উঠতি বাজির ঘোড়া
মাহমুদ নোমান
যে লেখক লিখতে এসে কাগজের পর কাগজে নিজের ভাব বোধকে অক্ষরে তুলে ধরতে নিরলস সাধনায় মগ্ন থাকতেন, তিনিও আজ বার্ধক্যে এসে প্রাণপণে ফেইসবুকে কবিতা গল্প নিজের মতামত বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে ঢেলে দিচ্ছেন। প্রতিজন লেখকের ফেইসবুকের সময়খাতাটি একেকটি সাহিত্য পাতা। কারও দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। আগে পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে একখানা চিঠিও লিখতো, জীবদ্দশায় কখনও সাহিত্য সম্পাদকের সাথে সশরীরে দেখা হবে কীনা প্রশ্ন ছিল সেটি এখন বার্তাবক্সে সেরে যায়। উল্টো সাহিত্য সম্পাদকের পোস্টে লাইক কমেন্ট না করলে গোস্বাটি দ্বিগুণ ফুঁসে ওঠে আরেকজন লেখকের পোস্টে লাইক কমেন্টে বেশি প্রশংসা করতে দেখলে। ভীষণ অভিমানে লেখা আর ছাপেন না। এরমধ্যে সাহিত্য সম্পাদকের দাম বেড়েছে এই মর্মে সাহিত্য সম্পাদক আরও বেগবান বিস্তারে শক্তিশালী হয়ে উঠেন নিজে নিজে। লেখা ছাপা হবে না এই ভয়ে কেউ কেউ প্রকাশ্যে হঠাৎ ঝলকে আগল খুলে প্রকাশ্যে হে হে উচ্চকণ্ঠের মতামত রাখে। এসবের কসরতে পত্রিকায় ছাপা হওয়া লেখাটিই কবি ছবি তুলে কানে ধরে এনে বুড়ো আঙুলে চেপে মুখবইয়ের সময়খাতায় তুলে দেন, জাতি যেন হৈচৈ করে ওয়াও, নাইস, কংগ্রেটস্, কংগ্রেচুলেশন, অভিনন্দন জানান... অর্থাৎ মুখবইয়ের (ফেইসবুক) সময়খাতা (টাইমলাইন) একমাত্র সত্য, আসল....
সেই সময়ে এসে কেউ ছাপা হওয়া বইয়ের শিল্পকে বুকে লালন করবে, এটা হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখার মতোই। যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হৈচৈ করে বাড়ছে প্রতিদিন। খাওয়ার জিনিস, পরার জিনিসের দাম যেখানে বাড়ছে বইয়ের কাগজের দাম না বেড়ে থাকেনি। আগেই বলেছি ফেইসবুক থাকতে সব ফেইক, ছাপা হওয়া বই কেন পড়বে যদি সেটি ফেইসবুকে পাওয়া যায়? অপরজনেরা মাংস চিবোচ্ছে প্রতিবেলা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে বুঝে এখন অনেক টাকার মালিক হওয়া, আগে যেখানে মুরব্বিরা বলতো - মানুষ হও....
এই যে মানুষ হতে জ্ঞানীর কথা পড়তে হবে। সেসব জ্ঞানী ভালো মানুষ সব তো এখন ফেইসবুকে। সারাদিন দুর্নীতি করে ফেইসবুকে এসে কাউকে একটা কম্বল দান করছে সেটি পোস্ট দিয়ে ভালো মানুষ সাজে, ব্যস্ত ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে ঘুম.....
এরপরে ঐ মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জন শুধু টাকা কামানোর জন্য আর টাকা কামাতে দুর্নীতি যে যেরকম চমৎকার করে পারে এইরকম ব্যাপার....
এই সময়ে ছাপা হওয়া বই করার স্বপ্ন যাঁরা দেখে অর্থাৎ লেখকের স্বপ্নকে সবার সম্মুখে তুলে ধরে যেসব মানুষ তাঁদেরকে সত্যিকারের মানুষ মনে হয়। আলাদা খুশবু পাই তাঁদের শরীর থেকে। আবার তাঁরা যদি হয় বয়সে চল্লিশের আগে, তাহলে এরা নিষ্পাপ....
এদেরকে লালন করার যতœ নেওয়ার সেই স্পর্ধা রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরও নেই, কেননা অপবিত্র হাতে এদের আগলে রাখবে কীভাবে!
