা রেখেই মসজিদের পথ ধরলেন। বাড়ির ইটের তৈরি রাস্তা পশ্চাদে রেখে মূল পথে হাঁটতে লাগলেন । শীতল হাওয়া ভেদ করে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি। ভারী শীতের আবহ প্রকাশ পাচ্ছে তার গা-গতরে। তাই কুয়াশা মাপার জন্য দূরের দেশে তাকালে টাওর হলো কুয়াশা নেই তেমন একটা। ফলে গজ বিশেক দূরের বটগাছটাকেও চোখ কুঁচকানো ছাড়াই দেখা যাচ্ছে। আর ওই হতভাগা বটের ডালে আজও ঝুলে আছে আরেকখানা শীতল দেহ। এক মানবমূর্তি। বরফে জমে আছে একদম। এতো দূর থেকেও ঝুলদেহটা চেনা মনে হয় তার কাছে। গেল বছর যখন পুতুলের মা গলায় রশি দিয়ে মরলো তখনও সবার আগে যার চোখে লেগেছিল তিনি হলেনসত্তার মাতব্বর। তিনি আর মসজিদে যান না! রুটিন মাফিক ফজর ছুটে যায় তার। বেহুশ হয়ে ভাবা যায় কি না আমার জানা নেই তবুও ভাবেন সত্তার মাতব্বর তাইলে কি শমসু তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে—“আমি তুলিকেই বিয়ে করুম, ওরে ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো মেয়েরে ইসপর্শ করুম না আমি! হয়তো ওরে পামু নয়তো আজীবন একলাই থাকুম আমি।”
জিন্দাবাজার, সিলেট