শিলুক

 



শিলুক

আহাদ আদনান


‘এই, রিডল’টা বানিয়েছ’?

‘কী? কীসের রিডল’?

‘ভুলে গেলে? রিডল, ধাঁধা, হেয়ালি, শিলুক। আমাদের গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছি না? একটা শিলুক বানাও’।

‘উফ, ঘুমাও তো। রাত বিরাতে মাথায় ফেলুদা ভূত চেপেছে’।

ভূত চাপুক আর নাই চাপুক, এই লুকিয়ে রাখা ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উত্তেজনায় আছে নাহ্রুমা। অল্প কিছু স্বর্ণের গয়না করেছে ওরা। বড়জোর পনেরো ভরি হবে। বাসায় আলমারিতে তালা দেওয়া থাকে। মাঝেমাঝেই চুরি, ডাকাতির ভয় কাজ করে। কোথাও বেড়াতে গেলে, কিংবা দুইজনই যখন বাইরে থাকে, চিন্তা হয়। কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেলে তো বটেই। মধ্যবিত্তের সংসার। এক আসবাব থেকে আরেক আসবাবে স্থান পরিবর্তন করে লুকিয়ে রাখাটাই ভরসা।

তবে গত মাসে নিচের ফ্ল্যাটে ডাকাতি হওয়ার পর ওদের ঘুম উড়ে গেছে। ডাকাত মালপত্র আছে জেনেই এসেছিল। সেই তুলনায় ওদের সম্পদ খুব সামান্য। কিন্তু কী কষ্ট করে এগুলো করেছে, ওরাই জানে। আশিক কাজ করে একটা ওষুধ কোম্পানির সেলসে। মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটাছুটি, অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা, সারাক্ষণ চাপে থাকা এখন আর ভালো লাগে না। গ্রামের মাছের খামার থেকে বছরে দুইবার টাকা আসে। একটা ব্যবসা যদি দাঁড় করানো যেত। এই চাকরিটা আর করতে ইচ্ছে করে না। নাহ্রুমার স্কুলটা এই পাড়াতেই। সকালে গিয়ে কাজ শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে যায়। প্রিয় ভাতঘুমটা তার ছুটে যায় প্রায়ই। সন্ধ্যায় টিউশনের আগে পড়ন্ত বিকেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। এপাশ ওপাশ করতে করতে ডুব দেয় হুমায়ূন, মানিক, শরদিন্দু আর সত্যজিতের লেখায়। বই নয়, মোবাইলে পিডিএফে। ইদানিং আগাথা ক্রিস্টি, স্যার আর্থার কোনান ডোয়েলও পড়া হচ্ছে। গল্পের ফেলুদা, ব্যোমকেশ আর হোমস ভর করে তার মাথায়।

‘আজ পিতজা কিঙয়ে গিয়েছিলে, না’?

‘কিভাবে বুঝলে’?

‘তোমার শার্টের পকেটে মাশরুম আর গোল মরিচের গন্ধ পাচ্ছিলাম। ওদের মাশরুম স্যুপ গোল মরিচ দিয়ে খেয়েছিলে? বিলটাও তুমি দিয়েছ? কিছু খুচরা টাকা বেঁচেছিল? ওয়েটারকে টিপস না দিয়ে টাকাগুলো পকেটে ঢুকিয়েছ না? বেশি টাকা হলে মানিব্যাগেই রাখতে’।

পাক্কা দশ সেকেন্ড আশিক নাহ্রুমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে একটি কথাই বলে, ‘ইনক্রেডিবল’!

‘আমি বেশ গোয়েন্দা হয়ে উঠেছি, বলো’?

‘তাই তো দেখছি। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে দেখছি’।

‘তুমি স্কুল কলেজে কোনো গল্প, উপন্যাস পড়তে টড়তে? পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই কিনেছ কোনোদিন’?

বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে আশিক টয়লেটে পালায়। তবে আবার সে ধরা পড়ে রাতের বেলায়।

‘এই একটা গল্প পড়বে? গুপ্তধন। রবি ঠাকুরের লেখা ছোটগল্প। পড় না’।

‘পাগল হয়েছ। ঘুমানোর সময় ফাজলামি। আমি এখন ঘুমাব’।

‘ঘণ্টা ঘুমাবে। ফেসবুক, ইউটিউব টিপতে টিপতে ঘুমিয়েছ কোনোদিন দুইটার আগে? এখন বাজে মোটে পৌনে বারো। যাও, পড়তে হবে না। শোন ভালো করে’।

ইউটিউব থেকে একটা চ্যানেলের অডিও গল্প ঠিকই শুনে ফেলে ওরা। ঈশান কোনের ঈশানী, কহে দিলাম নিশানি। আশিক মজাই পায় গুপ্তধন শুনে।

‘এইবার যা বলি ভালো করে শোনো। এই ঈদে আমরা কাঠমা-ু  যাচ্ছি কনফার্ম। ধরো, এসে দেখলে খালি ফ্ল্যাটে ডাকাতি হয়ে গেছে। সব গয়না হাওয়া। কী করবে তখন’? 

