মাজরুল ইসলাম
[গত সংখ্যার পর...]
মহীপাল: সাগর দিঘী থানার একটি ছোট গ্রাম মহীপাল। এই নগরে রাজধানী ছিল পাল রাজাদের। এখনও মহীপাল নগরীতে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দাক্ষিণাত্যের রাজা রাজেন্দ্র চোল আনুমানিক ১০২০-১০২৩ সমরাভিযান চালিয়ে মহীপালকে পরাজিত করে এবং রাজ্য লুণ্ঠন করেন।
কিরীটেশ্বরী : মুর্শিদাবাদ জেলায় হিন্দু দেবালয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম মন্দির। মূল মন্দির সংলগ্ন আরও ছোট ছোট অনেক মন্দির দৃশ্যমান। ঐতিহাসিকদের ধারণা এই মন্দিরের নির্মাণকালথ ১৪৬৫ খ্রীষ্টাব্দ। বাহান্ন পীঠের একটি পীঠ বলে এই স্থানের নামথথ কিরীটেশ্বর বিজয় রায় সেন বিরচিত ‘তীর্থ- মঙ্গল’ কাব্যে কিরীটেশ্বররীর বর্ণনা আছে। রিয়াজুস সালাতীন ও রেনেলের কাশিমবাজার দ্বীপের মানচিত্রে কিরীটকোনাকে ‘তীরতকোনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। ১৭০৪ সালে দর্পনারায়ণ রায় ডাহাপায়ায় আসেন। এখানে এসে এই মন্দিরের সেবার যথেষ্ট বন্দোবস্ত করেন। অনেকদিন তাঁদের হাতে দায়িত্ব ছিল। দর্পনারায়ণ রায় মন্দিরটির পুনঃনির্মাণ ও কালী সাগর নামে পুকুর খনন করে দেন। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে আজও হাজামজা অবস্থায় পুকুরটি দৃশ্য মান। পৌষমাসের প্রতি মঙ্গলবার কীরীটেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ পুজো ও সারা মাসব্যাপী মেলা চলে। দেশ বিদেশের প্রচুর ভক্তদের সমাগম হয়। লালবাগ কোট স্টেশন থেকে তিন মাইল দূরত্ব।
খেরুর মসজিদ: সাগরদিঘী থানার অন্তর্গত খেরুর এক ছোট গ্রাম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন মসজিদ এটি। জনশ্রুতি আছে, এই মসজিদটির আশপাশ থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত যুগের বহু নিদর্শন। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের দেওয়ালে দৃষ্টি নন্দন টেরাকোটা কাজের শৈল্পিক ভাবনার বহির্প্রকাশ দেখতে পাবেন। মসজিদের প্রধান দরজা উপরে একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ৯০০ হিজরীতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্দেশে মোয়াজ্জেম রিফাত খাঁ নির্মাণ করেন।
কসবা বাহাদুরপুর: মোঘল শাসন শুরু থেকে গড়ে ওঠে কসবা। কসবার মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা থানার কসবা বাহাদুরপুর সর্বপ্রথম। ১৫৭৪-১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কসবা বাহাদুরপুর গড়ে উঠেছিল। প্রাদেশিক রাজধানী গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদে কিন্তু বড় বাজার গড়ে উঠেছিল কসবা বাহাদুরপুরে। ভগবানগোলা থানার ৫৬ নং গ্রাম। তৎকালে এখানে একটি নীল উৎপাদনের কারখানা ছিল। নীল চাষের কাজে ব্যবহৃত পুকুর আজও দৃশ্যমান। কিন্তু কারখানার নালা সবই লুপ্ত হয়ে গেছে। আখেরীগঞ্জ ভগবানগোলা রাস্তায় মাঝামাঝি নহর সংলগ্ন এই গ্রামটি। একসম প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল এখানে। কসবা বাহাদুরপুর গ্রামের অদূরেই বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান বুধুর তেলিয়াপাড়া। বাঙলার সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র বাহাদুর সিংহাসন অধিকার করেন। বাহাদুর অধুনা বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলার ঘিয়াসাপুরে ‘ঘিয়াসাবাদ’ নামে একটি শহর ও বাজার গড়ে তুলেছিলেন। তার কারণ লক্ষ্ণৌতির সঙ্গে এই শহরের নিরাপদ এবং অদূরে। সহজে যাতায়াতের জন্য এই শহর গড়েছিলেন। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ লক্ষ্ণৌতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে আসছেন শুনে বাহাদুর শাহ সপরিবারে ঘিয়াসাবাদে আত্মগোপন করতে চেয়েছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের নির্দেশে কেন্দ্র বাহিনী লক্ষ্ণৌতির দখল নিলে বাহাদুর সেখানে থেকে ঘিয়াসাবাদ পালিয়ে যান। জলপথ পরিত্য্যাগ করে স্থলপথ ধরেন। এবং সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা, আলাইপুর, আখেরীগঞ্জ রাজশাহী সড়ক পথেই পালিয়ে যাবার পথ। কিন্তু শরীর বইতে পারছে না দেখে বিশ্রামের জন্য বাহাদুরপুরে ডেরা করেন। এই সুবাদে বাহাদুরের নামে গ্রামের নাম হয়েছে বাহাদুরপুর। ক্রমে কসবা বাহাদুরপুরে পরিণত হয়।
