আগের জন্মে মানুষ ছিলাম!
আসহাবে কাহাফ
পাখি হয়েই জন্মেছি বলে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও বেঁচে থাকতে হয়! আচ্চা, পরের জন্মে মানুষ হয়ে জন্মালে কেমন হয়?
ধুর বোকা, পাখির আবার পরের জন্ম! যেখানে আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষেরই কোনো পরের জন্ম হয় না, সেখানে পাখি ও পরের জন্ম!
কালো পাখিটির এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভরা মন্তব্যে, লাল পাখিটা কিছুটা নড়েচড়ে উঠল। তারপর, বলল; মানুষ যে বলে, আমি পরের জন্মে এই হবো, ঐ হবো, সেই হবো! তাহলে, এ গুলো কি মিথ্যা?
হ্যাঁ, এসব মিথ্যা, মানুষের পরের জন্ম বলতে কিছু নেই, যা আছে তা, মৃত্যুর পরের জীবন, যেমন মৃত্যুর পরপর যে জীবন শুরু হয়, সেটা কবরের জীবন। কবরের জীবনের পর মানুষ যেখানে জেগে উঠবে, শেষ বিচারের আশায়, সেটা হাশরের জীবন। এরপর অন্তত কালের জান্নাত বা জাহান্নামের জীবন!
লাল পাখিটার এমন লম্বা ও গম্ভীর প্রতিত্তোরের প্রতি একধরনের অনীহা থেকে, কালো পাখিটা বলল, চল, দূরে কোথাও উড়ে যায়।
পৃথিবীতে পাখিদের কোনো সীমানা নেই, সীমাবদ্ধতা নেই, নেই পাসপোর্ট কিংবা ভিসা নীতি, ফলে যখন যেখানে উড়ে যেতে পারে; সূদুর সাইবেরিয়ায় শীত বেশি হলে যেমন, উড়ে উড়ে বাংলাদেশে চলে আসা যায়, একইভাবে, বাংলাদেশে বসে মন-খারাপ হলেও, উড়ে উড়ে যাওয়া যায়, হিমালয়ের দেশে অথবা আরব দেশের মরুভূমির কোনো এক পর্বতশৃঙ্গে। তবে, ইনসান এসব পারে না কেন? ইনসান ত সৃষ্টির সেরা জীব। লাল পাখিটার প্রস্তাব শোনে দুটো পাখি উড়াল দিল আকাশের বুকে।
উড়ে উড়ে ক্লান্ত পাখি দুইটা গিয়ে বসল, একটা গাছের মগডালে। গাছটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে জলাশয়ের পাড় ঘেঁষে।। মাঝে-মধ্যে হালকা বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ে উঠছে, কিন্তু কোনো শিকারী বা দুষ্ট ছেলেদের ঢিল ছুটে আসার ভয় এখানে নেই। গাছটার পাতা গাঢ় সবুজ, কোনো ফল নেই, ফুল নেই; তবে কিছু নতুন পাতা ফুটেছে। হালকা সবুজ রঙের এসব নতুন পাতা দেখে, লাল পাখিটা বলল, এখানে থাকা যায়, হয়তো কিছুদিন পরেই মুকুল আসবে, তারপর ফল।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, মানুষের মত, পাখিরা গাছের নাম জানে না, ফুলের নাম জানে না, ফলের নাম জানে না! তবে, কোনটা খাদ্য আর কোনটা অখাদ্য তারা ভালো করেই জানে। এ একজায়গায় মনে হয়, মানুষের চেয়ে পাখিরা এগিয়ে। ইদানীং মানুষ যা খাদ্য তাও খায়, যা অখাদ্য তাও খায়, কোনো বাছ-বিচার নেই। মানুষ ভালো চালের ভাত খায়, দামি দামি মাছ- মাংস খায়, আবার সুযোগ পেলেই ঘুষ খায়, সুদ খায়! অথচ, পাখিদের এমন জীবন, সে যা প্রয়োজন কেবল তা খায়, কোনো সংগ্রহ শালা নায়, সঞ্চয়ের চিন্তা নায়, বাসায় ফ্রিজ নায়। তাই মানুষের মত অত জুলুম শোষণের প্রয়োজন পড়ে না। কিছুক্ষণ পর পাখি দুইটা ধীরে ধীরে আরো নিচের দিকে একটা শক্ত ডালে নেমে আসল। ডালটা কিছুটা জলের কাছাকাছি। উপর থেকে দেখা যায়, স্বচ্ছ জলের উপর নিজেদের ছবি ভেসে উঠেছে। লাল পাখিটা কালো পাখির উদ্দেশ্যে বলল, আজকে তোমাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। দেখ, তোমার মাথা, ঠোঁট, পাখনা কী ঝরঝরে!