এসব প্রকাশকদের মধ্যে কয়েকজনের স্বপ্ন আমি জেনেছি, তাঁদের অসহনীয় কষ্ট দেখেছি, অনুভব করতে চেয়েছিও তাঁদের সাথে উঠাবসা করে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে বেশ অগ্রসর মনে হলো এইসময়ে-
১. পেন্ডুলাম পাবলিশার্সে রুম্মান তার্শফিক:
রুম্মান তার্শফিক এখনও ত্রিশ ছুঁয়নি। এই বয়সে প্রকাশনার বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা আর এই জগতের ধুলাবালিও মেখে নিয়েছে পরম ভালোবাসায়; প্রকাশনাকে কীরকম অন্তস্ললে লালন করে, যেন সেখানে কোন দোষে বাহিত না করে। নিরলস প্রচেষ্টার মধ্যে প্রেসে প্রেসে ঘুরে এমনকি নিজের চোখেও দেখেছি প্রেসে, বাঁধাইয়ের ঘরের মেঝেতে অতো পুরুষের মাঝেও স্বতস্ফূর্তভাবে বসে পড়ে বইয়ের খুঁটিনাটি ঠিক করতে। লেখক লিখেন কিন্তু সেটাকে প্রচার-প্রকাশযোগ্য অর্থাৎ সমাজে রাষ্ট্রে যোগ্য করে উঁচিয়ে তুলে ধরার অভিভাবক বনে যান একজন প্রকাশক। কী পরম মমতায় লেখকের বই নিজের করে লালন করে রুম্মান তার্শফিক। সবাই জানেন- সৃজনশীল প্রকাশনায় ভবিষ্যৎ নেই’ এই অর্থে টাকা পয়সা নেই অথচ রুম্মান যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে হতাশা মাড়িয়ে হাসে, প্রাণবন্ত থাকে সত্যিকার অর্থে সম্মানের যোগ্য। একজন কবিত্ব মনের অধিকারী হিসেবে এই প্রকাশনা শিল্পীর এমন আত্মত্যাগ আমাকে ঋণী করে.....
প্রকাশনা জগতে পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের উল্লেখযোগ্য কাজ -
আমরা হেঁটেছি যাঁরা (ইমতিয়ার শামীম), কন্যা ও জলকন্যা (জাকির তালুকদার), মান্টো কে আফসানে (অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ), ফিফটিন গভর্নরস আই সার্ভড উইথ (অনুবাদ: আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), হোয়াই ইজ সেক্স ফান (অনুবাদ: সন্ন্যাসী রতন)।
২. উপকথা প্রকাশনের ফকির তানভীর আহমেদ:
নামের আগে ফকির- এটি নিয়ে তানভীর ভাইকে কখনও প্রশ্ন করিনি কিন্তু ভেবে পেয়েছি তিনি সত্যিকারের ফকির। অর্থাৎ ফানা হয়ে যাওয়া, আত্মত্যাগ শুধু যে শিল্পে; ফকির তানভীর ভাইয়ের পড়াশোনাও বেশ, মার্জিত বোধ সম্পন্ন প্রকাশনার প্রতিটি কাজ। উপকথা প্রকাশনাকে ইতোমধ্যে বেশ গাম্ভীর্যে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রকাশনা জগতে উপকথা প্রকাশনার উল্লেখযোগ্য কাজ -
সতীনাথ ভাদুড়ী রচনাবলি ৪ খন্ড, দারোগার দপ্তর ৩ খন্ড, বিমল কুমার সমগ্র ২ খন্ড, জয়ন্ত মানিক সমগ্র ৩ খন্ড,
তারাশঙ্কর রচনাবলি ২৫ খন্ডে ।
৩. চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের মঈন ফারুক:
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ‘চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনকে বেশ নির্ভরযোগ্য জায়গায় নিয়ে গেছেন মঈন ফারুক। বেশ বুদ্ধিদ্বীপ্ত আর কৌশলে রয়েছে আন্তরিকতার ছাপ। হোঁচট খেয়ে দাঁড়ানোর মানসিকতা মঈন ফারুককে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়...
প্রকাশনা জগতে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের উল্লেখযোগ্য কাজ-
উপন্যাস সমগ্র : মলয় রায়চৌধুরী, গল্প সংগ্রহ : মোহাম্মদ রফিক, জয়নালের ইতালিযাত্রা : জাহেদ মোতালেব, পয়েন্ট ওয়াই (থ্রিলার) : জয়নুল টিটো, তারাশঙ্কর : জাকির তালুকদার।
৪. জাগতিক প্রকাশনের রহিম রানা :
রহিম রানাকে সম্ভবত বেশি অনুভব করি স্নেহে ভালোবাসায়। সেটি রহিম রানার প্রাপ্য। রহিম চমৎকার রানার। প্রকাশনা জগতে কে কখন ল্যাং মারে সেখানে রহিম রানার দৃঢ়চেতা মনোভাব, সেই সাথে স্কিলফুল ফোর্স প্রকাশনার বিবিধ সৌন্দর্যে রহিম রানা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশনা শিল্প নিয়ে রহিম রানার স্বপ্নের নিজস্ব জগৎ বেশ বর্ণিল...
প্রকাশনা জগতে জাগতিক প্রকাশনের উল্লেখযোগ্য কাজ-
বিপ্লবী বাংলাদেশ (১৯৭১ সালে প্রকাশিত পত্রিকা), পুঁজি ও পুঁজিবাদ (নাওজীশ মাহমুদ), শাহবাগ। ধর্ম রাজনীতি চেতনা (বিধান রিবেরু), স্মৃতির খেয়ায় যাই ভেসে যাই (আনোয়ারা সৈয়দ হক), বধ্যভূমির পথে পথে (ড.সেলিনা রশীদ)।