মোঘল টুলি ও আকবর নগর: বঙ্গপ্রদেশে মোঘল আধিপত্য বিস্তার করার পর থেকেই শাসন কার্য চালিয়েছে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। যেমন গোয়াস, মোঘল টুলি প্রভৃতি। আকবরপুরের সাবেকি নাম আকবরশাহী। বর্তমান আকবর পুর। সম্রাট আকবরের আমলে তাঁর অগণিত টাকশাল ছিল। আকবরের যে টাঁকশাল গুলোর নাম জানা যায়, তার মধ্যে সব টাঁকশাল থেকে সব ধরনের মুদ্রা নির্মাণ হতে না। তামার মুদ্রা প্রস্তুতকারী টাঁকশাল গুলোর মধ্যে প্রথম নাম এসে যায় আকবরপুরের নাম। তাঁর শাসনকালে বাঙলা সুবেহে প্রথম টাঁকশাল গড়ে আকবরপুরে। দ্বিতীয় টাঁকশাল গড়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ জনপদের জাফরাগঞ্জে। মোঘল টুলি, আকবরপুর গ্রামদ্বয়ের নামের সঙ্গে সম্রাট আকবরের নাম সংপৃক্ত। মোঘল সুবেদার ও সিপাহসালার মুনিম খাঁ,খান-ই-খানান ২৫ সেপ্টেম্বর ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দে আফগান সুলতান দাউদ কাররানির সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এবং যুদ্ধে মুনিম খাঁ জয়লাভ করেন। তখন থেকে বাঙলা দিল্লির অধিনে আসে। যুদ্ধ চলাকালীন সম্রাট আকবর নিজে যুদ্ধ সামগ্রী ও খাদ্য নিয়ে আসেন। মুকসুসাবাদ শহরকে নিরাপদ স্থান ভেবে এখানেই শিবির স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের সেনা বাহিনী যেখানে থাকত সেখানকার নামকরণ হয় আকবরপুর। আর সম্রাট যেখানে থাকতেন সেখানকার নামকরণ হয় মোঘল টুলি।
জাফরাবাদ: সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর স্থলাভিসিক্ত হোন তাঁর পুত্র সিকন্দর শাহ। বাঙলাদেশের সোনারগাঁও সরকারের পদ ও ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দিন মুবারক শাহর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সাতগাঁও ও সরকারের সুবেদার ইজজউদ্দিন ইয়াহিয়া এবং লক্ষ্ণৌতির সরকারের সুবেদার কদর খাঁ। এমন সময় সোনারগাঁওর সরকারের সামান্য আরমার-বিয়ারার ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল ও স্বাধীনতা ঘোষণা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে সমগ্র বাঙলার নিন্দা মনে করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও সমরাভিযান করলে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের পরাজয় হয় এবং পালিয়ে গিয়ে বাগড়ীর অজ গ্রামে আত্মগোপন করে। জাফর খাঁ ছিলেন রাজস্ব বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের রাজকর্মচারী। তাঁর সুপারিশে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের পুনর্বহাল হোন। ফখরুদ্দিন মুবারকের শাহের জামাতা ছিলেন জাফর খাঁ। জাফর খাঁ শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেন। এই কথা জানতে পেরে সিকন্দর শাহ ঘটনার সত্যাসত্য প্রশ্নে সেনা অভিযান করতে বলে। দিল্লির সেনা বাহিনী রাজমহল, সুতি, লালগোলা, আলাইপুর পথে এগিয়ে আসে। এমন সময় লক্ষ্ণৌতির সামরিক বাহিনী হাজির হয়। উভয় পক্ষ যুদ্ধ করে। সেই থেকে এই স্থানের নাম জাফরাবাদ। গ্রামটি বর্তমান অধুনা রানিতলা থানার অন্তর্গত।
রানিতলা: মুর্শিদাবাদ জেলার অধুনা রানিতলা থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। গ্রামটি প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। ১৮৫২-১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের রাজস্ব জরীপে যথাক্রমে ৬৮ ও ৬৯ নাম্বার গ্রাম দু’টোর সম্মিলিত রুপ রানিতলা। জেলা জরীপে একত্রিত করা হলে নামকরণ হয় ‘রানীতলাশ’ বর্তমান রানিতলা নামেই পরিচয় লাভ করেছে। অতীতে ইংরেজরা পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করে। পুলিশ ব্যবস্থা বলবৎ করতে ‘রানীতলাশ’ নামে পুলিশের প্রশাসনিক বিভাগ চালু করে এবং পরে এখান থেকে থানা চলে যায় ভগবানগোলায়। দীর্ঘদিন পর রানিতলায় পুনরায় থানা গঠিত হয়েছে। রানী ভবানীর এখনো অনেক স্মৃতি দৃশ্যমান। রানিতলা হাট প্রাচীনত্বের দাবিদার। এই হাটের জন্ম, ১৮৮০ সাল। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে মঙ্গলবার ও শুক্রবার।