কালো পাখিটা সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না দেখে, লাল পাখিটা আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মন খারাপ?
না।
তবে এত চুপচাপ যে?
ভাবছি, তুমি কত সুন্দর করে জীবনের কথা বল, আশার কথা বল, তোমার মত সঙ্গি পেয়েছি, আমি কতই না ভাগ্যবান।
ধুর তুমি, সবসময় বেশি বেশি বল। এসবই ত আমার কাজ, সবসময় আমার সঙ্গীর পাশে থেকে, তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়া, খারাপ কাজে নিষেধ করা, ভালো কাজে সহযোগিতা করা। আচ্চা, বল ত, মানুষগুলো কেন আমাদের মত হয় না? কেউ কারো ভালো সহ্য করতে পারে না, প্রসংশা করতে পারে না, উপকারে এগিয়ে আসে না। পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে না। কেবল, অন্যের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করাই কি মানুষের ধর্ম?
লাল পাখিটা চিন্তা করল, সত্যিই তাই। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে বিনা মতলবে কখনোই অন্যের প্রসংশা করে না। সারাক্ষণ, একে অন্যের দোষ খুঁজে, গীবত করে, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কোনো শ্রদ্ধা নেই, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কোনো দায়িত্ববোধ নয়, যা আছে তা কেবল কাম আর কাম! এবার সে কালো পাখির দিকে, তাকিয়ে বলল, চল গোসল করি।
মানুষের মত পাখিদের হয়তো পর্দার বিধান নেই, তাই, পাখি হলে, যেখানে সেখানে গোসল করতে পারা যায়। লজ্জাস্থান ঢাকার কোনো পায়তারা নেই। আবার, মানুষের মতো, আশে-পাশে কেউ আড়ি পেতে আছে, গোপনে ভিডিয়ো করছে এমন কোনো ভয়ও নেই। কিন্তু আমরা যারা মানুষ, তারা এক অদ্ভুত প্রাণী, যে জানে, সেখানে কেউ, গোসল করছে, হোক সে নারী বা পুরুষ, এটা গোসলের স্থান; তারপরও আমরা উঁকিঝুঁকি দিই। কী বিচ্ছিরি! গোসল শেষে দুটো পাখিই আবার মগডালে উঠে এসেছে। এখানে রোদের ঝিলিক খেলা করছে নতুন পাতার শরীরে। লাল পাখিটা তার ঠোঁট লাগিয়ে দিয়েছে, কালো পাখির ঠোঁটে, তারপর গলা বেয়ে পালকের নিচে, এভাবে কয়েকবার সে কালো পাখির চারপাশে প্রদক্ষিণ করে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। কালো পাখিটা বার কয়েক ডানা ঝাপটা দিয়ে দুজনেই আবার উড়ে গেল। কোথায় উড়ে গেল? পৃথিবীতে বড়ো বড়ো পাখিদের ত নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই, বাড়ি নেই, কেবল বাবুই আর চড়–ই পাখি ছাড়া। পিছুটানও নেই, যার মায়ায় সাঝবেলায় আবার ফিরে আসতে হবে! তারপরও কি পাখিরা ফিরে আসে? মানুষের মত? প্রতি সন্ধ্যায়? প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে? মানুষ ফিরে আসে, আসতেই হয়; আপন নীড় ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের আর কিছুই নেই, এ পৃথিবী তার কাছে যথেষ্ট ছোটো, যে বাধা পড়েছে, মায়ার কাছে, মানুষের কাছে, প্রেম ও প্রনয়ের কাছে। তাহলে, পাখিদের কি স্বজাতির প্রতি প্রেম নেই? প্রনয় নেই? কে জানে!
উড়তে উড়তে বহু পথ পাড়ি দিয়ে পাখি দুইটা এবার পৌঁছে গেল বঙ্গভবনের আঙ্গিনায়, সারি সারি গোছানো গাছ, নানা রঙের ফুলের বাগান। এসব তাদের ভালো লাগে, প্রায় তারা এখানে আসে, এখানকার সবকিছুই যেন, ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরছে, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, জটলা নেই, গ্যাঞ্জাম নেই। অদ্ভুত নীরবতা তবে, ব্যস্ততার কমতি এখানে কোনো কালেই ছিলো না। ইতোমধ্যে বঙ্গভবনে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ, আশেপাশে আরো কিছু পাখি দেখা যাচ্ছে, যে যার যার মত, গাছে গাছে উড়ছে, নিচে নামছে, খাচ্ছে, কেউ বা নিজস্ব সুরে গান করছে। এমন সময় লাল পাখিটা খেয়াল করল, বঙ্গভবনে প্রবেশ করছে রাষ্ট্রপতির গাড়ির বহর। কিন্তু, আজ যে মানুষটা গাড়ি থেকে নেমেছে, যাকে সবাই চতুর্দিকে ঘিরে আছে, তাকে পরিচিত মনে হচ্ছে না! সে কালো পাখিকে ডেকে বলল, শোনছ? দেখ ত, আজকে যিনি প্রবেশ করছে, তাকে কি তুমি চিন? এ লোকটাকে ত আগে কখনো দেখিনি! এতদিন যে লোকটা ছিলো, সে কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?