‘সেটা আমি ভেবে রেখেছি। তোমাদের বাসায় আম্মার কাছে রেখে গেলেই হবে’।

‘জি না। আম্মা যাবেন কক্সবাজার। তিনি এই আগুনের কয়লা পাহারা দিবেন না, বলে দিয়েছেন’।

‘তাহলে তো সমস্যা। কাঠমা-ু ক্যান্সেল করতে বলছ’?

‘ধুর, সেটা বললাম কোথায়। তোমাকে এই গল্প কেন শোনালাম বোঝোনি’?

‘গুপ্তধন? দুইহাজার তেইশে ঢাকার ইস্কাটনের ফ্ল্যাটে তুমি গুপ্তধন লুকিয়ে রাখবে? আর ইউ ক্রেজি ম্যান’?

‘আমি কিন্তু সিরিয়াস’।

‘শুনতে তো মজাই লাগছে। কোথায় রাখবে গুপ্তধন? খাটের তলায়? এসির ইঞ্জিন বক্সে? ডিপ ফ্রিজে মাংসের ভেতর? বেসিনের পাইপের পিছনে? ডাকাতরা এসব জানে না? পাগল’!

‘আমাদেরতো সাবেকি আমলের খাট। জাজিমের নীচে যে কাঠের মোটামোটা তক্তা সেখানে তার নিচে আমরা ছিদ্র করে গোপন পকেট করব। এমনিতে কাঠ দিয়ে ঢাকা থাকবে। উপর থেকে বোঝা যাবে না। গয়না রাখতে গেলে কিংবা বের করতে গেলে তোমাকে তোষক, জাজিম সরিয়ে, কাঠ সরিয়ে নিচে শুতে হবে। শুয়ে গোপন কাঠের মুখ সরালে তারপর পাবে গয়না। আমাদের গুপ্তধন’।

‘তা এই কাজটা কে করবে শুনি? যেই কাঠের মিস্ত্রি দিয়ে এটা করাবে সেই যদি ডাকাত দলের সর্দার হয়’?

‘সেই দায়িত্ব আমার’।

সত্যি সত্যি এক সপ্তাহের মধ্যে কাজটা হয়ে গেল। নাহ্রুমার দেশের বাড়ি খুলনা থেকে ওর মামা একটা পুরনো কাঠের মিস্ত্রি নিয়ে আসল। অনেক কসরত করে এমন এক ব্যবস্থা হলো যেন, পুরো খাটটাই একটা সিন্দুক হয়ে গেল। কুঠুরি আছে, মালামাল আছে, কিন্তু দরজা জানালা নেই। ওর মামা যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন, ‘বুদ্ধিটা আমার পছন্দ হয়েছে রে মা’।

ওদের এখন সোনা কেনার নেশা ধরেছে। যেভাবে হোক অন্য বিলাসিতা ছেড়ে, টাকা জমিয়ে শুধু সোনা আর সোনা। গুপ্তধন জমা শুরু হতেই নাহ্রুমার মাথায় আরেক পোকা ঢুকল।

‘গুপ্তধন তো জমাচ্ছি। ভুলে গেলে এটা খুঁজে বের করার একটা সূত্র বের করতে হবে কিন্তু’।

‘মানে কী? ভুলব কেন’?

‘ধরো দুজনেই বুড়ো হয়ে গেলাম। আলঝেইমার্স হয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। তখন কী করবে?

কিংবা আমাদের একটা বাবু হলো। একদিন দুম করে আমরা মরে গেলাম। ওকে বলে যেতে হবে না সম্পদের কথা? পাবে কিভাবে এসব’? 

কথাটা বলেই চুপ হয়ে যায় সে। বিয়ের আট বছর হয়ে গেছে। সন্তান না হওয়ার দুঃখটা এখনও বুকে দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে। সময় সময় লবণের ছিটা পড়লে ঘা তো জ্বলবেই। প্রসঙ্গটা হালকা করতে আশিকই কথাটা পারে।

‘জানো আমাদের গ্রামে নানী দাদিরা মুখে মুখে সুন্দর সুন্দর ধাঁধা বানাতো। কিশোরগঞ্জের সেই গ্রামে আমার সন্ধ্যা কাটত ধাঁধা মিলিয়ে। দাদি অবশ্য বলত শিলুক। আমি কিন্তু শিলুক ভাঙাতে ওস্তাদ’।

নাহ্রুমা খুশি হয়ে ওঠে।

‘তুমিই তাহলে একটা শিলুক বানাও। ছড়ার মত শিলুক। আমরা মুখস্ত করে রাখব। কিংবা লিখে রাখব। ডাকাত এসে পড়ে ফেললে বুঝবে না কিছুই। গল্পের ডাকাতের মতো এতো আইকিউ আছে নাকি ঢাকার চোরদের’?