কালো পাখিটা তখন বলল, আরে বোকা, এ লোকটিই হল, এদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি, গতকালই যিনি রাষ্ট্রপতি ছিলো, এর আগেও যারা রাষ্ট্রপতি ছিলো, এখন তারা নাই, তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ।
কী বল এসব? ক্ষমতা আবার কী? আর যদি ক্ষমতা নামক কোনো কিছু কারও কাছে থাকে, তার আবার মেয়াদ থাকবে কেন?
সে তুমি বুঝবে না!
বুঝব না কেন? তুমি কি এটা ভুলে গেছ, এদেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন মেয়ে! মেয়ে হয়ে যদি, তিনি একটা দেশ চালাতে পারে, আমি কেন বুঝব না, ক্ষমতা কী? ক্ষমতার মেয়াদ কী? তুমি বল, আমি বুঝব।
পৃথিবীর এ আরেক অদ্ভুত নিয়ম, পাখি হোক আর মানুষ, সবজায়গায় স্ত্রী তথা মা-জাতিকে অবলা ভাবা হয় কেন? কেন ভাবা হয়, তারা সবকিছু বুঝবে না, জানবে না! এটার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তবে, মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, আসলেই কি তারা কম বুঝে? এসব প্রশ্নের সদুত্তর আছে নেই। কালো পাখিটার এ জবাব শুনে, লাল পাখিটা কিছুটা বিব্রতবোধ করল। তারপরও, নিচু স্বরে বলল, আচ্চা, বলছি তবে, মনযোগ দিয়ে শোন। ক্ষমতা হল, নিম্নবর্গের উপর উচ্চবর্গের কর্তৃত্বের মাপকাঠি! যার কথায় যত দ্রুত কোনো কাজ সম্পন্ন হবে, যে কোনো কাজ যত দ্রুত শেষ করতে পারবে, বুঝতে হবে তার ক্ষমতা তত বেশি। আর, এ যে মুখের কথায় কাজ করানোর বা নিজে কাজ করার যে যোগ্যতা সেটাই ক্ষমতা। আর তুমি বললে না, ক্ষমতার আবার মেয়াদ, আসলে সবকিছুরই একটা মেয়াদ থাকে, ক্ষমতা যে যাকে দেয়, সেই একটা মেয়াদ দিয়ে দেয়, মেয়াদ শেষে সে ক্ষমতা আর কারো থাকে না, যদি কোনো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কাউকে দেয়, সেটার যেমন একটা মেয়াদ থাকে, তেমনি মানুষ যদি কাউকে কোনো ক্ষমতা দেয়, তারও একটা মেয়াদ থাকে। সে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই মানুষ তার আপন জায়গায় ফিরে যায়। যাক গে, আগের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এখন আর নেই, এ যে নতুন মুখ দেখছ, তিনিই এখন এদেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক।
তাহলে আগের যে রাষ্ট্রপতি ছিল, তিনি এখন কোথায়?
তিনি তার নিজ বাড়িতে, নিজের কাজকর্মে ব্যস্ত।
তাকে কি এখন আর এতে নিরাপত্তা দেওয়া ও সেবা করার মানুষ আছে?
না!
কী বল? তাহলে একদিন, এখন যিনি নতুন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, তাকেও এখান থেকে চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
যদি এসব স্থায়ীই না হয়, তবে কেন তিনি এত আরাম আয়েশে অভ্যস্ত হচ্ছেন? তিনি ত স্বাভাবিক জীবন-যাপন করলেও পারেন।
জানি না! চল, দূরে কোথাও যায়।
পাখি দুইটা আবার উড়াল দিল আকাশের দিকে। পাশাপাশি উড়তে উড়তে কালো পাখিটা বলল, তুমি কি পরের জন্মে মানুষ হবে?
উত্তরে লাল পাখিটা বলল, আমি আগের জন্ম মানুষ ছিলাম!