আশিকের একটা প্রমোশন হয়ে গেছে। আবার বন্ধুরা মিলে কম্পিউটার মার্কেটের দোকানটাও জমিয়ে ফেলেছে। ওজনও বাড়ছে ইদানিং। ‘বড়লোক’ মানুষের লক্ষণের মত প্রেশার বাড়তির দিকে, গ্লুকোজ বাড়তির দিকে আর কোমরে ব্যথা হচ্ছে রাত বিড়াতে। রাতে শোয়ার সময় কোমরের নিচে হটব্যাগ রেখে ওরা এখন আলোচনা করে ‘রিডল’ কিংবা শিলুক নিয়ে। গত সপ্তাহে আরেকটা ডাকাতি হয়ে গেছে পাশের বিল্ডিঙে। ‘সবাই কি আমাদের মত চালাক’, ভাবে ওরা।

‘এই আমি কিন্তু একটা শিলুক তৈরি করে ফেলেছি। শুনবে’?

‘ওয়াও, শুনব মানে। বলো বলো’।

‘সারে সারে শোয়া থাকে গড়ানের ডাল,

মিয়া বিবি গুটিসুটি, মাকড়ের জাল,

শিলা বুকে বাসা বাঁধে ঝিনুকের নাল,

সাবধান সাধু, আসে মহা কলিকাল’।

‘অসাধারণ। অবিশ্বাস্য। তোমার এত প্রতিভা আগেতো বলোনি। দাঁড়াও লিখে রাখি। নয়তো ভুলে যাবো’।

‘দেড়টা বাজে। সকালে লিখলে হয় না’?

‘না, হয় না। এই যে আমার বিখ্যাত ডায়রি। আবার বলে ফেল সোনামণি’।

মুক্তোর মতন সুন্দর হাতের লেখায় শিলুকটা লিখে ডায়রিটা বালিশের পাশেই রেখে দেয় নাহরুমা। আবার শুরু হয় গল্প। আজ ওদের ঘুম উড়ে গেছে। যদিও কাল মঙ্গলবার, অওর্কিং ডে, তবু কোনো ভাবনা নেই। কালকের কথা কাল ভাবলেই হবে। 

আজ দুজনেরই ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। কিশোরগঞ্জের হাওরে মাছ ধরা, খেতে সরিষা লাগানো, বরষায় চাপটি খাওয়া। কিংবা খুলনায় ট্রলার করে সুন্দরবনে ঘোরাঘুরি, আখের খেত, চিনির মিলের কোয়ার্টারের বিকেল। ওরা যতক্ষণে হাতের তালুর ঘাম, বাতাসের অক্সিজেন অণু ভাগাভাগি করে নেয়, হঠাৎ করে একটা ঝাঁকুনি ওদের কাঁপিয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের আলোড়ন।

‘এই ভুমিকম্প হচ্ছে’?

‘তাই তো মনে হচ্ছে’।

কথা শেষ হয় না। আবার প্রচ- কম্পন। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়েছে ওরা। চারদিকে চিৎকার হচ্ছে। 

‘বের হও তাড়াতাড়ি। আল্লাহ গো, রক্ষা করো’।

‘এক সেকেন্ড। গয়নাগুলো নিয়ে নিই’।

নাহরুমা কিছু বলার আগেই বাঁকা হয়ে জাজিমটা উঠাতে যায় আশিক। আর তখন মেরুদ-ের নিচে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ হতেই ব্যথায় আর্তনাদ করে বসে পড়ে সে।

‘আল্লাহ গো, কী করলে তুমি’?

এমন লম্বা ভুমিকম্প আগে হয়নি এই শহরে। আশিক উঠতে পারছে না। রাহনুমা অনেক কষ্ট করেও ওকে নড়াতে পারছে না। সম্পদ, গয়না, গুপ্তধন, শিলুক, ওদের পৃথিবী থেকে কর্পূরের মত সব উবে গিয়ে একটাই সত্যি পড়ে থাকে। ভয়ঙ্কর, প্রলয়ঙ্করী ভূকম্পন।

পরেরদিন সকাল। এই শহর কারও চেনা নয়। ধ্বংসস্তুপ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা এ যেন এক মৃত্যুপুরী। চারদিকে লাশের সারি। আহতের আর্তনাদ। কংক্রিটের জঙ্গলে উদ্ধার তৎপরতা থমকে আছে। এমনকি মিডিয়ার লেন্সের ঝলকানিও নেই তেমন। 

অসংখ্য মৃতদেহের মাঝে ইস্কাটনের এই রাস্তায় পড়ে আছে একজোড়া নরনারীর লাশ। মেয়েটা এখনও জড়িয়ে রেখেছে ছেলেটাকে। 

বিয়ের কলেমা নামের মহা সেই শিলুকে মিলেছিল যেই গুপ্তধন, মৃত্যুর সময়ও তাকে হাতছাড়া হতে দেয়নি লোভী মেয়ে আর ছেলেটা। মানবজীবনের মতো এমন সোনার খনি কি আছে আর?   


মাতুয়াইল, ঢাকা। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট